গত এক মাসে একটা দেশের শাসক ও পুরো শাসন ব্যবস্থা পাল্টে গেল। স্বৈরাচার আর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে কত শত তাজা প্রাণ ঝরল তার বিনিময়ে এলো নতুন স্বাধীনতা। আফসোস শুধু নারী নির্যাতনের চিত্রের কোনো পরিবর্তন এলো না। নারী শুধু তার নিজগৃহে পেল না স্বাধীনতা, পেল না সম্মান। সমাজে নারীর প্রতি মর্যাদাপূর্ণ মনোভাব না থাকায় জুলাই মাসের পরিস্থিতিতেও নারী ও শিশুরা আক্রান্ত হয়েছে।
ফেসবুকের নিউজফিডে একটা মেয়ের লাইভ ভেসে বেড়াচ্ছে। মেয়েটা বলছে, তার প্রতি অত্যাচারের কারণে প্রথম স্বামীকে ডিভোর্স দিয়েছে। দ্বিতীয় স্বামীও অত্যাচার করছে। তার অভিযোগ, দ্বিতীয় স্বামী চাকু দিয়ে তার মুখ চিড়ে দিয়েছে, নাকের হাড় ভেঙে ফেলেছে। মুমূর্ষু অবস্থায় সে ২০ দিন হসপিটালে থেকেছে, মৃতু্যর মুখ থেকে ফিরে এসেছে। আর তার স্বামীর অভিযোগ, বউ পরকীয়া করছে। পরকীয়া করে থাকলে বা অন্য কোনো অভিযোগ থাকলে থানা-পুলিশ আছে, ডিভোর্সের অপশন আছে। নির্যাতনের অধিকার তো কেউ স্বামীকে দেয়নি। বেশিরভাগ স্বামীই মনে করে বিয়ে মানে সেই নারীকে এক প্রকার কিনে নেয়া। তার সঙ্গে যা ইচ্ছাতাই করা যায়।
রাহানুমা সারাহ ছিলেন গাজী টিভির নিউজরুম এডিটর। মঙ্গলবার রাত পৌনে একটার দিকে হাতিরঝিলের প্রথম ব্রিজের নিচে লেকের পানিতে ভাসমান অবস্থায় তার লাশ পাওয়া যায়। গুঞ্জন স্বামীর সঙ্গে অমিলের। এটা হত্যা নাকি আত্মহত্যা সে তদন্ত এখনো চলমান। গত বুধবার গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে সাবিকুন্নাহার পপি (৩০) নামের এক গৃহবধূর মরদেহ তার বাবার বাড়িতে পৌঁছে দিতে এসে আটক হয়েছেন তার স্বামী ও শাশুড়ি। জানা যায়, যৌতুকের জন্য সাবিকুন্নাহারকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করতেন শ্বশুরবাড়ির লোকজন।
নারীর প্রতি এই অমানবিকতা শুধু দেশেই নয়, প্রতিবেশী দেশেও চলছে। ডাক্তার মৌতিতা দেবনাথ ধর্ষণের ঘটনায় উত্তাল কলকাতা শান্ত না হতেই ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে ৪০ সেকেন্ডের একটি ভিডিও, সেখানে দেখা যায় এক নারীর দুই পা বাঁধা অবস্থায় তাকে রশি দিয়ে মোটর সাইকেলের সঙ্গে বেঁধে টেনে চলেছেন তার স্বামী। নারী তাকে বাঁচাতে চিৎকার করছেন কিন্তু কেউই এগিয়ে আসেনি। সেই মোটরসাইকেল এবড়োথেবড়ো ওই পাথুরে সড়কের ওপর দিয়ে ছুটে চলা শেষে মোটর সাইকেলটি থামিয়ে ওই নারীর ওপর পা রেখে দাঁড়ান। নারীটি তখন গুরুতর আহত, যন্ত্রণায় কাঁদছেন। কিন্তু সেই স্বামী কোমরে হাত রেখে নিজের কৃতকর্ম কতটা সফল হয়েছে, তা দেখছেন। স্ত্রীকে তিনি এটা 'শাস্তি' দিয়েছেন। অপরাধ হলো, মানা করা সত্ত্বেও স্ত্রী তার বোনের কাছে যেতে চেয়েছিলেন। ঘটনাটি ভারতের রাজস্থান রাজ্যের নাগাউর জেলার। হায় নারী জীবন! কত তুচ্ছ কারণে যে তার জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে সেটা জানার জন্য গবেষণার দরকার পড়ে না, শুধু এই জুলাই মাসের নারী নির্যাতনের খবরগুলোই তার প্রমাণ দেয়।
বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ১৬টি পত্রিকায় প্রকাশিত খবর সংকলিত করে জানিয়েছে, জুলাই মাসে ২৫৫ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের খবর প্রকাশিত হয়েছে। নির্যাতনের শিকারের অর্ধেকই শিশু, ১২৪ জন। ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যার খবর প্রকাশিত হয়েছে ৬২টি। এ ছাড়া ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যার ২টি এবং ধর্ষণচেষ্টার ২০টি খবর প্রকাশিত হয়েছে। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর তথ্য অনুসারে, জুলাই মাসে ১১ ধরনের নারী ও শিশু নির্যাতন বিষয়ে কল গ্রহণ করা হয়েছে ২ হাজার ৩৭২টি। এরপর পুলিশের অনাস্থা ও আন্দোলনপরবর্তী অচলাবস্থার সুযোগেও বেড়ে যায় নারী নির্যাতন।
কিন্তু আর কতকাল চলবে নারীর প্রতি এই অনাচার? সব বৈষম্যের অবসান হচ্ছে, কমে আসছে সব অনৈতিকতা, শুধু নারী নির্যাতনের গ্রাফটাই দিন দিন ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। নির্যাতন রোধে চাই আইনের কঠিন ও কঠোর বাস্তবায়ন এবং তার প্রচার। চাই সামাজিক আন্দোলন, মাদক নির্মূল ও পর্নো সাইডগুলোর নিয়ন্ত্রণ। প্রতিটি পরিবারের শিশুদের শেখাতে হবে নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান। সব শ্রেণির মানুষকে নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়ে আরও সচেতন করে তুলতে মিডিয়ার ওপরও দায়িত্ব বর্তায়।
(তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট)