বাল্যবিয়ের হিড়িক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সালমা বেগম বলেন, আমরা গবেষণা করে দেখেছি- নাটোর, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, জয়পুরহাট অঞ্চলে বাল্যবিয়ের হার বেশি। এসব অঞ্চলে শিক্ষার হার তেমন বাড়েনি। উত্ত্যক্ত করা বখাটেদের বেশিরভাগ মাদকাসক্ত। তাদের অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। তারা বিরক্ত করলে পরিবার অল্প বয়সেই মেয়েক বিয়ে দিচ্ছে। এসব পরিবারের শিক্ষার হারও কম। এমন অভিভাবকদের নিয়ে সমাবেশ, বিচার ব্যবস্থার সংকট নিরসন, সামাজিক সচেতনতা, আর্থিক অবস্থার উন্নতি এবং শিক্ষার হার বাড়ানো গেলে বাল্যবিয়ে কমিয়ে আনা সম্ভব।

প্রকাশ | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

নাজমুল হাসান
দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর কয়েকদিন আগে শুরু হয় পাঠদান। তবে বিদ্যালয় খোলার পর দেখা যায়, অনেক ছাত্রী আসছে না। এক-দু'জন নয়, ১৯ জন ছাত্রী অনুপস্থিত। তারা সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণিপড়ুয়া। তালিকা করে খোঁজ নিতে গিয়ে বেরিয়ে এলো উদ্বেগজনক তথ্য। ছুটির মধ্যে সবার বাল্যবিয়ে হয়ে গেছে। এমন ঘটনা ঘটেছে নাটোরের গুরুদাসপুর পৌর সদরের চাঁচকৈড় শাহীদা কাশেম পৌর বালিকা বিদ্যালয়ে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় বন্ধসহ নানা কারণে গত দুই মাসে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে তাদের। ১৯ ছাত্রীর বাল্যবিয়ের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন প্রধান শিক্ষক নেগার সুলতানা। বিদ্যালয় থেকে জানা গেছে, অপ্রাপ্ত বয়সি ছাত্রীদের বিয়ে হয়ে গেলেও শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, উপজেলা প্রশাসনসহ কিছু ক্ষেত্রে পাড়া-প্রতিবেশীরাও জানতে পারেননি। বিদ্যালয় খোলার পর ছাত্রীরা অনুপস্থিত থাকার কারণ খুঁজতে গেলে বিষয়টি জানাজানি হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়ের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে বিয়ে দেওয়ার কথা জানিয়েছেন অভিভাবকরা। বাল্যবিয়ে হওয়া অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীর বাবা পেশায় ভ্যানচালক। ভালো পরিবার থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসায় রাজি হয়ে যান জানিয়ে তিনি বলেন, এখন মনে হচ্ছে, বিয়ে না দিয়ে পড়াশোনা করানো ভালো ছিল। নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া বাল্যবিয়ের শিকার আরেক ছাত্রীর বাবার ভাষ্য, তিনি মেয়েকে বাল্যবিয়ে দিতে চাননি। কিন্তু বিদ্যালয়ে যাতায়াতের সময় মেয়েকে উত্ত্যক্তের শিকার হতে হয়। প্রতিবেশী অনেক মেয়ে পছন্দের ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেছে। এসব ভেবে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন তিনি। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাল্যবিয়ের শিকার ছাত্রীদের কয়েকজন এসএসসি পরীক্ষার্থী। অন্যরা ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির ছাত্রী। অভিভাবকরা তথ্য গোপন করে তাদের বিয়ে দিয়েছেন। তাদের সহযোগিতা করেছেন এক শ্রেণির বিবাহ রেজিস্ট্রার ও নোটারি পাবলিকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। তারা জাল কাগজপত্র তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন। বাল্যবিয়ে দেওয়ার পেছনে নানা ধরনের কারণ জানিয়েছেন অভিভাবকরা। তারা বলছেন, এলাকায় বখাটেদের উৎপাত, উত্ত্যক্ত করা, অপহরণচেষ্টা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পছন্দের ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার আতঙ্কে ছিলেন তারা। এ কারণে অপ্রাপ্তবয়সে বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দার অভিযোগ, কম্পিউটারের মাধ্যমে জন্মসনদের বয়স বাড়িয়ে কিছু অসৎ কাজি দিয়ে কাবিননামা করা হয়েছে। এই সনদ অভিভাবকরা প্রমাণ হিসেবে কাজে লাগিয়েছেন। বাল্যবিয়ে রোধে সরকারি-বেসরকারি তৎপরতা থাকলেও অসচেতন অভিভাবকদের কারণে ঠেকানো যায়নি। বিদ্যালয় খুললে সপ্তম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী এসে দেখে, তার চার বান্ধবী ক্লাসে আসেনি। সে বলছিল, খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি তার পাঁচ বান্ধবীসহ ১৯ ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে। এ নিয়ে উদ্বেগে আছে সে। এসব ঘটনার পর তার বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। তার কথায়, 'জানি না কি হবে। আমি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চাই।' প্রধান শিক্ষক নেগার সুলতানার তথ্য অনুযায়ী, বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী আছে প্রায় ১৫০ জন। এর মধ্যে দুই মাসে ১৯ জনের বিয়ে হয়েছে। এর আগেও বাল্যবিয়ে হয়েছে অনেক শিক্ষার্থীর। এ বিষয়ে গত ১৯ আগস্ট উপজেলা প্রশাসনের আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে তিনি অবগত করেছেন। সপ্তম শ্রেণির চার, অষ্টম শ্রেণির দুই, নবম শ্রেণির ছয় ও দশম শ্রেণির সাতজন বাল্যবিয়ের শিকার। আর তথ্য সংগ্রহ করলে এ সংখ্যা বাড়তে পারে। কারণ এখনো অনেকে বিদ্যালয়ে আসছে না। নেগার সুলতানা বলেন, অভিভাবক সমাবেশের আয়োজন করলেও তারা আসতে চান না। এ সপ্তাহে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে বিদ্যালয়ে সচেতনতামূলক সেমিনার করা হবে। উপজেলা প্রশাসন ও মহিলা বিষয়ক কার্যালয়ের প্রতিনিধিদের উপস্থিত থাকতে বলবেন। বাল্যবিয়ের খবর কেউ জানায় না উলেস্নখ করে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা রেখা মনি পারভিনের ভাষ্য, যেসব বিয়ের কথা জানতে পারেন, সেগুলো বন্ধ করা হয়। তার পরও বিদ্যালয়ে অভিভাবক সমাবেশ করার জন্য ইউএনওকে অবগত করা হয়েছে। এ বিষয়ে ইউএনও সালমা আক্তার বলেন, চলতি সপ্তাহে বিদ্যালয়টিতে সচেতনতামূলক অভিভাবক সমাবেশ করা হবে। বাল্যবিয়ে বন্ধে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন, তা চলমান রয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, সামাজিক নিরাপত্তা, দারিদ্র্য ও সচেতনতার অভাবে বাল্যবিয়ে কমানো যাচ্ছে না, বরং প্রতি বছরই বাড়ছে। সরকারি পদক্ষেপ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোগও কাজে আসছে না। আর্থিক সংকট, শিক্ষার হার, যৌন হয়রানির কারণে মূলত নিম্নবিত্ত মানুষ কম বয়সে মেয়ে বিয়ে দিচ্ছেন। এ ছাড়াও বিচার ব্যবস্থার সংকটও এর জন্য দায়ী। প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন ছাত্রী উত্ত্যক্তের শিকার হলে বখাটেদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে সময় লাগছে। হুমকির শিকার হচ্ছেন অভিভাবকরা। বাল্যবিয়ে অঞ্চলভিত্তিকও হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সালমা বেগম বলেন, আমরা গবেষণা করে দেখেছি- নাটোর, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, জয়পুরহাট অঞ্চলে বাল্যবিয়ের হার বেশি। এসব অঞ্চলে শিক্ষার হার তেমন বাড়েনি। উত্ত্যক্ত করা বখাটেদের বেশিরভাগ মাদকাসক্ত। তাদের অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। তারা বিরক্ত করলে পরিবার অল্প বয়সেই মেয়েক বিয়ে দিচ্ছে। এসব পরিবারের শিক্ষার হারও কম। এমন অভিভাবকদের নিয়ে সমাবেশ, বিচার ব্যবস্থার সংকট নিরসন, সামাজিক সচেতনতা, আর্থিক অবস্থার উন্নতি এবং শিক্ষার হার বাড়ানো গেলে বাল্যবিয়ে কমিয়ে আনা সম্ভব। একই বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, দেশের সাময়িক অস্থিরতা বেড়ে গেলে এমন ঘটনা বেশি হয়। সচেতন নাগরিক, আলেম, সমাজসেবকসহ সব শ্রেণিপেশার মানুষ এগিয়ে এলে বাল্যবিয়ের হার কমবে।