নারী কতটা স্বাধীন
অনেকেই প্রশ্ন করেন, নারী স্বাধীনতা বা নারীমুক্তি কোথায় নিহিত? এমন প্রশ্ন দেশের অনেক সচেতন মানুষই করে থাকেন। প্রকৃত অর্থে শিক্ষা ও স্বনির্ভরতার মধ্যে নারীর মুক্তি নিহিত। অর্থবিত্ত আর পরপুরুষের লোভনীয় হাতছানি অনেক নারীই উপেক্ষা করতে পারে না। ফলে, নারীকে এক আশ্চর্য মোহময় বিপজ্জনক অন্ধকার পথে নিয়ে যায়। এক শ্রেণির পুরুষও একই ধরনের লোভ সংবরণ করতে পারে না। ফলে, সংসারে ভাঙন দেখা দেয়, পরিবার টেকে না।
প্রকাশ | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
নুরী আফরোজ রোজী
নারী স্বাধীনতার কথা বলা হলেও বাংলাদেশের নারীরা কোথাও নিরাপদ নয়। হয় তাদের ধর্ষণ-গণধর্ষণ করা হচ্ছে, না হয় পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। এ এক ভয়ংকর অবক্ষয়গ্রস্ত সমাজে বসবাস করছি আমরা। মানুষরূপী হিংস্র পশুদের কারণে সমাজ কলুষিত হচ্ছে। এদের একমাত্র টার্গেট হচ্ছে নারীর শরীর। তাদের হাত থেকে আমাদের কোমলমতি শিশুরাও রক্ষা পাচ্ছে না। তাদেরও ধর্ষণ করা হচ্ছে। কেউ কেউ অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারাও যাচ্ছে। সমাজের এমন পরিস্থিতি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সমাজ ও রাষ্ট্র যদি নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারে, তা হলে তারা অরক্ষিত থাকবে- এটাই স্বাভাবিক। সামাজিক অবক্ষয় কোন পর্যায়ে গেছে ভাবতেও অবাক লাগে।
আমরা তো মধ্যযুগে বাস করছি না যে নারীর সম্মান ও মর্যাদা জমিনে লুটিয়ে পড়বে। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন থেকে নারী শাসিত এবং নারী স্বাধীনতার ব্যাপারে সোচ্চার। আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী ও স্পিকার নারী। বিচারপতি, মেয়র, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নারী। মন্ত্রী, সচিব, উচ্চপদের পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তা নারী। হিমালয় পর্বত জয় করেছেন আমাদের নারীরা। নারী যা কিছু ধারণ বা গ্রহণ করতে পারে- যা কিছু বর্জন করতে পারে, একজন পুরুষের পক্ষে তা কখনোই সম্ভব নয়। নারীর এ সামগ্রিকতা নির্দিষ্ট কোনো ফ্রেমের মধ্যে বন্দি করা সম্ভব নয়। তারপরও সমাজে নারী ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার।
অনেকেই প্রশ্ন করেন, নারী স্বাধীনতা বা নারীমুক্তি কোথায় নিহিত? এমন প্রশ্ন দেশের অনেক সচেতন মানুষই করে থাকেন। প্রকৃত অর্থে শিক্ষা ও স্বনির্ভরতার মধ্যে নারীর মুক্তি নিহিত। অর্থবিত্ত আর পরপুরুষের লোভনীয় হাতছানি অনেক নারীই উপেক্ষা করতে পারে না। ফলে, নারীকে এক আশ্চর্য মোহময় বিপজ্জনক অন্ধকার পথে নিয়ে যায়। এক শ্রেণির পুরুষও একই ধরনের লোভ সংবরণ করতে পারে না। ফলে, সংসারে ভাঙন দেখা দেয়, পরিবার টেকে না।
একুশ শতকে এসে যেখানে নারীর স্বাধীনতা ও আত্মপ্রতিষ্ঠার জাগরণ ঘটবে, সেখানে নারীরা কেবল আর্থিক কারণে যেমন আত্মনির্ভরশীল হতে পারছে না; ঠিক তেমনি অর্থকে কেন্দ্র করে নারীর ভাগ্য বিড়ম্বিত হচ্ছে, নির্যাতন-শোষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। এ বাংলাদেশেই মাত্র ছয় হাজার টাকার কারণে মা তার সন্তানকে বিক্রি করে দিচ্ছেন। নিজের স্ত্রীকে টাকার বিনিময়ে পতিতালয়ে বিক্রি করে দেওয়া বা দেশের বাইরে পাচার করে দেওয়ার ঘটনা তো প্রায়ই ঘটছে। সবই যেন অর্থদ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং নারীকে তুচ্ছ জ্ঞান করা, নির্যাতন শোষণের প্রতীক হিসেবে দেখা।
নারী যে কেবল যৌতুকের কারণে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে- তা নয়, ইভ টিজিংয়ের অসহায় শিকার হয়ে গত এক দশকে বহু নারীকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছে। বর্তমান সমাজে নারীরা নানামুখী নির্যাতনের শিকার। নারীদের উচিত এ নির্যাতনের প্রতিবাদ করা কিংবা এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। নির্যাতনের নিষ্ঠুর শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া নয়। ইভটিজিংয়ের যারা প্রতিবাদ করছে তারাও অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়েছে, কারো কারো জীবনও চলে গেছে। মনে রাখতে হবে, নারীমুক্তিতে বাধা শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধ, সামাজিক নিয়মনীতি, প্রথা-পদ্ধতি, কুসংস্কার ও অলীক বিশ্বাস। আর এ বাধা দূর করতে হবে রাষ্ট্র তথা সরকারকেই।
নারীর প্রধান প্রতিপক্ষ পুরুষ এবং পুরুষ শাসিত সমাজ। নারীর চারদিক আবেষ্টন করে রয়েছে পুরুষ। পুরুষ যেন নিশ্ছিদ্র প্রহরী। বাংলাদেশে প্রশাসনে যেসব নারী উচ্চপদে রয়েছেন, তাদের চারদিকেও পুরুষ। নীতিনির্ধারণ এবং পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে তাদের সুযোগ দেওয়া হয় না, কেবল নারী হওয়ার কারণে। পশ্চিমে নারীমুক্তির যে আন্দোলন চলছে তার ঢেউ এখনো পুরোপুরি আমাদের সমাজে এসে লাগেনি বলেই এ অবস্থা। পৃথিবীব্যাপী নারীরা যে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছেন, আন্তর্জাতিক সভা-সেমিনারে বক্তৃতা করতে পারছেন, নারীর অধিকারের ব্যাপারে সোচ্চার হতে পারছেন, তার প্রধান কারণ অধিক হারে নারীদের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠান। পৃথিবীর ২০টিরও বেশি দেশে এখন নারী সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান। এই ইতিবাচক প্রবণতা যতই বৃদ্ধি পাবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিও পরিবর্তিত হবে, দেশে দেশে নারী নির্যাতনও কমে আসবে।
নারী কোনো খন্ডিত বা একক বিষয় নয়। নারী হচ্ছে সামষ্টিক বা সামগ্রিক বিষয়। নারীকে কেবল একজন ব্যক্তি বা মানুষ হিসেবে দেখলে, বিচার বা মূল্যায়ন করলে চলবে না। নারী এসবের অনেক ঊর্ধ্বে। পৃথিবীব্যাপী আলোড়ন তোলার জন্য একজন নারীর বিপথে চলাই যথেষ্ট। অবশ্য সুপথে চলেও আলোড়ন তুলেছেন অনেকেই।
যতদিন পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর সামগ্রিক সত্তার বিকাশ না ঘটবে এবং সেভাবে তাকে মূল্যায়ন না করা হবে, ততদিন নারীর মুক্তি নেই। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিগত কারণে নারী যে আজও সেবাদাসী, যৌনদাসী, ভোগ্যপণ্য ও অত্যাচার নির্যাতনের উপকরণ হয়েই আছে। এ পরিস্থিতির যতদিন পর্যন্ত পরিবর্তন না হবে, ততদিন পর্যন্ত নারীমুক্তি, নারী স্বাধীনতা নিয়ে নারীবাদীদের রাজপথে আন্দোলন করে মাথা কুটে কোনো লাভ নেই। সমস্যা দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতার, সম্মান, মর্যাদা, মূল্যায়নের ও মূল্যবোধের। এ সমস্যা পুরুষের, নারীর নয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর নির্দিষ্ট কোনো জীবনছক কিংবা যৌনভূমিকা নেই। জীবনছক নেই এই অর্থে যে, তার জীবন পুরোপুরি নির্ভর করে পুরুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। আর যৌন ভূমিকা নেই কারণ, নারী যখনই তার যৌন স্বাধীনতা চেয়েছেন, তখনই তাকে আখ্যা দেওয়া হয়েছে অসতী বা ব্যভিচারী হিসেবে। পারিবারিক-সামাজিক ও ধর্মীয় শৃঙ্খলার বাইরে যে নারী চলতে চেয়েছেন তাকে নষ্টা-ভ্রষ্টা-কুলটা হিসেবে চিহ্নিত ও প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। ভোগবাদী সমাজ যতভাবে নারীসত্তাকে বিপন্ন বা পর্যুদস্ত করেছে তার প্রধান দিক হচ্ছে নারীকে পণ্যে পরিণত করা। প্রকৃত অর্থে শিক্ষা ও স্বনির্ভরতার মধ্যে নারীর মুক্তি নিহিত। সমাজে শিক্ষার আলো জ্বালাতে জাগতে হবে নারীকেই। নারী জাগৃতির পথিকৃৎ বেগম রোকেয়ার আমলে নারীশিক্ষা নিষিদ্ধ থাকলেও ভাইদের সহযোগিতায় তিনি যদি অন্দরমহলে থেকে গোপনে লেখাপড়া শিখতে পারেন, তবে একুশ শতকের নারীরা পারবে না কেন? পারতে তাদের হবেই। নারী শিক্ষিত না হলে জাতি শিক্ষিত হবে কীভাবে? তাই বলি জাগো নারী, জাগো বহ্নিশিখা, ঘরে ঘরে জ্বালাও শিক্ষার আলো। শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। সামাজিক সচেতনা বৃদ্ধিসহ পুরুষের মানসিকতার পরিবর্তন এবং নারী অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন করলে কিছুটা পরিবর্তন সূচিত হতে পারে, সেজন্য আমাদের নারীদের আরো দীর্ঘ পিচ্ছিল ও ঝুঁকিপূর্ণ পথ পাড়ি দিতে হবে।