পরিবারের কল্যাণে নারী
এক সময়ের গৃহবন্দি সুগৃহিণীরা সংসার সামলাতেন। স্বামী-সংসার নিয়ে পুরো পরিবারের দেখভালও করতেন। সেখানে পরিবারের কর্তা হিসেবে পুরুষের আধিক্যই সমাজ-সভ্যতার চিত্র। তবে যুগের ক্রমবিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সূচকের আওতায় নারীদের দুরন্ত অভিগমন একেবারে নজরকাড়া। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং শিক্ষায় নারীদের অনন্য অগ্রযাত্রা বর্তমান সময়ের নির্মাল্য।
প্রকাশ | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
নাজমা বেগম
পরিবারের কল্যাণে নারী সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ৫টি উন্নয়নসূচক- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা আর চিকিৎসা। সেখানে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার। এক সময়ের গৃহবন্দি সুগৃহিণীরা সংসার সামলাতেন। স্বামী-সংসার নিয়ে পুরো পরিবারের দেখভালও করতেন। সেখানে পরিবারের কর্তা হিসেবে পুরুষের আধিক্যই সমাজ-সভ্যতার চিত্র। তবে যুগের ক্রমবিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সূচকের আওতায় নারীদের দুরন্ত অভিগমন একেবারে নজরকাড়া।
অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং শিক্ষায় নারীদের অনন্য অগ্রযাত্রা বর্তমান সময়ের নির্মাল্য। বিচিত্র পেশা আর কর্মক্ষেত্রে সম্পৃক্ত হয়ে উপার্জনক্ষম স্থানে দৃশ্যমান হতে বহু সময় লেগেছে। তবে কোনো এক শুভক্ষণে তা হাতের মুঠোয়ও চলে আসা চমক দেওয়ার মতো। সংসার বরাবরই নারীরাই সামলিয়েছেন সূক্ষ্ন গৃহলক্ষ্ণীর আদলে। বর্তমানে সেখানে নতুন সময়ের যোগসাজশে শিক্ষার সুযোগ, রাজনৈতিক সচেতনতা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে যে নবযুগের সূচনা সেখানে নিয়মমাফিক কিছু কর্তৃত্ব তো সামলাতেই হয়।
স্বামী কর্তা ব্যক্তিও বিভিন্ন বিষয়ে স্ত্রীর ওপর বিশ্বাস এবং আস্থা রাখতে শুরু করলে নারীদের আর কোনো কিছু নিয়ে পেছনে তাকাতে হয়নি। সুশিক্ষিত, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী উপার্জনক্ষম যে কোনো নারী দু'হাতে সংসার এবং পেশাগত পারদর্শিতাও বর্তমান আধুনিকতার পরম চমক তো বটেই। শিক্ষিত নারীরা আজ আর ঘরে বসে নেই। যুগ আর সময়ের প্রবল হাতছানিতে শিক্ষার্জন শেষে কোনো এক পেশায় সম্পৃক্ত হয়ে সাংসারিক দায়-দায়িত্বে কর্তৃত্বের আসনে অভিষিক্ত হতেও সময় লাগছে না।
তবে এটাও সত্য বরাবরই নারীরা পরিবার কিংবা সংসারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিজেদের অবস্থান নজরকাড়া করেছেন। সম্প্রতি নারীপ্রধান পরিবারের ওপর বিবিএসের এক প্রতিবেদনে তেমন চিত্র উঠে আসছে। অর্থাৎ পরিবারের কর্তা আর কর্ত্রীর মিলিত সাবলীলতায় পারিবারিক দায়-দায়িত্ব যেন নারীদের জন্য এক অনন্য চিত্র তো বটেই। এখানে উপার্জন কিংবা বয়োজ্যেষ্ঠের কোনো বালাই নেই। যে গৃহবধূর স্বামী বিদেশে থাকেন তার স্ত্রীকে দেশে অবশ্যই নিজ পরিবারের দায়িত্ব নেওয়া অতি আবশ্যকও বটে।
ছেলেসন্তান যখন বিদেশে থাকেন তখন দেখা যায় অবিবাহিত বোনটিই সংসারের দায়-দায়িত্বের হাল ধরছেন। সর্বশেষ প্রতিবেদনে প্রতীয়মান হচ্ছে গত পাঁচ বছরে বিয়ে না করা মেয়েদের পরিবারপ্রধান হওয়ার হার বেড়েছে অনেক। এখানে নারী শিক্ষাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার ওপর উদ্যোক্তা তৈরিতে নারীদের যে দুরন্ত অভিযাত্রা তা আজ পেছনের অনেক সময়কে জোর কদমে অতিক্রম করার দৃশ্যও দৃষ্টিনন্দন। উদ্যোক্তা তৈরি হওয়া মানেই কোনো নারীর নিজের পায়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বিতা অর্জন করা। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অন্য সব অধীনতা থেকে মুক্তি দেওয়ার পরম চাবিকাঠি। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা পুরুষের চাইতে বেশি। যে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা বাণিজ্যে নারীদের এতদিন চরম অনীহা ছিল সেখানে আজ তারা ক্রমান্বয়ে দুরন্ত গতিতে এগিয়ে যাওয়ার চিত্র সত্যিই স্বস্তিদায়ক। তবে দেশে বিধবা এবং বিচ্ছেদ নারীদের সংখ্যাও হাতেগোনার অবস্থায় নেই। এসবের কারণে নারীরা মূলত পিতৃগৃহে চলে আসেন।
সেখানে দেখা যায় মাও এক হাতে সংসারের হাল ধরে জীবন কাটাচ্ছেন, আর নারীদের জন্য উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রে পিঠে-পুলির যে বাহারি আয়োজন সেটাও ঘরে বসেই বানানো যায়। তার বিনিময়ে যে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা সেটা কোনো নারীর জন্য নিজ পায়ে দাঁড়ানোর মহা সম্বল। হরেক কারণ এক সঙ্গে মিলালে স্পষ্ট হয় নারীরা স্বাবলম্বী হয়ে কীভাবে পরিবারের মূল নেতৃত্বে অভিষিক্ত হচ্ছেন। এমন কর্তৃত্ব কারও কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া তো নয়ই বরং আপন যোগ্যতায় শুধু নিজেকে প্রমাণ করা।
বাংলাদেশে এমন পরিবারও বিরল নয়, যেখানে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই চাকরি করেন। দুজনেই সমান উপার্জনক্ষম। সেখানে বহু আগ থেকেই কর্তৃত্ব আর পরিবারপ্রধানের দায়-দায়িত্বে উভয়েই সমান অংশীদার। সেটাও গত শতাব্দীর শেষ লগ্ন থেকে শুরু হওয়া। নারী শুধু নারীই নয়, একজন পরিপূর্ণ মানুষও বটে। তার আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যয় নিজেকে যথার্থভাবে গড়ে তোলার দক্ষতা ভেতরের বোধে সব সময় জিইয়ে থাকে।
অনেকের অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে গেলে তার পক্ষে সেভাবে সম্ভবও হয় না শিক্ষা জীবন চালানো কিংবা কোনো পেশায় জড়িত হওয়া। তবে বিয়ের পরও নারীরা তাদের অসমাপ্ত শিক্ষা জীবনকে শেষ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়াও যে কোনো পেশায় নিরবচ্ছিন্নভাবে ঢুকেও পড়ছে।
তেমন নারীর সংখ্যাও কিন্তু হাতেগোনার অবস্থায় থাকছে না। সুতরাং, বিবিএসের নতুন প্রতিবেদনে অবাক কিংবা চমকের চাইতেও যেন এটাই প্রত্যাশিত এবং বহুকাঙ্ক্ষিত তো বটেই। আসলে পুরো সমাজই নারী-পুরুষের মিলিত সহাবস্থান আর অংশীদারিত্ব। আর পরিবারও মিলেমিশে একাত্মতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায়। সেখানে কর্তৃত্ব, নেতৃত্ব সবই যেন আপেক্ষিক। যে যখন যোগ্যতায়, সক্ষমতায় পারদর্শী হবে তাকেই স্বাভাবিক নিয়মে সামনে এসে যেতে হবে। তিনি পুরুষ-নারী যেই হোন না কেন। একটি পরিবারের সদস্য হিসেবে নিজেও মনে করি- যার যেটুকু দায়দায়িত্ব তা সঠিকভাবে পালন করার মধ্য দিয়ে নিজেকেও সামনে নিয়ে আসা যায়।