বাল্যবিয়ে আর নয়
প্রকাশ | ১৬ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
তামান্না ইসলাম
বাল্যবিয়ে হলো অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির আনুষ্ঠানিক অথবা অনানুষ্ঠানিক বিয়ে। বিশেষত মেয়েরাই বাল্যবিয়ের শিকার বেশি হয়। বাল্যবিয়ের কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রধানত- দরিদ্রতা, যৌতুক, সামাজিক প্রথা, বাল্যবিয়ে সমর্থনকারী আইন, ধর্মীয় ও সামাজিক চাপ, অঞ্চলভিত্তিক রীতি, অবিবাহিত থাকার শঙ্কা, নিরক্ষরতা এবং মেয়েদদের বোঝা মনে করা। বাল্যবিয়ের অন্যতম একটি কারণ হলো, অভিভাবকদের ধারণা যে অল্প বয়সে বিয়ে মানে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা।
বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে বাল্যবিয়ের সংখ্যা কমলেও, 'সেভ দ্য চিলড্রেন'-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ৬৬ শতাংশ নারীর ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক সার্ভে অনুযায়ী, বাংলাদেশে নারীর বিয়ের গড় বয়স ১৫ বছর ৩ মাস থেকে ২৪ বছর আর যাদের ১৮ বছরের মধ্যে প্রথম বিয়ে হয়েছে তাদের শতকরা হার ৬৫ ভাগ? বাল্যবিয়ের শিকার শতকরা ৮০ ভাগ নারীরা স্বামী কর্তৃক নির্যাতিত হচ্ছেন। এছাড়া এসব নারীর শতকারা ৬০ ভাগ শিশু জন্মগত নানাবিধ রোগ ও প্রতিবন্ধিকতার শিকার হচ্ছে।? বর্তমানে ৬৬ শতাংশের এক তৃতীয়াংশ মা ১৯ বছরের হওয়ার আগেই গর্ভবতী হচ্ছেন।?
বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ আইন মূলত সামাজিক সংস্কারের সমস্যা- যা ভারতে সংগঠিত মহিলাদের আন্দোলনের দ্বারা যার সমাধান গৃহীত হয়েছিল। হিন্দু-মুসলিম সব নারী একত্রিত হয়ে তখন বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। গান্ধী জিও তাদের এই আন্দোলনকে সমর্থন করেন। নারীরা একযোগে ঘোষণা করেন, তারা নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আইন প্রণয়ন শুরু করবে, পুরুষ প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে।
অবশ্য বাল্যবিয়ে নিরোধ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ২০১৭ সালে 'বাল্যবিয়ে নিরোধক আইন-১৯২৯' বাতিলপূর্বক সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন-২০১৭ নামে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করেন। এই আইনে বলা হয়েছে, বাল্যবিয়ে অর্থ হচ্ছে এমন বিয়ে যার কোনো একপক্ষ বা উভয়পক্ষ অপ্রাপ্ত বয়স্ক। অর্থাৎ ২১ বৎসর পূর্ণ করেননি এমন কোনো পুরুষ এবং ১৮ বৎসর পূর্ণ করেননি এমন কোনো নারী যখন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তখন তা বাল্যবিয়ে হিসেবে গণ্য হবে।
এই আইনে বাল্যবিয়ের শাস্তির বিধান সম্পর্কে বর্ণনা করা আছে। সেখানে বলা হয়েছে, যদি কোনো প্রাপ্তবয়স্ক নারী বা পুরুষ বাল্যবিয়ে করলে তিনি অনধিক ২ বৎসর কারাদন্ড বা অনধিক ১ লাখ টাকা অর্থদন্ড বা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবেন। আরও বলা আছে যে, যদি অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনো নারী বা পুরুষ বাল্যবিয়ে করেন তবে তিনি অনধিক ১ মাস আটকের আদেশ বা অনধিক ৫০,০০০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয়দন্ডে দন্ডনীয় হবেন। এছাড়াও এতে দুই পরিবারের অভিভাবকদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। অর্থাৎ বাল্যবিয়ে সম্পাদনকারী বা পরিচালনাকারীও অপরাধী হিসেবে গণ্য হবেন।
জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিষয়ক সংস্থা ইউএনএফপিএ'র সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে এশিয়ার দেশগুলোর ভেতরে বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে উপরে। এক গবেষণায় জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর দুই শতাংশ হারে বাল্যবিয়ে কমছে। এই হারে কমতে থাকলে বাল্যবিয়ে নির্মূল করতে সময় লাগবে ২১৫ বছর। যা সরকারের একার পক্ষে রোধ করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের সচেতন হওয়াটা সব থেকে জরুরি। বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন-২০১৭ এর ৮ ধারাতে বাল্যবিয়ে সংশ্লিষ্ট পিতা-মাতাসহ অন্যান্য ব্যক্তির শাস্তি সম্পর্কে বলা আছে। সেখানে বলা আছে, 'পিতা-মাতা, অভিভাবক অথবা অন্য কোনো ব্যক্তি, আইনগতভাবে বা আইনবহির্ভূতভাবে কোনো অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির ওপর কর্তৃত্ব সম্পন্ন হইয়া বাল্যবিয়ে সম্পন্ন করিবার ক্ষেত্রে কোনো কাজ করিলে অথবা করিবার অনুমতি বা নির্দেশ প্রদান করিলে অথবা স্বীয় অবহেলার কারণে বিবাহটি বন্ধ করিতে ব্যর্থ হইলে উহা হইবে একটি অপরাধ এবং তজ্জন্য তিনি অনধিক ২ বৎসর ও অন্যূন ৬ মাস কারাদন্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয়দন্ডে দন্ডনীয় হইবেন এবং অর্থদন্ড অনাদায়ে অনধিক ৩ মাস কারাদন্ডে দন্ডনীয় হইবেন।'
বাল্যবিয়ে শুধু একটি সামাজিক ব্যধি নয়, বরং এটি একটি দন্ডনীয় অপরাধ। বাল্যবিয়ে একটি কন্যা শিশুদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। বাল্যবিয়ে মা ও তাদের সন্তানদের স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। শারীরিক ও মানসিকভাবে অপ্রস্তুত মায়ের সন্তান জন্মদানের সময় ঝুঁকি দেখা দেয় এবং অনেক ক্ষেত্রে গর্ভধারণজনিত নানা সমস্যার শিকার হতে হয়। অনেক সময় দেখা যায় মা ও শিশু মারাও যায়।
বাল্যবিবাহ একটি মেয়ের শৈশব কৈশর ছিনিয়ে নেয়। বাল্যবিয়ের প্রভাব মেয়েদের ওপর ব্যাপক- যা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও থেকে যায়। কিশোরী বয়সে বা তারও আগে বিবাহিত নারীরা কম বয়সে গর্ভধারণ করার ফলে স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভুগে। কম বয়সে গর্ভধারণ সন্তান জন্মদানে জটিলতা সৃষ্টি করে। গরিব দেশসমূহে অল্প বয়সে গর্ভধারণ শিক্ষার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়- যা তাদের অর্থনৈতিক মুক্তিকে বাধাগ্রস্ত করে। বাল্যবিয়ের শিকার নারীরা সাধারণত পারিবারিক সহিংসতা, শিশু যৌন নির্যাতন এবং বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার হয়। আমাদের সবার উচিত বাল্যবিয়ে রোধ কল্পে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।