মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১

বাড়ছে বিয়েবিচ্ছেদ

সাগর জামান
  ১৬ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
বাড়ছে বিয়েবিচ্ছেদ

সুন্দর জীবনের স্বপ্ন নিয়ে মানুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। নতুন পথ চলার অঙ্গীকারে এক সঙ্গে বসবাস শুরু করে। স্বামী-স্ত্রীর জীবনে প্রেম, ভালোবাসা, অভিমান, আনন্দ-বেদনা মিলেমিশে একাকার হয়। এ সব নিয়ে জীবন প্রবাহিত হয়। মানুষ বিয়ে করে জাগতিক জীবনকে সুখশান্তিতে পূর্ণ করার জন্য। ভালোবেসে সংসারে সুখ ও আনন্দের ফুল ফোটানোর জন্য। কিন্তু এই নষ্ট সময়ে স্বামী-স্ত্রী বন্ধনের রজ্জু ছিঁড়ে সংসারের ইতি টানছে খুব সহজেই। স্বামী-স্ত্রী নিবিড় নৈকট্য ছেড়ে বিচ্ছেদের পথ বেছে নিচ্ছে। অহরহ ঘটছে বিয়েবিচ্ছেদ। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাবে সম্পর্কের মাঝে তৈরি হচ্ছে দেয়াল। সহনশীল আচরণের অভাবও প্রকট হয়ে উঠেছে। ফলে তুচ্ছ কারণে বাড়ছে দাম্পত্য কলহ। বাড়ছে বিয়েবিচ্ছেদ। একটি সংসার ভাঙলে শুধু স্বামী-স্ত্রী ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, গোটা পরিবারের ক্ষতি সাধন হয়। যদি সন্তান থাকা অবস্থায় বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে তাহলে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সন্তান। তবে অনেক ক্ষেত্রে নিত্য কলহ থেকে বিয়েবিচ্ছেদ ভালো বলেও মনে করেন অনেকে। বাবা-মা'র কলহ সন্তানের মানসিক কষ্টের কারণ হয়। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া চরম পর্যায়ে গেলে অনেক সময় আত্মহত্যা বা খুনের ঘটনা ঘটে। তবে বিয়েবিচ্ছেদ কখনোই প্রত্যাশিত নয়। আমরা যে সমাজে বাস করি সেখানে সমস্যা সংকট প্রতিদিনের সঙ্গী; এই প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলা করতে হবে, সংসার রক্ষায় মনোযোগী হতে হবে। শুধু প্রতিষ্ঠা প্রতিপত্তির দিকে ছুটলে হবে না, সংসারে সময় দিতে হবে। সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই পরিহার করতে হবে। সংসার টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে যত্নবান হতে হবে। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতে হবে। আনন্দ-বেদনা ভাগ করে নেওয়ার মনোভাব রাখাটা জরুরি। ঝগড়ার প্রবণতা দূর করতে হবে। অযথা কলহে জড়ানো কারোর জন্যই মঙ্গল বয়ে আনে না এই ভাবনা সবারই থাকতে হবে। যে যার অবস্থানে থেকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। যাপিত জীবনের সব বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে এক সঙ্গে পথ চলার আকাঙ্ক্ষা রাখতে হবে। রাগের মাথায় বিচ্ছেদ ঘটালে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয় নানাভাবে। একাকিত্বের বেদনায় ক্ষতবিক্ষত হতে হয়। যা সে সময় বোঝা না গেলেও পরে অনুভব হয়। তখন অনুশোচনা করতে হয়। যে সময় নষ্ট হয়ে যায় সে ক্ষতি পূরণ হয় না কোনো কিছুতে। সাংসারিক জীবনের খরতাপ সহ্য করার মানসিক ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। জীবনে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আনন্দ-বেদনা থাকবেই। হতাশা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিবাহ বিচ্ছেদ কখনো কল্যাণ বয়ে আনে না। তারপরেও দিনে দিনে বিয়েবিচ্ছেদের হার বাড়ছে- যা অবশ্যই উদ্বেগের বিষয়। পুরুষের ক্ষেত্রে মাদকাসক্ততা, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, পরকীয়া প্রেম ইত্যাদি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। নারীদের ক্ষেত্রে উপার্জনক্ষম স্বাধীনচেতা এবং পরকীয়া প্রেম কারণ হিসেবে দেখা যায়। ধারণা করা অসঙ্গত হবে না যে, সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিয়েবিচ্ছেদের সংখ্যা বাড়ছে। সব ধরনের সংকট ছাপিয়ে সংসার জীবনের সবার সঙ্গে মধুর ও অন্তরঙ্গময় সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে সংসারকে অফুরন্ত আনন্দে ভরিয়ে তোলা যায়। এ ধরনের ভাবনা স্বামী-স্ত্রী দু'জনের রাখা দরকার। জীবনের সুখ-দুঃখকে আলিঙ্গন করতে হবে। সংসার জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হলে সংসার জীবনের আনন্দ উপভোগ হাতছাড়া হয়ে যায় এই সত্য মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত। স্বামী-স্ত্রী দু'জন দু'জনকে পবিত্র ভালোবাসায় বাঁধনে বেঁধে রাখার চেষ্টা করতে হবে। শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ-দেবর ও অন্যান্য স্বামীর দিকের আত্মীয়স্বজনদের প্রতি নারীদের এবং স্ত্রীর দিকের আত্মীয়স্বজনদের প্রতি পুরুষদের দায়িত্বের ও প্রীতির হাত সম্প্রসারিত করতে হবে। বিচ্ছেদ নয় সান্নিধ্য পিপাসা রেখে সংসার জীবনকে ক্রিয়াশীল রাখতে হবে। আগে পরিবারে সবার সঙ্গে নিয়মিত আড্ডা হতো হাসিঠাট্টা ও গল্পগুজব হতো। এখন মানুষের আচরণগত পরিবর্তন হয়েছে অনেক। এখন স্বামী-স্ত্রী এক সঙ্গে সময় কাটানোর সময় পায় না। সবাই যে যার মতো মোবাইলে ইন্টারনেট ফেসবুকে নিমগ্ন থাকে। বিবাহ বন্ধনে বাধা পড়ার পর স্বামীর পরিবারের সঙ্গে স্ত্রীর যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় সেখানে স্ত্রী তার মর্যাদা, অধিকার, সঠিকভাবে খুব কম পরিবারে পায়। বরং অনেক পরিবারে পদে পদে লাঞ্ছনার সয়ে যেতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে অনেক স্বামীর লাম্পট্য ও নির্যাতন স্ত্রীকে সহ্য করতে হয়। এক সময় সে অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে। সে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে, পুরুষ নির্যাতনের ঘটনাও কম ঘটছে না। পুরুষরা উপার্জন করে। প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। সংসার চালানোর দায়িত্ব তার কাঁধে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে স্ত্রীর কাছ থেকে ন্যূনতম সম্মান সহমর্মিতা পায় না। স্বামীকে স্ত্রী অপমান করে। তা স্বামী মেনে নিতে পারে না। সমস্যা প্রকট হয়ে ওঠে। শুরু হয় নানা দ্বন্দ্ব। ঝগড়া-বিবাদ থেকে বিচ্ছেদ। এ দেশে গ্রামাঞ্চল থেকে তুলনামূলকভাবে শহরে বিয়েবিচ্ছেদের ঘটনা বেশি দেখা যায়। আর শহরের নারীরা বিয়েবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে অগ্রবর্তী রয়েছেন। ডিভোর্সের আবেদন বেশি করে নারীরা। এর জন্য কি আধুনিক ও প্রচলিত জীবন ব্যবস্থা দায়ী? বিয়েবিচ্ছেদ সন্তানদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। বিয়েবিচ্ছেদ নারী ও পুরুষকে অশান্তি থেকে মুক্ত করলেও তাদের সন্তানদের হৃদয়কে রক্তাক্ত করে। সন্তানদের মানসিক যন্ত্রণার শিকার হতে হয়। তাদের জীবন হয়ে ওঠে বিষাদময়। সংসার জীবনের প্রতি অনীহা কেন তৈরি হচ্ছে তা অবশ্যই ভাবার বিষয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হওয়ার জন্য এবং বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের কারণে বিয়েবিচ্ছেদের ঘটনা বেশি ঘটছে। পরনারী ও পরপুরুষের আসক্তির অভিযোগ থেকে সংসার ভাঙছে। পাশাপাশি কারণ হিসেবে দেখা যায় নানা ধরনের পারিবারিক সমস্যা- যৌতুকের দাবি, প্রযুক্তির ব্যবহার, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) প্রকাশিত এক জরিপ প্রতিবেদনে বিয়েবিচ্ছেদের দুই ধরনের হার ওঠে এসেছে। একটি হলো- স্থূল, অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার অনুপাতে বিয়েবিচ্ছেদের হার। আর অন্যটি সাধারণ বিয়েবিচ্ছেদের হার, যেখানে ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সিদের হিসাব করা হয়।

বিবিএসের হিসাবে ২০০৬ থেকে ২০২১ সাল সময়ে স্থূলবিচ্ছেদের হার শূন্য দশমিক ৬ থেকে ১ দশমিক ১-এর মধ্যে ওঠানামা করেছে। ২০২২ সালে তা বেড়ে ১ দশমিক ৪-এ দাঁড়ায়। সাধারণ বিয়েবিচ্ছেদের হারটি হিসাব করা হয়েছে নারী ও পুরুষ আলাদাভাবে। দেখা যায়, ২০২১ সালে নারীদের সাধারণ বিয়েবিচ্ছেদের হার ছিল ২-এর সামান্য কম। সেটা পরের বছর বেড়ে ৩ দশমিক ৬-এ দাঁড়ায়। একইভাবে পুরুষের ক্ষেত্রে হারটি ২০২১ সালে ছিল ২-এর সামান্য বেশি। পরের বছর তা বেড়ে ৩ দশমিক ৮-এ দাঁড়ায়।

বিবিএস বলছে, বিয়েবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে বড় কারণ বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক। জরিপে উত্তরদাতাদের প্রায় ২৩ শতাংশ এ কারণে সামনে এনেছেন। এরপর রয়েছে দাম্পত্যজীবন পালনে অক্ষমতা ২২ শতাংশ। এছাড়াও রয়েছে ভরণপোষণের ব্যয় বহন করতে অসামর্থ্য অথবা অস্বীকৃতি, পারিবারিক চাপ, শারীরিক নির্যাতন, যৌন অক্ষমতা বা অনীহা ইত্যাদি।

বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের কারণে সবচেয়ে বেশি বিচ্ছেদ হয়েছে ঢাকা বিভাগে, কম ময়মনসিংহ বিভাগে। দাম্পত্যজীবন পালনে অক্ষমতায় বিবাহবিচ্ছেদ বেশি বরিশালে, কম সিলেটে। ভরণপোষণ দিতে অসমর্থতার কারণে বিয়েবিচ্ছেদ বেশি রাজশাহীতে, কম চট্টগ্রামে।

পারিবারিক চাপে বিয়েবিচ্ছেদ বেশি ময়মনসিংহে, কম ঢাকায়। নির্যাতনের কারণেও বিয়েবিচ্ছেদ বেশি হয়েছে ময়মনসিংহে, কম রাজশাহীতে। যৌন অক্ষমতা অথবা অনীহার কারণে রংপুরে বিয়েবিচ্ছেদ বেশি হয়েছে। বরিশালে এ ক্ষেত্রে হার শূন্য। দীর্ঘদিন বিদেশে থাকায় তালাকের ঘটনা বেশি ঘটছে সিলেটে।

বিবিএসের পরিসংখ্যানের বাইরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের তথ্য বলছে, বিয়েবিচ্ছেদের আবেদন সাধারণত বেশি করেন নারীরা। ২০২২ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মোট বিয়েবিচ্ছেদ হয়েছে ৭ হাজার ৬৯৮টি। এর মধ্যে স্ত্রীরা আবেদন করেছিলেন ৫ হাজার ৩৮৩টি- যা মোট আবেদনের ৭০ শতাংশ। ঢাকা উত্তরের চিত্রও প্রায় একই। সেখানে বিয়েবিচ্ছেদের আবেদনের ৬৫ শতাংশ নারীর।

বিয়েবিচ্ছেদের এ রকম চিত্র আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। সমাজ নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা দুঃসময়ে বন্দি হয়ে আছি। দাম্পত্য জীবনের দুঃখকষ্ট আশা-নিরাশা স্বপ্ন, স্বপ্নভঙের বেদনার মাঝে জীবনের অর্থময়তা আবিষ্কার করার চেষ্টা চালানো প্রয়োজন। বিয়েবিচ্ছেদ কল্যাণ বয়ে আনে এ কথা যেমন সত্য তেমনি এ কথাও বলা প্রয়োজন, তিক্ততাপূর্ণ সম্পর্কের চেয়ে বিচ্ছেদ ভালো। কারণ সম্পর্কের তিক্ততা থেকে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। যে সম্পর্ক স্বাভাবিক জীবনযাপনে বাধা সৃষ্টি করে সে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা সঠিক কাজ নয়। তবে ভেবেচিনতে করাইটাই ভালো। একাকিত্বের জীবনটা বড়ই কষ্টের- যা সহজে পূরণ করা যায় না; গেলেও জীবনের পূর্ণতা পায় না। কোথায় যেন দূরত্ব রয়েই যায়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে