একটা কৌতুক মনে হলো- দুই পাগল রাস্তা দিয়ে হাঁটতেছিল এমন সময় বৃষ্টি শুরু হলো। প্রথম পাগল বলল, 'আকাশটা ছিদ্র হইয়া গেছে'? একথা শুনে দ্বিতীয় পাগল বলল, 'অলরেডি ঝালাই কাজ শুরু হইয়া গেছে। বাংলাদেশে পারিবারিক সহিংসতা এখন অনেকটাই সে রকম। বৃষ্টিতে ফুটো হচ্ছেই আর ঝালাইয়ের কাজ চলছে তো চলছেই..... কিন্তু স্থায়ী কোনো সমাধান হচ্ছে না। যে কথা বলছিলাম, বাংলাদেশে ইদানীং পারিবারিক সহিংসতা বেশ বেড়ে গেছে। প্রতিনিয়ত কোনো না কোনোভাবে নির্যাতিত হচ্ছে আমাদের মা, বোন, ভাই, সন্তান, শ্বশুর, শাশুড়ি ও পুত্রবধূরা। পারিবারিক সহিংসতা মানে কিন্তু মোটেও নারী নির্যাতন নয়। পারিবারিক নির্যাতন হচ্ছে (গৃহ নির্যাতন বা পরিবারে সংঘটিত সহিংসতা) যা কিনা একসঙ্গে বসবাসের মতো পারিবারিক পরিবেশে সংঘটিত বা অন্যান্য নির্যাতনকে বোঝায়। সম্পর্কগুলো বা একই লিঙ্গভিত্তিক সম্পর্ক কিংবা সাবেক স্বামী-স্ত্রী অথবা বিস্তৃত অর্থে শিশু-কিশোর, বাবা-মা, ভাইবোন, এমনকি বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মাকে রাস্তায় ফেলে দেওয়া, তাদের প্রতি অবহেলা, অযত্ন ইত্যাদি।
আবার ব্যাপক অর্থে শারীরিক, মৌখিক, মানসিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, প্রজজনমূলক এবং যৌননির্যাতনসহ একাধিক রূপ পরিগ্রহ করে যেখানে সূক্ষ্ন জবরদস্তিপূর্ণ রূপ থেকে শুরু করে বৈবাহিত ধর্ষণ, দমবন্ধ, তালাক, বাল্যবিয়ে, বহুবিয়ে, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, পরকীয়া, আত্মহত্যা, মারধর, খুন, এসিড নিক্ষেপ, যৌনবিকৃতিসহ নানা ধরনের নির্যাতন। এছাড়াও পারিবারিক হত্যাকান্ডের মধ্যে রয়েছে পাথর মেরে হত্যা করা, অগ্নিদগ্ধ করা, মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা ইত্যাদি।
সম্প্রতি, পারিবারিক সহিংসতাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে- পিতা কর্তৃক মেয়ে সন্তান ধর্ষণ, নির্যাতন, সন্তান কর্তৃক মা-বাবা খুন আবার বাবা-মা কর্তৃক সন্তান খুন, অপমান, নির্যাতনের শিকার, ভাই কর্তৃক বোনের সম্পত্তি আত্মসাৎ, বৃদ্ধ বাবা-মাকে রাস্তায় ফেলে দেওয়া, মেয়ে শিশুকে হত্যা করা, যৌতুকের জন্য তালাক দেওয়া, পরকীয়ার কারণে স্বামীকে কিংবা স্ত্রীকে মেরে ফেলা, স্বামীর পুরুষাঙ্গ কেটে নেয়া। এসব নির্যাতন এখন হরহামেশাই দেখা যাচ্ছে। আসলে কালের প্রবাহে নির্যাতনের চালচিত্র বদলাচ্ছে।
প্রসঙ্গত, গত ১৬ আগস্ট চট্টগ্রামের পটিয়ায় সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের জের হিসেবে পটিয়ার সাবেক পৌর মেয়র ও চেয়ারম্যান শামসুল আলম মাস্টারের ছেলে মাইনুল তার মা জেসমিন আক্তারকে গুলি করে হত্যা করে। আবার জয়পুরহাটে মাকে জবাই করে হত্যার অভিযোগে মাদকাসক্ত ছেলেকে আটক করেছে পুলিশ। শুধু তাই নয়, পারিবারিক কলহের জের ধরে ঠাকুরগাঁওয়ের সদর উপজেলার রুহিয়ায় দুই সন্তানকে বিষ প্রয়োগে হত্যার অভিযোগ উঠেছে মা নুরবানুর আক্তারের বিরুদ্ধে। আবার কুমিলস্নার চান্দিনায় কন্যা শিশুকে হত্যার দায়ে কারাগারে মাকে পাঠিয়েছেন আদালত। এমন উদাহরণ এখন ভূরি ভূরি। আবার পরকীয়ার কারণে স্বামী রিফাতকে কোপানোর সময় রিফাতকে রক্ষার চেয়ে নয়ন বন্ডকে নিবৃত্ত করার চেষ্টায় মৃতু্যদন্ডপ্রাপ্ত আসামি মিন্নির ঘটনা কারো অজানা নয়। কিংবা নাটোরের সেই আলোচিত কলেজ শিক্ষিকা খায়রুন নাহারের আত্মহত্যা এবং তার ছেলের বয়সি স্বামী মামুনের কাহিনী সেটাই কিন্তু পারিবারিক সহিংসতারই কারণ। আবার একের পর এক বাবা কর্তৃক মেয়ে কিংবা শ্বশুর কর্তৃক ছেলের বউ ধর্ষিত, শাশুড়িকে কুপিয়ে হত্যা কিংবা সম্প্রতি ঘটে যাওয়া রাজধানীর দক্ষিণখানে ১০ তলা ভবনের ছাদ থেকে লফিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর আত্মহত্যা এটাও কিন্তু পারিবারিক সহিংসতার কারণ।
এই যে, চারিদিকে এত সহিংসতা তার কি কোনো প্রতিকার নেই? মানুষের জীবনে দ্বন্দ্ব থাকতেই পারে। মান অভিমান, প্রেমপ্রীতি, অবৈধ সম্পর্ক, অবৈধ মেলামেশা সৃষ্টির আদিম যুগ থেকে বহমান। তাই বলে নির্যাতন, খুন, ধর্ষণ, অঙ্গহানি, এসিড সন্ত্রাশ করতে হবে? আমাদের দেশের মানুষের একটাই সমস্যা কোনোকিছু হলে আইনের ওপর কিংবা সরকারের ওপর সুন্দরভাবে দায় চাপিয়ে দেওয়া। দায় কী শুধু সরকার আর আইনের? আমাদের কি কোনো দায় নেই? পারিবারিক সহিংসতার জন্য মূলত দায়ীই হচ্ছে পরিবার। একটি পরিবারই পারে এটি থেকে মুক্ত থাকতে।
আমাদের দেশে পরিবারগুলোতে পারিবারিক মূল্যবোধ, পরস্পরের প্রতি মায়া মমতা, স্নেহ, দায়বদ্ধতা, নৈতিকতা কমে গেছে। সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলোতে আয়া বুয়া দ্বারা সন্তানের লালনপালন, সন্তানকে ঠিকমতো সময় না দেওয়া, সন্ত্রাস কার সঙ্গে মিশছে কি করছে সে সব খোঁজ না করা, মোবাইল, ল্যাপটপ ইন্টারনেটে ঝুঁকে পড়া, গরিব পরিবারগুলোতে বিনোদনের নামে সারাদিন মোবাইল নেটওয়ার্কে পরে থাকা, সন্তানের চাহিদা পূরণ না করা, পারিবারিক সম্প্রীতি কমে যাওয়া, ইত্যাদি কারণে দিনের পর দিন বেড়ে যাচ্ছে পারিবারিক সহিংসতা। পাশাপাশি মানুষের মধ্যে বেড়ে গেছে লোভ-লালসা, ক্ষমতার দাম্ভিকতা, কে কাকে দমিয়ে রাখবে সেই নগ্ন প্রতিযোগিতা।
বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশে ইউনিসেফসহ মাত্র দুই একটি এনজিও পারিবারিক সহিংসতা নিয়ে কাজ করে কিন্তু সেই সব সেক্টরে নেই তেমন কোনো কাউন্সিলর। অন্যদিকে, পারিবারিক নৈতিক শিক্ষার পাশাপাশি স্কুল-কলেজগুলোতেও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। কারণ পরিবারের পরে নৈতিকতা শেখানোর দায়িত্ব কিন্তু স্কুলেরই ওপরই বর্তায়। পাশাপাশি সরকারি বেসরকারি সব পর্যায়ে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র, হটলাইন ও প্রশাসনের জোরালো ভূমিকা অনস্বীকার্য। এছাড়াও দারিদ্র্য বিমোচন, বেকারত্ব দূর, সচেতনতা, সর্বোপরি ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি সবাইকে জাগ্রত করা, এলাকায় এলাকায় নারী ও পুরুষ নির্যাতন কমিটি, সালিশ কমিটি, সুস্থধারার সংস্কৃতি চর্চা, খেলাধুলার ব্যবস্থা ইত্যাদি গ্রহণ করা দরকার।
পারিবারিক সহিংসতা দূরীকরণে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। পাঠ্যপুস্তকসমূহে সংবেদনশীল শিক্ষনীতি ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করা উচিত। প্রশাসন, বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সব ক্ষেত্রে জেন্ডার ও মানবাধিকার বিষয় অন্তর্ভুক্ত, যুব সমাজের শিক্ষার মান ও কর্মসংস্থানের মান উন্নয়ন করা উচিত। এর পাশাপাশি আবারো বলছি, পারিবারিক সহিংসতা কমানোর জন্য পরিবারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সন্তানের সামনে এমন কোনো আচরণ করবেন না- যাতে সন্তান বড় হয়ে সেগুলো অনুকরণ করে। আসুন পারিবারিক সহিংসতা দূর করি সুন্দর ও নিরাপদ সমাজ গড়ি।