স্বাধীনতাপরবর্তী পাঁচ দশকে বাংলাদেশের নারীদের জীবনমানে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। পড়াশোনা ও কর্মক্ষেত্রসহ জীবনের সর্বক্ষেত্রেই নারীদের অংশগ্রহণ উলেস্নখযোগ্য হারে বেড়েছে। গত কয়েক দশকে নারীরা পড়াশোনা ও কর্মক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করলেও দেশে এখনো নারী নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন, শ্লীলতাহানি, ইভটিজিং এবং ধর্ষণ-গণধর্ষণসহ নারীদের প্রতি সহিংসতামূলক কর্মকান্ডে ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন আসছে না। বরং এখন নারীর প্রতি সহিংসতার হার বেশ উদ্বেগজনক। গণপরিবহণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল, এমনকি অনেক নারী নিজের পরিবারেও সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। সমাজের অপেক্ষাকৃত দুর্বল শ্রেণির মানুষই বেশিরভাগ সহিংসতা শিকার হন। বিশেষ করে নারী ও শিশু, অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র, বিশেষত শ্রমজীবী মানুষ এবং সমাজের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ সহিংসতার শিকার হন।
সাধারণত সহিংসতা বলতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, মানবিক বঞ্চনা ইত্যাদি বিষয়কে বোঝানো হয়। আর নারীর প্রতি সহিংসতা বলতে নারীর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নারীর প্রতি অমানবিক আচরণ করাকে বোঝায়। ইভটিজিং, গণপরিবহণে নারীদের হয়রানি করা, বাজেভাবে স্পর্শ করা, শরীরের আকার-আকৃতি নিয়ে হেয় করা, শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ প্রভৃতি বিষয় নারীর প্রতি সহিংসতামূলক কর্মকান্ডের উদাহরণ। পরিবারের এক সদস্য কর্তৃক অন্য সদস্যের প্রতি সহিংসতামূলক আচরণকে পারিবারিক সহিংসতা বলা হয়।
নারীদের নিজের শরীরের আকার-আকৃতি নিয়ে মানুষের কটু কথা শোনা, বাস অথবা ট্রেনে উঠলে যাত্রীদের কুদৃষ্টি কিংবা আপত্তিকর স্পর্শের শিকার হওয়া, রাস্তায় হাঁটতে গেলে পথচারীদের কাছ থেকে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি অথবা আপত্তিকর কথা-বার্তার শিকার হওয়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় বিড়ম্বনার শিকার হওয়া যেন এখন নারীদের জন্য একটি স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে ভিকটিম বেস্নইমিংয়ের ভয়ে অনেক নারী মুখ খুলতেই ভয় পায়।
বর্তমানে নারীর প্রতি সহিংসতার হার বেশ উদ্বেগজনক। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন গত মার্চ মাসে 'তরুণীদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট এবং মানসিক স্বাস্থ্যে এর প্রভাব' শীর্ষক শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ৬৯ দশমিক ৯২ শতাংশ তরুণী নিজের শরীরের গড়ন নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হয়েছেন। তার মধ্যে ৩৭ দশমিক ২৪ শতাংশ তরুণী নিজের আত্মীয়স্বজন ও ১৪ দশমিক ২৫ শতাংশ তরুণী জানিয়েছেন, তারা নিজেদের পরিবার থেকে বডি শেমিংয়ের শিকার হয়েছেন। সমীক্ষায় অংশ নেওয়া তরুণীদের মধ্যে ৬৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। ৩৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ তরুণী শৈশবে যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছিলেন। এ ছাড়া ৪৫ দশমিক ২৭ শতাংশ তরুণী গণপরিবহণে হয়রানির শিকার হয়েছেন। অনলাইনে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন ৪৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ তরুণী।
নারীদের প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নারী নির্যাতনের একটি উলেস্নখযোগ্য কারণ। এখনো সমাজের চোখে নারীদের অবজ্ঞার চোখে দেখা হয়। যার ফলে, নারীরা নির্যাতনের শিকার হলেও তা কারও কাছে প্রকাশ করতে পারে না। এমনকি অনেকে নিজের পরিবারেও বলতে পারে না। আবার কখনো কোনো নারী তার প্রতি করা সহিংসতামূলক আচরণের প্রতিবাদ করলে, বেশিরভাগ মানুষ উল্টো ভুক্তভোগী নারীকেই দোষারোপ করে বা করার চেষ্টা করে।
নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি। অবশ্য শুধু আইন দিয়েই আমরা আমাদের সমাজে নারীদের প্রতি করা অমানবিক আচরণ বন্ধ করতে পারব না। এজন্য আমাদের মানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তনও অত্যন্ত জরুরি। নারীর প্রতি সহিংসতা একটি জাতীয় সমস্যা। যার ফলে, একজন নারীর স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয় এবং সে তার জীবনের স্বাভাবিক গতিপথ থেকে বিচু্যত হয়। সহিংসতামূলক আচরণ ব্যক্তিকে মানসিক ও শারীরিকভাবে দুর্বল করে তোলে। যা তার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবনকে অনিশ্চয়তায় ফেলে দেয়। সমাজ, পরিবার এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে নারীদের যথাযথ মর্যাদা দিতে হবে। আমাদের গড়ে তুলতে হবে একটি সহিংসতামুক্ত সমাজ।