স্বামীহীন নারীকে আমাদের সমাজে এখনো বোঝা, জঞ্জাল, অসহায় বা অপয়া ভাবা হয়। হোক সে তালাকপ্রাপ্ত, বিধবা বা বনিবনা না হওয়ার কারণে অথবা নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে স্বামীর কাছ থেকে আলাদা থাকা। কোনো অবস্থাতেই সমাজ, পরিবার তাদের সহজভাবে নেয় না। নিতে চায় না। তারপরও জীবন যাদের এ পথে নিয়ে আসে তাদের তো পথ চলতেই হয়। তবে পথটা হয়ে ওঠে কঠিন। প্রতিনিয়ত বাধার সম্মুখীন হতে হয় তাদের। জীবন তাদের কাছে হয়ে ওঠে এক যুদ্ধক্ষেত্র। আমাদের দেশের মেয়েরা, মায়েরা যতই শিক্ষিত হোক না কেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি মেয়েদের শিখানো হয় জীবনে যাই হোক না কেন তোমাকে সংসার সামলাতে হবে। স্বামীর সঙ্গে বোঝাপড়া ঠিক রেখে চলতে হবে। সন্তানদের মানুষ করতে হবে। আর সংসারের কাজও জানতে হবে। যতই আধুনিকতার ছোঁয়া লাগুক না কেন মানুষের জীবনে, আমাদের সমাজ ও পরিবার থেকে এ ধারণা আজও শেষ হয়ে যায়নি। এ ধারণার ব্যতিক্রম যদিও চোখে পড়ে খুব কম। ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায় বাস্তব অবস্থা।
বিধবা শেফালি আক্তার। ২৭ বছর আগে ১৯৯৫ সালে তার স্বামী মারা যায় স্ট্রোক করে। মেয়ের বয়স ছিল তখন নয় বছর, ছেলের চার। তার স্বামী সরকারি চাকরি করতেন। থাকতেন ধানমন্ডি পনেরো নাম্বার সরকারি কোয়ার্টারে। স্বামী মারা যাওয়ার পর চলে আসেন মীরপুর শ্বশুর বাড়িতে। দোতলা বাড়ি, বাড়িতে যারা থাকত কেউ নিজের জায়গা ছাড়েনি। অল্পবয়সি একজন বিধবা নারী দুই শিশু সন্তানসহ কোথায় যাবে তা নিয়ে ভাববার সময় কারো নেই। মাকে একাই ভাবতে হয়েছিল তার সন্তানদের কথা। তার ছেলেমেয়ে নিয়ে একাই সংগ্রাম করে আসছেন। অফিসে দিনের পর দিন ঘুরতে হয়েছে টাকার জন্য। শিশু সন্তানদের শাশুড়ির কাছে রেখে ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে তখন তিনি বাইরের কাজ করতেন। ওই সময়ে সমস্ত পৃথিবীটাই অচেনা হয়ে উঠেছিল তার কাছে। যাদের কাছে প্রয়োজনে যেতাম তারাই আড়চোখে তাকাত। সরকারি বাসায় থাকা অবস্থায়ই অফিস থেকে টাকা তুলে নিচতলা একটা ইউনিট কোনোরকমে থাকার মতো কমপিস্নট করে তাকে বাসায় উঠতে হয়েছিল। এ নিয়েও কত ঝামেলা। এ বাড়ি তার ছেলেমেয়েদের, এখানেও অনেক কথা, বলতে গেলে বহু কষ্টে তাকে বাড়িতে উঠতে হয়েছে। বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করানো, পড়াশোনা করানো থেকে মেয়ের বিয়ে দেওয়া পর্যন্ত সব কাজ একাই সামলাচ্ছেন এখন পর্যন্ত। তার ভাষায় 'পুকুরে সাঁতার শিখতে নেমে শিখার আগেই সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার মতো জীবন আমার। মাত্র ষোলো বছর বয়সে বাবা-মা বিয়ে দেন। বারো বছর সংসার করেছি। সাজানো একটা সংসার তছনছ হয়ে গেছে। মনে হতো আমি অথৈ পানিতে ডুবে যাচ্ছি। কিন্তু যখনই ভাবতাম আমার সন্তানদের আমি ছাড়া আর কেউ নেই। তখনই আমার মধ্যে কোত্থেকে যেন শক্তি চলে আসত। ওদের কোনো অভাব আর বায়না পূরণের জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করেছি। আলস্নাহ এত সহায় যে আমি এ পর্যন্ত কোথাও ঠেকিনি। আমার সমস্ত সমস্যায় ভরসার জায়গা ছিল শাশুড়ি। মানুষ বিয়ের প্রস্তাব দিত, খারাপ দৃষ্টিতেও তাকাত। কত রকম মনগড়া কথা বলত। বেশি খারাপ লাগলে শাশুড়ির কাছে সব বলতাম। তিনি ছিলেন আমার আশ্রয়।' এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললেন তিনি। পরিবারের সদস্যদের আর্থিক অবস্থা ভালো। সবাই বাচ্চাদের গিফট দেয়। অসুস্থ হলেও দেখে বলে জানান। তিনি পেনশন পাচ্ছেন। ছেলে মাস্টার্স দিবে এবার। মেয়ে বিবাহিত সংসারে ভালো আছে। সবকিছুর পর এইটাই সত্যি যে, নিজের চাওয়া পাওয়া বিসর্জন দিয়ে সন্তানদের আঁকড়ে আছেন এখনো। নিজের কথা ভাববার সময় পাননি তিনি।
সালমা বেগম দুই ছেলে সন্তানের মা। বড় ছেলের বয়স চৌদ্দ ছোট ছেলের আট। ছয় বছর ধরে ঢাকার বস্তিতে থাকেন। মানুষের বাসায় কাজ করেন। পনেরো বছর বয়সে বাবা-মায়ের অমতে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন রিয়াজকে। রিয়াজের বাড়ি সাভারে। জমিজমা আর্থিক অবস্থা ভালো। বেশ সুখেই ছিল সালমা বেগম। ছোট ছেলের জন্মের পর রিয়াজ দ্বিতীয় বিয়ে করে আর সালমা বেগমের ওপর শুরু হয় শারীরিক নির্যাতন। তার স্বামী আর সতীন মারধর করে ঘর থেকে বের করে দিত বলে জানায়। পরে খাবারও বন্ধ করে দেয়। ছোট ছেলের জন্মের পর দুই বছর ছিল স্বামীর বাড়িতে। এক শীতের রাতে সতীন তার স্বামীর সামনে ছেলেদের গায়ের লেপ কেড়ে নিয়ে মেরে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিল। তার কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না বলে রাতের অন্ধকারে দুই ছেলেকে নিয়ে বাসে করে চলে আসে মিরপুর এক নম্বর মাজারে। মাজারে খাবার খেতে টাকা লাগে না। তাই ওখানে থেকেই সে কাজের সন্ধান করে। মাজারের এক খালাকে ধরেই ঘর ভাড়া নেয় বস্তিতে। কারণ অপরিচিত লোককে কেউ ঘর ভাড়া দেয় না। কাজেও নেয় না। সকাল ৬টায় কাজ শুরু করে শেষ হয় বিকাল ৪টায়। ঘরে ফিরে বাজার করে রাতের রান্না করতে হয়। ভোর ৪টায় ওঠে রান্না করে ছেলেদের সারাদিনের খাবার ঘরে রেখে আসে। 'আফা আর পারি না, কয়দিন পর পর মাথা ঘুইরা পইরা যাই। ছেলেডারে কামেও নেয় না কেউ, সবাই ভোডার আইডি চায়। ছেলেডা কাজ করলে তো ঘর ভাড়াডা দিতে পারতাম। আমার শইল্যে আর শক্তি নাই। কেডা দ্যাকব আমার ছেলে গো। বাপ দাদার জমি বাড়ি আছে। সৎ মায়ের কাছে দিব না।' এই সালমা বেগমদের জন্য আইন কতটা সক্রিয়? তার ছেলেদের অধিকার আদায়ে কেউ এগিয়ে আসবে?
লাইলি ডি কোস্টা দুই মেয়ে, স্বামী, শাশুড়ি, ননদ, দেবর সবাইকে নিয়ে একসঙ্গেই থাকতেন ফার্মগেটে ভাড়া বাসায়। ২০০২ সালে বিয়ে হয়, ২০০৯ সালে ছোট মেয়ের বয়স যখন সাত মাস তখন তার স্বামী খুন হয় দুর্বৃত্তদের হাতে। লাইলি ডি কোস্টার বয়স তখন তেইশ বছর। স্বামীর লাশ নিয়ে পরিবারের সবাই একসঙ্গে গ্রামে চলে যায়। চারদিন পর তার মেয়েদের নিয়ে ফিরে এলেও আসেনি তার শাশুড়ি ননদ দেবর। হাতে সামান্য টাকা পয়সা যা ছিল স্বামীর লাশ নিয়ে কবরস্থ করাতে পুরোটাই শেষ হয়ে যায়। শ্বশুরবাড়ির কেউ না আসায় তিনি ফোন করে জানতে পারেন ছেলে বেঁচে নেই। তাই তারা আর আসবেন না। দেবর জানায়, দাদা বেঁচে নেই এখন বৌদির সঙ্গে থাকলে মানুষ নানা কথা বলবে। অথচ তার স্বামী নিজের মা আর তার ছোট চার ভাইবোনকে সঙ্গে রাখতেন পড়াশোনা করিয়েছেন, দুই ভাইবোনের বিয়ে দিয়েছেন। এখন যে দু'জন একসঙ্গে ছিল তারা দুইটা শিশুকেও কোনোদিন দেখতে আসেনি। লাইলি ডি কোস্টার পৃথিবী বদলে যেতে থাকে। বাসাভাড়া আর বাচ্চাদের খাবার যে করেই হোক জোগাড় করতে হবে। অসম্ভব আত্মপ্রত্যয়ী এক নারী। তিনি জানান, 'আমি জানতাম আমি কোনো পাপ করতে পারব না। কাজ আমাকে করতেই হবে। কিন্তু কোথায় যাব কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। দুই মাসের ভাড়া পরিচিত একজনের কাছ থেকে ধার নিয়েছিলাম।' তার স্বামী মারা যাওয়ার দু'মাস পর এক রাতে থানা থেকে ফোন করে জানানো হয় তিনি স্বামী হত্যার মামলা করবেন কিনা। তিনি অপ্রস্তুত ছিলেন, জানালেন আগামীকাল যোগাযোগ করবেন। থানায় যাওয়ার পর জানতে পারেন তার দেবরকে ফোন করা হয়েছিল মামলার ব্যাপারে সে জানিয়েছে মন্টু ডি কোস্টা লা ওয়ারিশ, তার পক্ষে কেউ মামলা লড়বে না। তার বৌদি মানসিক বিকারগ্রস্ত। সব শুনে লাইলি জানায়, মামলায় লড়বে। তার স্বামীর বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে কাজ শুরু করে দেয়। থানা, সিআইডি অফিস, জঅই অফিস, কোর্ট ঘুরে তিনি বুঝতে পারেন কঠিন হবে বিচার পাওয়া। কিন্তু যত কঠিনই হোক তিনি খুনিদের বিচার করবেনই। মামলার কাজ শুরু হলে বড় মেয়েকে দাদি-পিসির কাছে রেখে ছোট মেয়েকে কোলে নিয়েই তিনি ছুটতে থাকেন। তখন বড় মেয়েকে তার পিসি এতিমখানায় রেখে আসে। একদিকে অফিস আর একদিকে মামলার কাজ। সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে রাত ১০টা/১১টায় বাসায় ফিরতে হতো প্রতিদিন। একমাস পর এতিমখানায় মেয়েকে দেখতে গিয়ে তিনি আরও ভেঙে পড়েন। সারা গায়ে মারের দাগ, সঙ্গে সঙ্গে নিজের মেয়েকে বাসায় নিয়ে আসেন। দু'জনকে নিয়ে বাইরে দৌড়ানো সম্ভব না। তাই বড় মেয়েকে ভর্তি করে দেন কালীগঞ্জ খ্রিষ্টান মিশনারি বোর্ডিং স্কুলে। এভাবে প্রায় তিন বছর কেটে যায়। তার স্বামীর খুনের আসামিদের বিচার হওয়ার পর বড় মেয়েকে বোর্ডিং স্কুল থেকে ঢাকা নিয়ে আসেন। একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। বড় মেয়ে পড়ছে এইচএসসি আর ছোট মেয়ে ক্লাস সিক্সে। অফিস অনেক সহযোগিতা করেছে। স্বামীর অফিসে এখন তিনি কাজ করেন। স্বামীহত্যার বিচার করতে গিয়ে প্রচুর টাকা খরচ করতে হয়েছে। এখন দুই মেয়ে নিয়ে কোনোরকম দিনযাপন করছেন। শান্তি এইটুকুই যে তিনি বিচার পেয়েছেন। মেয়েদের দেখার জন্য তাদের বাবার পক্ষের কেউ আসে না। কখনো তাদের একটা গিফটও দেয় না। এইটা তার খারাপ লাগে।
অথচ বিভিন্ন নারীবাদী সংগঠন, এনজিও, সরকারি মন্ত্রণালয় দপ্তর/অধিদপ্তর কত ভালো ভালো কথা বলছে, বড় বড় বুলি আওড়াচ্ছে, সমাজ ও পরিবার কিন্তু এক জায়গায়ই দাঁড়িয়ে আছে। পথ চলছে একা স্বামীহীন নারীরা। হাজার বাধা অতিক্রম করেও তাদের সামনে এগুতে হয়। নিজে বাঁচা এবং সন্তানকে বাঁচানোর পথ খুঁজে নিতে হয়। সন্তানদের আগলে রাখতে হয়। তাদের মানুষ করতে হয়। বাবা-মা দুইজনের দায়িত্ব একাই পালন করতে হয়। সমাজ সমালোচনা করতে ছাড়ে না, কটূক্তি করতে ছাড়ে না। কিন্তু কয়জন মানুষ এসব নারীদের পাশে দাঁড়ায়! সহযোগিতার হাত বাড়ায়! তাদের অধিকার আদায়ে আপনজন আর আইন পাশে নেই কেন? আমি আপনি তুমি তুই বদলালে সমাজ বদলাবে। শুধু নিজের প্রয়োজনে না, যে কোনো পরিস্থিতিতে অন্য মানুষের প্রয়োজনে পাশে দাঁড়ানোর মানসিকতা থাকতে হবে। আমরা যেন প্রত্যেকে নিজের প্রয়োজনে নিজের জন্য শিক্ষিত, উদার, আধুনিক, প্রগতিশীল না হই। আর তখনই বদলাবে সমাজ।