রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

নারীর ক্ষমতায়ন ও বিয়েবিচ্ছেদ

বাংলাদেশে বিয়ের হার বেড়েছে। বেড়েছে তালাক বা বিয়েবিচ্ছেদও। আর বিয়েবিচ্ছেদের সবচেয়ে বড় কারণ বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক এবং দাম্পত্যজীবন পালনে অক্ষমতা (বনিবনার অভাব)
আসাদুলস্নাহ গালিভ আল সাদি
  ২৮ মে ২০২৪, ০০:০০
নারীর ক্ষমতায়ন ও বিয়েবিচ্ছেদ

পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেট অধিনায়ক সাঈদ আনোয়ার সাম্প্র্রতিক সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি মন্তব্য করেছেন, পাকিস্তানে বিয়েবিচ্ছেদ বৃদ্ধিতে নারীদের ক্ষমতায়নকে দায়ী করে। যা নারীদের কর্মক্ষেত্রে যোগদান করার বিষয়ে নতুন এক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এবং যথার্থভাবে তাই স্বাভাবিক। এই ধরনের পশ্চাদপসরণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি শুধুমাত্র সমাজে নারীদের যে অগ্রগতি অর্জন করেছে তাই ক্ষুণ্ন করে না বরং ক্ষতিকারক স্টেরিওটাইপকেও স্থায়ী করে। এবং আধুনিক সমাজের জটিল গতিশীলতাকে চিনতেও ব্যর্থ করে আমাদের। এটি লজ্জাজনক এবং বর্ণবাদী আচরণ যা তিনি প্রকাশ করেছেন। সভ্য সমাজে এই ধরনের বিভাজনমূলক এবং বর্ণবাদী মন্তব্যের কোনো স্থান নেই। এই ধরনের পুরনো ধ্যান-ধারণাগুলো প্রত্যাখ্যান করতে হবে আমাদের।

আনোয়ারের দাবি- একটি গভীর-উপস্থিত পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার প্রতিফলন করে যা নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নকে ঐতিহ্যগত লিঙ্গ ভূমিকার জন্য হুমকি হিসেবে দেখে। এটি বোঝায় যে, মহিলাদের তাদের ক্যারিয়ার এবং স্বাধীনতা অনুসরণের চেয়ে গৃহস্থালিকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। এই ধারণাটি শুধু পুরনোই নয়, প্রগতিশীল সমাজ কাঠামোর জন্যও ক্ষতিকর। বাস্তবতা আনোয়ারের ভ্রান্ত বিশ্বাস থেকে অনেক দূরে। একটি কর্মজীবন বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত একটি ব্যক্তিগত পছন্দ এবং লিঙ্গ নির্বিশেষে প্রতিটি ব্যক্তির একটি মৌলিক অধিকার। বিয়েবিচ্ছেদের মতো সামাজিক সমস্যার জন্য দায়ী না করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশকারী নারীদের তাদের সংকল্প এবং অর্থনীতিতে অবদানের জন্য বিশেষ সম্মান করা উচিত।

পাকিস্তানে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা খুবই কম। পুরো ব্যবসায়ী সম্প্র্রদায়ের মধ্যে খুব জোর ১ শতাংশ। ব্যবসায়ে নারীদের এগিয়ে না আসার মূল কারণ হাতে নগদ অর্থের অভাব। ঋণ দেওয়া হয় জেন্ডারের ভিত্তিতে। পাকিস্তান 'অ্যাট দ্য রেট ১০০' শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাংকের মতে, ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে পাকিস্তান তার মোট শ্রমশক্তির মাত্র ৪০ শতাংশ ব্যবহার করছে। যে কারণে তাদের অর্থনীতি এখনো দুর্বল। পরিস্থিতি পরিবর্তনে বিশ্বব্যাংক পাকিস্তানকে নারীদের সম্ভাবনা কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল পরিচালিত ২০১৮ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, নারী ক্ষমতায়ন এবং শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের মোট দেশজ উৎপাদন ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।

পাকিস্তানের মতোই দক্ষিণ এশিয়ার বহু দেশের নারী পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মনোভাবের কারণে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। মূলত দুটি প্রবণতা-পুরুষের ওপর নির্ভশীলতা এবং নারী-পুরুষের মধ্যে সম্পদ ও সুযোগ বণ্টনে বৈষম্য-অর্থনৈতিকভাবে নারীকে স্বাবলম্বী হতে সব সময়ই পেছনের দিকে টেনে রাখে। এর পাশাপাশি দারিদ্র্য, অশিক্ষা এবং পরিবারের বাধার মতো বিষয়গুলো পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। নারীর অস্তিত্ব ও সম্পদ পুরোপুরি সঙ্গী পুরুষের ওপর নির্ভরশীল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পটপরিবর্তনে উলেস্নখযোগ্য অবদান রেখেছে দেশের নারীরা। এ ৫০ বছরে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনের সফলতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে নারীরা। মোটা দাগে দেখতে গেলে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ নারীর সামাজিক মর্যাদা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে নারীদের সর্বাত্মক অবস্থান কখনই কি মসৃণ ছিল- এ প্রশ্ন যদি করা হয়, উত্তরের মুখোমুখি দাঁড়ালে অজান্তেই শঙ্কার ভাঁজ পড়ে কপালে। 

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের হার ৩৮ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর সর্বশেষ ২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপে নারী হিস্যা ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশের কথা বলা হয়েছে। ওই জরিপ অনুযায়ী, দেশে শ্রমশক্তির আকার ৬ কোটি ৩৫ লাখ। এর মধ্যে ৬ কোটি ৮ লাখ মজুরির বিনিময়ে কাজ করেন। মোট শ্রমশক্তিতে ৪ কোটি ২২ লাখ পুরুষ আর নারী ১ কোটি ৮৭ লাখ। তবে শ্রমিক পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেলেও প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণের হার সীমিত। প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে আছেন মাত্র ৭ দশমিক ৬ শতাংশ নারী। উপসচিব ও সচিব পর্যায়ে এ হার ১ শতাংশ বা তারও কম। 

বাংলাদেশে বিয়ের হার বেড়েছে। বেড়েছে তালাক বা বিয়েবিচ্ছেদও। আর বিয়েবিচ্ছেদের সবচেয়ে বড় কারণ বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক এবং দাম্পত্যজীবন পালনে অক্ষমতা (বনিবনার অভাব)।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) এক জরিপ প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটির নাম 'বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস-২০২২।' জরিপটিতে নমুনা হিসেবে নেওয়া হয়েছে তিন লাখের বেশি পরিবার।

বিবিএসের হিসাবে, ২০০৬ থেকে ২০২১ সাল সময়ে স্থূলবিচ্ছেদের হার শূন্য দশমিক ৬ থেকে ১ দশমিক ১-এর মধ্যে ওঠানামা করেছে। ২০২২ সালে তা বেড়ে ১ দশমিক ৪-এ দাঁড়ায়। সাধারণ বিয়েবিচ্ছেদের হারটি হিসাব করা হয়েছে নারী ও পুরুষ আলাদাভাবে। দেখা যায়, ২০২১ সালে নারীদের সাধারণ বিয়েবিচ্ছেদের হার ছিল ২-এর সামান্য কম। সেটা পরের বছর বেড়ে ৩ দশমিক ৬-এ দাঁড়ায়। একইভাবে পুরুষের ক্ষেত্রে হারটি ২০২১ সালে ছিল ২-এর সামান্য বেশি। পরের বছর তা বেড়ে ৩ দশমিক ৮-এ দাঁড়ায়।

বিবিএস বলছে, বিয়েবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে বড় কারণ বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক। জরিপে উত্তরদাতাদের প্রায় ২৩ শতাংশ এ কারণ সামনে এনেছেন। এরপর রয়েছে দাম্পত্যজীবন পালনে অক্ষমতা-২২ শতাংশ। এছাড়াও রয়েছে ভরণপোষণের ব্যয় বহন করতে অসামর্থ্য অথবা অস্বীকৃতি, পারিবারিক চাপ, শারীরিক নির্যাতন, যৌন অক্ষমতা বা অনীহা ইত্যাদি।

নারীদের ওপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন, বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক এবং স্বনির্ভর নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি, অভাব-অনটন, বেকারত্ব, সন্দেহ, দাম্পত্য কলহকে বিয়েবিচ্ছেদের কারণ বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনরা। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান মনে করেন, 'তালাক নারী-পুরুষ উভয়ের অধিকার। আগে আমাদের দেশের নারীরা নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করে সংসার করতেন। কারণ তখন তাদের অর্থনৈতিক কোনো স্বাধীনতা ছিল না। তারা সংসারের সব কাজ করতেন। এখন শহর কিংবা গ্রামের নারীদের বড় একটা অংশ কর্মজীবী। এ কারণে আত্মসম্মানে আঘাত এলে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি তালাকের দিকে যেতে পিছপা হচ্ছেন না। তবে, তালাক কিন্তু দুই পক্ষের কারণেই হচ্ছে। পুরুষদের পক্ষ থেকেও তালাক দেওয়া হচ্ছে। পুরুষদের ক্ষেত্রে যেটা হয়, তা হলো পুরুষরা অন্য কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছেন অথবা পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারছেন না কিংবা পরিবারের অসন্তোষের কারণে তালাকের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। এতে বিচ্ছেদের মতো ঘটনা ঘটছে।' তালাকের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষকে দোষারোপ না করে বিষয়টিকে আর দশটি সামাজিক ঘটনার মতো করেই দেখা দরকার বলে মনে করেন আসকের নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান।

বিয়েবিচ্ছেদের হার বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন পেশায় কর্মরত মহিলাদের দায়ী করা জটিল কারণগুলোকে উপেক্ষা করে যা বৈবাহিক ভাঙনে অবদান রাখে। সম্পর্কের গতিশীলতা, আর্থিক চাপ, যোগাযোগের সমস্যা এবং ক্রমবর্ধমান সামাজিক নিয়ম সবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নারীর কর্মসংস্থানকে দোষারোপ করা শুধুমাত্র সম্পর্কের মধ্যে পুরুষদের তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয় না বরং বিবাহ টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বোঝাপড়া এবং সমঝোতার গুরুত্বকেও উপেক্ষা করে।

সুতরাং, আনোয়ারের এ ধরনের বক্তব্য সমাজে নারীর ভূমিকা সম্পর্কে ক্ষতিকারক স্টেরিওটাইপকে স্থায়ী করে। এটা বোঝায় যে, বৈবাহিক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য শুধুমাত্র মহিলারাই দায়ী এবং তাদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত পরিপূর্ণতা সাধনা কোনো না কোনোভাবে পারিবারিক জীবনের জন্য ক্ষতিকর। এই ধরনের মনোভাব লিঙ্গ বৈষম্যকে শক্তিশালী করে এবং আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক সমাজের দিকে অগ্রগতিতে বাধা দেয়।

সামাজিক চ্যালেঞ্জের জন্য নারীদের বলির পাঁঠা বানানোর পরিবর্তে, আমাদের উচিত লিঙ্গ সমতাকে উন্নীত করা, সুস্থ সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং দাম্পত্য কলহের মূল কারণগুলোকে সমাধান করা। এর জন্য প্রয়োজন সেকেলে লিঙ্গ নিয়ম ভেঙে ফেলা এবং সমর্থনমূলক উদ্যোগ যা নারীদের বিচার বা প্রতিক্রিয়ার ভয় ছাড়াই তাদের আকাঙ্ক্ষাগুলো অনুসরণ করতে সক্ষম করে।

পরিশেষে বলা যায়, শুধু পেশাজীবী নারীদের কারণে বিয়েবিচ্ছেদের হার বৃদ্ধির বিষয়ে সাঈদ আনোয়ারের বক্তব্য শুধু ভিত্তিহীনই নয়, ক্ষতিকরও বটে। তারা ক্ষতিকারক স্টেরিওটাইপগুলোকে স্থায়ী করে, মহিলাদের স্বায়ত্তশাসনকে ক্ষুণ্ন করে এবং বাস্তব সমস্যাগুলো থেকে বিরত থাকে। সামাজিক জীব হিসেবে আমাদের অবশ্যই এই ধরনের অ-সমাজতাত্ত্বিক ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে