নারীরা কতটুকু এগিয়েছেন

প্রকাশ | ২৮ মে ২০২৪, ০০:০০

মুজিব রহমান
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের লেখা নিয়ে একটি পাঠচক্রে একজন আইনজীবী প্রকাশ্যেই বললেন, তিনি তার স্ত্রীকে মারধর করেই সোজা রাখেন। স্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে এর চেয়ে বড় কোনো ওষুধ নেই। যখনই আমার স্ত্রী কথা শুনতে চায় না, তখন মার লাগালে কয়েক মাস ঠিকঠাক কথা শুনে। বিস্ময়ের যে, তাকে সমর্থন জানালো কয়েকজন। তবে এটা যে অপরাধ এবং এতে স্ত্রীর স্বাভাবিক জীবন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেটা স্মরণ করিয়েও দিলাম। বাংলাদেশে বিবাহিত নারীরা যে এমন ভাবাদর্শের পুরুষদের হাতে নিয়মিতই নিপীড়নের শিকার হন তার প্রমাণও দিচ্ছে জরিপের তথ্যও। বাংলাদেশে বিবাহিত নারীদের ৮৭%-ই স্বামীর মাধ্যমে কোনো না কোনো সময়ে কোনো না কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার হন। বাংলাদেশের ৭% নারী স্বামীর নির্যাতন থেকে বাঁচতে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। গত বছর পত্রিকায় ১৩৮৭ জন নারীর হত্যা বা আত্মহত্যার খবর প্রকাশিত হয়েছে। অপ্রকাশিত সংবাদ আরও বেশিই হবে। নারীদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশের তালিকার শীর্ষ ২০-এর একটি দেশ বাংলাদেশ। আমরা আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইয়েমেন, পাকিস্তান, ইরাক, দক্ষিণ সুদান, চাঁদ, কঙ্গো, সুদান, সোমালিয়ার মতো দেশের কাতারেই রয়েছি। শিশু, বয়ঃসন্ধি, গর্ভকালীন ও বার্ধক্যকালীন নির্যাতনের ধরন পাল্টাতে থাকে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের কল্যাণে বাংলাদেশে গত এক দশকে ৪০% মাতৃমৃতু্য কমেছে। তবে গর্ভবতী মায়েরাও এ দেশে বিপুলভাবেই নিপীড়নের শিকার হন। খুব হইচই করে সংবাদ প্রকাশিত হয় যে, দেশে এখন ৭ জন নারী ডিসি রয়েছেন। কিন্তু দেশে তো প্রায় ৫১% নারী হিসাব করলে অন্তত ৩২ জন নারী ডিসি থাকার কথা। বাস্তবিক ৭ হলো ৬৪-এর মাত্র ১০.৯৪%! তবে এটাও আশার কথা যে, প্রশাসনে নারীদের সংখ্যা বাড়ছে এবং ভবিষ্যতে আরও বাড়ার সম্ভানা রয়েছে। প্রশাসনের শীর্ষ পদের চেয়ে নিচের পদে নারীর হার বেশি। দেশে সচিব রয়েছেন ৮৬ জন, যার মধ্যে নারী সচিব ১০ জন (১১.৬৩%), অতিরিক্ত সচিব রয়েছেন ৩২৭ জন, যার মধ্যে নারী ৫৫ জন (১৬.৮২%), যুগ্ম-সচিব ৮৫৮ জন, যার মধ্যে নারী ১৮৬ জন (২১.৫৬%), উপসচিব ১৭০৪ জন, যার মধ্যে নারী ৩৯৫ জন (২৩.১৮%), সহকারী (সিনিয়রসহ) সচিব ৩৩০৯ জন, যার মধ্যে নারী ৮৯১ জন (২৬.৯৩%), উপজেলা নির্বাহী অফিসার রয়েছেন ৪৯২ জন, যার মধ্যে নারী ১৬০ জন (৩২.৫২%)। আমরা দেখছি নিচের পদগুলোতে নারীর সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে। এর মানে হলো ভবিষ্যতে এরা পদোন্নতি পেয়ে ওপরের পদে যখন যাবেন তখন সেখানেও নারীর সংখ্যা অনেক বেশি হবে। এখন গড় হারও বেড়েছে। সারাদেশে সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ৯২৭ জনের মধ্যে নারী রয়েছেন ৪ লাখ ৪ হাজার ৫৯১ জন (২৬.০২%)। নারীদের উচ্চশিক্ষার হার বাড়ার ফল আমরা দেখছি- সরকারি চাকরি ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ দ্রম্নতই বাড়ছে। কিন্তু অন্যত্র অবস্থাটা একই রকম। এই উচ্চপদে থাকা নারীদেরও স্বামীর হাতে নিপীড়নের শিকার হতে দেখি। আমার এক সহকর্মীর বিয়ে ঠিক হয়েছে। পাত্রপক্ষ আগেই জানাল যে, বিয়ের পরে বেতনের সম্পূর্ণ টাকা স্বামীর হাতে তুলে দিতে হবে। মেয়েটি আমার পরামর্শ নিতে এলে, এখনই বিয়ে ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ দেই। বলি, আপনি ভালো একটি চাকরি করছেন, পাত্র পেতে সমস্যা হবে না। পরের মাসেই আরেকটি সম্বন্ধ এলো সেখানে বিয়ে হয়। আরেক সহকর্মীকে শাশুড়ি বশীকরণ করার জন্য পানিতে হুজুরের তাবিজ ডুবায়। কিন্তু পানির রং আলাদা হয়ে যাওয়ায় এবং শাশুড়ির আচরণ ভিন্ন হওয়ায় মেয়েটির সন্দেহ হয়। তবুও সে সংসার টিকিয়ে রাখতে চাইত। এরপর স্বামী ঘোষণা দেয়, বেতন তার হাতে তুলে দিতে হবে নইলে চাকরি ছাড়তে হবে। মেয়েটি সাহস করেই বলে, প্রয়োজনে তোমাকে ছাড়তে পারি তবুও চাকরি ছাড়ব না। এরপর স্বামী থাপড়ানোর হুমকি দেয়, স্ত্রী ঘোষণা দেয়, আমারও হাত আছে, আমিও বসে থাকব না। এরপরেই স্বামী ঠান্ডা হয়। সবক্ষেত্রে নারীরা এমন সাহস দেখাতে পারে না। চাকরিজীবী নারীদের মতো এমন সাহস এখনো সাধারণ গৃহিণী বা ছোট চাকরিজীবীদের হয়ে ওঠেনি। আমার ওই বিজ্ঞ আইনজীবীর স্ত্রীর মতোই বহু গৃহিণীকে নিয়মিতই মার খেয়ে সংসার টিকিয়ে রাখতে দেখি। বাংলাদেশে এখন ৩ হাজার গার্মেন্টসে প্রায় ৪০ লাখ কর্মী, যার মধ্যে ৬০-৬২% নারী। কিছুদিন আগেও ৪৫ লাখ গার্মেন্টস কর্মীর মধ্যে ৩৫ লাখই ছিল নারী। তারও আগে ১৯৯০ সালের দিকে দেশে ৮০%-ই ছিলেন নারী গার্মেন্টস কর্মী। ২০২২-২০২৩ সালে দেশে ৪৭ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক রেমিট্যান্স আয় করে বাংলাদেশ কিন্তু নারী গার্মেন্টস কর্মীরা যে বেতন পায়, তা দিয়ে একটি সংসার কোনোভাবেই চলে না। এই নারীরা বহুবিধভাবেই নিপীড়নের মুখে পড়ে। বিশেষ করে তারা পুরুষ গার্মেন্টস কর্মীকেই সাধারণত বিয়ে করে। মেয়েরা গর্ভবতী হলে কিংবা সন্তান জন্ম দিলে প্রায়শই স্বামী পালিয়ে গিয়ে নতুন করে সংসার পাতে। আগের স্ত্রী পড়ে যায় মহাবিপাকে। শিশু সন্তান রেখে যাওয়ারও মানুষ পায় না। আবার তাদের আয়ের বড় অংশই চলে যায় বাসা ভাড়াতে। একার আয়ে আর চলতে পারে না। এমন সংকটে থাকা এক মায়ের গল্পই প্রকাশ করেছিল গার্ডিয়ান পত্রিকা। তা নিয়ে কম হইচই হয়নি। তবুও গার্মেন্টস কন্যাদের ভাগ্যের কোনো উন্নতি হয়নি। গার্মেন্টস কন্যারা এখাতে চাকরি হারালে আর অন্য খাতে চাকরিও পায় না। গার্মেন্টস খাতে পুরুষরা অধিকমাত্রায় এখন কাজ করছে। মাতৃত্বকালীন ও সন্তান পালনের সমস্যার কারণে গার্মেন্টস মালিকরাও চায় পুরুষদের। অথচ নারীরা গার্মেন্টসসহ সবখানেই কাজে বেশি মনোযোগী থাকে। পুরুষরা সামাজিক নিরাপত্তার সুবিধা নিয়ে ব্যবস্থাপক হিসেবে ভালো করে বড় পদগুলো বাগিয়ে নেয়। তাতেও নারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নারীর ক্ষমতায়ন বাড়লে সমাজ ও পরিবার সুন্দর হয়ে ওঠে। বিভিন্ন জরিপে দেখা গিয়েছে নারীরা তাদের আয় পরিবারের পেছনেই বেশি ব্যয় করে। পুরুষরা তাদের আয় প্রায়শই জুয়াখেলা, বাজি ধরা, মাদকগ্রহণ, পরকীয়া ও বন্ধুদের পেছনে ব্যয় করেন। সংসারী নারীরা আয়ের পুরো টাকাই সংসার সাজাতে ও সন্তানদের মানুষ করতে ব্যয় করেন। তারা সাধারণত বাজে খাতে টাকা ব্যয় করেন না। এ কারণে হলেও রাষ্ট্রকে এমন ব্যবস্থাই নিতে হবে যাতে, নারীর হাতে টাকা যায়। বাংলাদেশে সিংহভাগ নারী এখনো গৃহিণী। তাদের হাতে কোনো টাকাই থাকে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুযোগ পেয়ে স্বামীর কাছ থেকে কিছু টাকা চেয়ে জমিয়ে রেখেও তা আবার পরিবারের সংকটে বের করে পরিবারে সহায়তা করেন। অথচ একটা শ্রেণি নারীকে সব সময়ই হেয় প্রতিপন্ন করতে চায়। তারা নারীর জাগরণকে মেনে নিতে চায় না। অথচ সভ্য দেশগুলোতে নারী ও পুরুষ একসঙ্গেই কাজ করছে এবং রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিচ্ছে। কোন সমাজে নারী কতটা মুক্ত এবং কতটা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে- এটাই মূলত নারীবাদ। সাম্প্র্রতিক সময়ে আমরা নারীদের বড় বড় দায়িত্ব পালনের নজির দেখছি। আমেরিকায় তিনজন নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী- মেডিলিন অলব্রাইট, হিলারী ক্লিনটন ও কন্ডোলিৎসা রাইসকে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করতে দেখলাম। এদের মধ্যে বা আগে পরের যে কোনো তিনজন পুরুষ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দক্ষতার তুলনা করতে পারি আমরা। এটা স্পষ্টভাবেই বলা যায়, তিনজন নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গেই তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন। এখানে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়নি। বাংলাদেশে স্পিকার শিরীন শারমিনের কথাও বলতে পারি। তিনি পূর্ববর্তী পুরুষ স্পিকারদের মতোই দক্ষতার সঙ্গে সংসদ চালাচ্ছেন। শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া ও মতিয়া চৌধুরী সফলতা দেখিয়েছেন। নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জেসিকা আরডার্নের তুলনা করতে পারি। তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী তখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গেই সামলান। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থেচারকে বলা হতো আয়রন লেডি। তিনিও অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়ে দায়িত্ব পালন করেন। ভারতের ইন্দিরা গান্ধীকে অনেকে ভারতের শ্রেষ্ঠ প্রধানমন্ত্রীই বলেন। জার্মানির চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মার্কেলের দক্ষতার কথাও বলতে পারি। তিনি টাইম ম্যাগাজিনের পার্সন অব দ্য ইয়ারও হন। তিনি জার্মানিকে আবারো শক্তিশালী অবস্থায় উন্নীত করেন। আস্তে আস্তে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে সমদক্ষতার সঙ্গেই দায়িত্ব পালন করছেন। তবে আমাদের মতো দেশগুলোতে এক শ্রেণির মানুষ নারী ডিসি বা ইউএনওকে অবমূল্যায়ন করতে চায় কেবল পুরুষতান্ত্রিক চেতনা থেকেই। অথচ দেশের প্রাইমারি স্কুলগুলোতে নারী শিক্ষকরাই শিক্ষার মান উন্নয়নে মূল ভূমিকা পালন করছেন। এটা স্পষ্ট যে, নারীদের হেয় করা হয় কেবল পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা থেকেই। এগুলো পেশিশক্তির জোরেই করা হয়েছে। কোনো বৈজ্ঞানিক যুক্তিতেই আমরা নারীদের পুরুষের তুলনায় কম বুদ্ধিমান বলতে পারি না। পিয়ের কুরিদের চেয়ে মেরি কুরিদের দক্ষতা কোনোভাবেই কম নয়। কোভিড-১৯ এর ফাইজারের টিকা আবিষ্কার করেন তুর্কি বংশোদ্ভূত মুসলিম জার্মান দম্পতি উগুর শাহিন ও ওজলেম তুরেসি। এখানে শাহিন বা তুরেসি কেউ কম দক্ষতা দেখাননি। এক্ষেত্রে আমরা সারা গিলবার্টের কথাও বলতে পারি। তিনি কি কোনো পুরুষের চেয়ে কম দক্ষতা দেখিয়েছেন? বাস্তবতা হলো দেশে নিছক পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাই প্রকাশিত হচ্ছে। আমাদের নারীদের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হলে আরও বহু পথই এগোতে হবে।