তথ্য-প্রযুক্তির যুগে নিজেকে বদলে ফেলার এক অন্যতম মাধ্যম অনলাইন পস্ন্যাটফর্ম। অনেক তরুণ-তরুণী অনলাইন ও সোশ্যাল মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে হয়েছেন উদ্যোক্তা। নিজে স্বাবলম্বী হয়ে আয় করছেন লাখ লাখ টাকা। নিজ ও পরিবারের আর্থিক চাহিদা পূরণ করে সঞ্চয় করছেন, বাড়িয়েছেন ব্যবসার পরিধিও। ক্ষুদ্র উদ্যোগকে কাজে লাগিয়ে হয়েছেন সফল উদ্যোক্তা। এমন এক নারী উদ্যোক্তা মুসকান নূর। নিজে সফল হওয়ার পাশাপাশি স্বপ্ন দেখেন উদ্যোক্তা তৈরির। বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তা তৈরির। এতেও সফল তিনি। বলা যায়, নারী উদ্যোক্তা তৈরির 'উদ্যোক্তা' এই মুসকান নূর। ২০১৯ সালে 'লেডিস স্মাইল' নামে ফেসবুক গ্রম্নপ খুলে ভাগ্য খুলেছেন শত শত নারীর। তার এমন সফলতার গল্প লিখেছেন মো. মাসুদ হোসেন।
দুই সন্তানের জননী মুসকান নূর। জন্ম ও শ্বশুরবাড়ি সূত্রে তিনি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ পৌর এলাকার বাসিন্দা। হাজীগঞ্জ পাইলট হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও হাজীগঞ্জ মডেল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে উচ্চতর পড়াশোনার জন্যে চলে যান রাজধানীতে। ঢাকার লালমাটিয়া কলেজে বিবিএ অনার্স ৩য় বর্ষে অধ্যয়নরত অবস্থায় পারিবারিকভাবেই বিয়ে করে ফেলেন। বিয়ের পর যখন ঘরবন্দি হয়ে পড়েন তখনই তার মাথায় ভিড় করে ভিন্ন চিন্তা। সরকারি চাকরির পেছনে অন্যদের মতো না ছুটে নিজে কিছু করবেন এই ভাবনা ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হওয়া মুসকানের। তিনি স্কুলজীবনে থাকতেই একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন সবসময়। ঘরে বসে কিছু করার চিন্তা নিয়ে ২০১৯ সালে অন্তঃসত্ত্বাকালীন ফেসবুকে 'লেডিস স্মাইল' নামে একটা গ্রম্নপ খুলেন তিনি। সেই গ্রম্নপে এখন ২২ হাজারের বেশি সদস্য। নারী উদ্যোক্তাদের পরামর্শ ও সহযোগিতার পাশাপাশি তিনি নিজেও দেশীয় শাড়ি, পাঞ্জাবি ও জুয়েলারি ব্যবসা চালু করেন। করোনাকালীন অনলাইন ব্যবসায় কিছুটা সংযত থাকলেও পরবর্তীতে ডাবের পুডিং, হোম মেইড কেক, আচারসহ বিভিন্ন খাবারের কাজ শিখে শুরু করে দেন এগুলোর ব্যবসাও। মোটামুটি ক্রেতাদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পেয়ে ব্যবসার পরিধি বাড়ানোর চিন্তা মাথায় আসে এই নারী উদ্যোক্তার। তবে যেই ভাবা সেই কাজ। এবারের পরিকল্পনায় ছিল একটু ভিন্নতা। অনলাইনের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক কিছু করার চিন্তা। নয় বছরের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে উপরোক্ত সব ব্যবসার মধ্যে রেস্টুরেন্ট ব্যবসাটাই উত্তম মনে করে ২০২৩ সালে হাজীগঞ্জ পৌর বাস টার্নিমাল এলাকায় চালু করেন 'টেস্টি বাইট রেস্টুরেন্ট এন্ড পার্টি সেন্টার' নামে একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবসা। এখানেও ব্যাপক সাড়া পান এই নারী উদ্যোক্তা মুসকান।
নিজের উদ্যোগের বিষয়ে মুসকান নূর বলেন, 'সমাজের অনেক নারীই উদ্যোক্তা হতে চান, কিন্তু উদ্যোগ থাকলেও সুযোগ হচ্ছে না। আমি তাদের উদ্যোগকে ছড়িয়ে দিতে চাই। এ কারণেই আমার স্বপ্ন নারী উদ্যোক্তা তৈরি করা, যারা সফল হয়ে অবদান রাখবেন দেশের অর্থনীতিতে। পাশাপাশি নিজেও হবো একজন সফল উদ্যোক্তা। বর্তমানে বেকারত্ব বেড়েই চলছে। তবে আমি কিছুটা সফলও হয়েছি। আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টার মাধ্যমে অনেক নারীর আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এটাই আমার কাছে চরম পাওয়া।' উদ্যোক্তা তৈরির স্বপ্ন দেখা এ নারী উদ্যোক্তা বলেন, 'একজন নারী উদ্যোক্তা হওয়ার পাশাপাশি অন্য নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর পরিসরে কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছি। অনেক নারী আছেন যারা কোনো একটি পণ্য ভালো তৈরি করতে পারেন। সেটা নিয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নও দেখেন। এমন ছোট ছোট উদ্যোগ নিয়ে নারীদেরও সহযোগিতা করার চেষ্টা করে থাকি। এ ছাড়া বিভিন্ন হাতের কাজ শেখাসহ মার্কেটিংয়ের উপরও প্রশিক্ষণ নিয়েছি।'
স্বামী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের উৎসাহে এগিয়ে যাওয়া এই নারী উদ্যোক্তা ২০২৪ সালে চালু করেন আরেকটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবসা। হাজীগঞ্জ বাজারে 'ওয়াফেল বেস্ট' নামে ফাস্ট ফুডের নতুন এই ব্যবসা চালু করা মুসকান নূর বলেন, 'নিজের পরিচয় খুঁজেছি। সবসময় চেয়েছি নিজের একটি পরিচয় গড়ে তোলার। পড়াশোনার পাশাপাশি কিছু একটা করার চিন্তা থেকে আমি অন্য ব্যবসার সঙ্গে খাবারের ব্যবসা শুরু করি। নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের কথা চিন্তা করে কম দামে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার বিক্রি করি। আমার তৈরি করা বিভিন্ন ফাস্ট ফুড ও বেকারি আইটেমের চাহিদা বেশি। সে থেকেই এই রেস্টুরেন্ট ও ফাস্ট ফুড ব্যবসাটি প্রাতিষ্ঠানিক হিসেবে নিয়েছি।' শালীনতা বজায় রেখে মায়ের কাছ থেকে নেওয়া ১ লাখ টাকা দিয়ে শুরু করা অনলাইন ব্যবসার পর ঋণ নিয়ে শুরু করা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবসায় মুসকানের এখন পুঁজি প্রায় ৩০ লাখ টাকা। প্রবাসী স্বামীর উৎসাহে দুই সন্তান ও সংসার সামলে সফল এই নারী উদ্যোক্তার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবসাগুলোতে এখন কাজ করছেন ১৫ জন তরুণ-যুবক। বেকার না থেকে তারাও এখন নিজের পরিচয়ে জীবিকা নির্বাহ করে চলছেন স্বাচ্ছন্দ্যে। মুসকান নূর বলেন, স্বামী ব্যতীত তেমন কারো কোনো সাপোর্ট না পেয়ে এতটুকু এসেছি। তবে বাহিরের কিছু মানুষ আমাকে ব্যাপক অপমান করার চেষ্টা করেছে। তাদের বিষয়ে কর্ণপাত না করে আমি আমার জায়গায় অটুট ছিলাম। সে থেকেই আমি নিজে সফল হয়েছি, তেমনি অন্য নারীদেরও সফলতার দ্বারপ্রান্তে নিতে চেষ্টা চালাচ্ছি। অলরেডি প্রায় শতাধিক নারী এখন সফলতার সঙ্গে কাজ করছেন। এমনকি আমার আত্মীয়স্বজনও অনেকে কাজ খুঁজছেন আমার কাছে। এর চেয়ে আর সফলতা কী হতে পারে। সবই সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমত বলে মনে করি আমি। বেকারত্ব দূরীকরণে আগামীতে আরও শাখা-প্রশাখা চালু করার চিন্তা নিয়েই মুসকান নূরের পথচলা।