আলোকিত নারী আমেনা বেগম
প্রকাশ | ২১ মে ২০২৪, ০০:০০
অপূর্ব কুমার কুন্ডু
জীবন বড় অদ্ভুদ! আব্রাহাম লিংকন বিয়ে করেছিলেন উচ্চবিলাসী মেরী ঢউকে অথচ ভালোবেসেছিলেন বিনয়ী এবং দর্জিশিল্পী অ্যান রুটলেজকে। অ্যান রুটলেজের সেলাই নকশা বড় প্রিয় ছিল আব্রাহাম লিংকনের। আইন পেশা শেখা, সর্বোচ্চ ক্ষমতায় পৌঁছে প্রেসিডেন্ট হয়ে দাস ব্যবসা বন্ধ করা, গণতন্ত্রের জনক হওয়া প্রভৃতি ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণায় ছিল হঠাৎ রোগে আক্রান্ত হয়ে চির বিদায় নেওয়া অ্যান রুটলেজ। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ফোর্ড থিয়েটারে আততায়ীর গুলিতে আক্রান্ত আব্রাহাম লিংকনের তাৎক্ষণিক চিকিৎসা হয় এক দর্জির ঘরে রেখে। সেলাই ঘর তো এক অর্থে আব্রাহাম লিংকনের সত্ত্বা-আত্মা এবং কর্মপন্থা। সেলাই তথা এই বন্ধন মানুষের সঙ্গে মানুষের, মানুষের সঙ্গে সমাজের, সমাজের সঙ্গে রাষ্ট্রের, রাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্বের। অনেকটা এভাবেই সেলাই শিল্প বন্ধনে মেয়েদের সঙ্গে আর্থিক উপার্জনের, নকশা বুননে পারিবারিক চৈতন্যের, সাইক্লোন মোকাবিলায় স্বেচ্ছাসেবী দলের সঙ্গে টিম লিডারের সমন্বয়ের, আর্তের সেবায় পথ প্রদর্শকের ময়মিয় কাজটি করে চলেছেন ভোলা জেলার মনপুরা দ্বীপের ফ্যাশন ডিজাইনার, শিক্ষক এবং আলোকিত মানবী আমেনা বেগম।
আমেনা বেগমের পিতা আব্দুল মান্নান চিকিৎসাসেবা দিয়ে শুশ্রূষা করে তুলতেন ভোলা, বোরহান উদ্দীন, তোজুম উদ্দীন, লাল মোহন, চরফেশন, মনপুরা থানার মানুষদের। পিতার সুযোগ্যকন্যা আমেনা বেগম বিনা খরচে সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ দিয়ে, নিজ উদ্যোগে সেলাই সরঞ্জাম সরবরাহ করে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলেছেন এবং তুলে চলেছেন মনপুরা, হাজির হাট, উত্তর সাকুচিয়া, দক্ষিণ সাকুচিয়া, চর কলাতলী ইউনিয়নের মেয়েদের। আমেনা বেগমের এই মহৎকর্মযজ্ঞ নিঃস্বার্থ এবং ধারাবাহিক বলেই বাংলাদেশ সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আয়োজিত আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস-২০১৮'র ১৩ অক্টোবর, মনপুরার শ্রেষ্ট স্বেচ্ছাসেবক টিম লিডার অ্যাওয়ার্ড তুলে দেওয়া হয় এই আমেনা বেগমেরই হাতে। পুরস্কার হাতে নিয়ে আমেনা বেগমের স্বগোতক্তি, 'মানুষের সদাচার এবং চারিত্রিক সদ্ব্যবহার অমূল্য সম্পদ। এই সম্পদের অপচয় করা চলে না। চলাকে চলতে দিতে স্বাবলম্বী হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।'
বিকল্প নেই সেন্টমার্টিন কিংবা ভোলার মতো দ্বীপবাসীদের ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলা না করে সুস্থ সুন্দরভাবে বেঁচে থাকা। ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন তাদের নিত্যসঙ্গী। বাঁচার স্বার্থে এই ঝড় ঝাঞ্চা মোকাবিলা করতেই হয়। ফলে ঝড়কে যেহেতু থামানো যাবে না ফলে আত্মরক্ষা শিখে, লড়াই চালিয়ে জীবনযাপন করাটাই শ্রেয়। ঝড়ের পূর্বাভাসে সতর্ক হয়ে সাইক্লোন সেন্টারে আশ্রয় নেওয়া, ক্ষতিগ্রস্তদের মাছে দ্রম্নত সময়ের মধ্যে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, ওষুধ সরবরাহ করা, ঝড়ে লন্ডভন্ড ঘরকে পুনরায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া প্রভৃতি কার্যক্রমের জন্য দরকার সচেতনতা ও স্বেচ্ছাসেবী হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানো। আর সেই কাজটি নিজে এবং মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে দলবদ্ধভাবে করে চলেছেন আমেনা বেগম। শুধু তো ঝড় মোবাবিলা না বরং অধিকাংশ মৎস্য শিকারিদেরও মনোবল বাড়াতে সব সংকটের মধ্যে দাঁড়িয়ে একজন সমাজকর্মী, আর্তের পাশে দাঁড়িয়ে একজন মানবতাবাদী, বিপন্নতার মুহূর্তে একজন স্বেচ্ছাসেবী আমেনা বেগমের তখন আপনবোধে সাহসী উচ্চারণ, 'জীবন এক যুদ্ধ! এই যুদ্ধ চালিয়ে যেতেই হবে, কেননা সহস্র প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে বিকশিত এবং প্রকাশিত হওয়ার নামই জীবন।'
জীবনের অপর আনন্দ মনপুরার আবুল কাসেম মাতব্বরকে ব্যক্তিজীবনে সফল ও প্রতিষ্ঠিত দুই সন্তানের জননী আমেনা বেগম স্বামী হিসেবে পেয়েছিলেন বলে। কেননা তার স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা। দেশের সংকটকালে যিনি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন তিনি যে দেশ গঠনে ভূমিকা রাখবেন সেটাই তো স্বাভাবিক। ফলে সেলাই প্রশিক্ষণ, স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম, হাঁস-মুরগি পালন প্রভৃতি কর্মসম্পাদনে আমেনা বেগমের পরম নির্ভরতা স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের ডেপুটি কমান্ডার আবুল কাসেম মাতব্বর। ভোলা মনপুরার মানুষের দাবির প্রেক্ষিতে, বৃহত্তর পরিসরে মানুষের উৎকর্ষ বাড়াতে, সংঘটিতভাবে মানুষের কল্যাণে ভূমিকা রাখতে এবারে মনপুরায় মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে দাঁড়াতে হয়েছে আমেনা বেগমকে। তফসিল অনুসারে আগামী ৫ জুন মনপুরায় চতুর্থ ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কলসি প্রতীক নিয়েই এবার তার ভোটের লড়াই। সদা হাস্য-লড়াকু এবং জীবনজয়ী এই মানবতাবাদী আমেনা বেগমের কণ্ঠে সে কারণেই দীপ্ত উচ্চারণ, 'সাইক্লোনে তিন তিন বার ভেঙেছে আমার ঘর। পুনরায় ভাঙা ঘর জুড়েছি, পরিত্যাক্ত হতে দেইনি। দেশ-বিদেশে কর্মসূত্রে গিয়েছি কিন্তু মনপুরা থেকে সরে যাইনি। মনপুরার জলোচ্ছ্বাস নিয়ে চিত্র এঁকেছেন শিল্পাচার্য্য জয়নুল আবেদীন। সিনেমা বানিয়েছেন গিয়াস উদ্দীন সেলিম। আমরা মনপুরাবাসী মনপুরাকে মায়ের সমান ভালোবাসি। মানুষকে ভালোবাসার বন্ধনে বেঁধে, কৃতজ্ঞতার আচ্ছাদনে মনপুরাকে সাজাতে যত বড় দায়িত্বের ভার আসুক না আমার কাঁধে তাকে আমি মাথা নত করেই গ্রহণ করব, কারণ আমরা ভোলা-মনপুরার, ভোলা-মনপুরা আমাদের। ঝড়-ঝঞ্চা মোবাবিলায় এমন যার অমোঘ উচ্চারণ সেই তিনিই তো একটু একটু করে শেষাবধি হয়ে ওঠেন ভোলার আলোকিত মানবী আমেনা বেগম।