চলতি বছরের অন্যতম সেরা সিনেমা 'লাপাতা লেডিস'। একথায় অনেকেই সায় দেবেন। নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়া এই ছবিটি এখন ওটিটি পস্ন্যাটফর্মে দর্শকদের বিনোদনে সবার বিশেষ নজর কেড়েছে। 'লাপাতা লেডিস'-এর গল্প দুই তরুণ বধূর, যারা ট্রেনে করে যাওয়ার সময় হারিয়ে যায়। চলচ্চিত্রটিতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রতিভা রান্টা, নিতানশি গোয়াল, স্পর্শ শ্রীবাস্তব এবং রবি কিষান। 'লাপাতা লেডিস' ছবিটি সমালোচক এবং দর্শক উভয়ের দ্বারাই প্রশংসিত হয়েছে। শুধু ছবির গল্প নয়, ছবিতে অভিনেতাদের অভিনয় ও পরিচালকের পরিচালনাই এর সবচেয়ে বড় শক্তি। ট্রেনের মধ্যে দুই কনের আলাদা হয়ে যাওয়া গল্প নিয়ে তৈরি 'লাপাতা লেডিস'। স্ত্রীদের খুঁজে পেতে পুলিশের কাছে যান দুই স্বামী। প্রথমেই হারানো স্ত্রীর ছবি নিয়ে বিপাকে পড়ে যায় পুলিশও। একজনের ছবিই নেই, অন্যজনের মাথায় লম্বা ঘোমটা। তারপরও দুই নববধূর সন্ধানে নামে পুলিশ। অন্যদিকে সম্পূর্ণ আলাদা জগতে গিয়ে নিজেদের নতুন করে আবিষ্কার করেন গ্রামে বেড়ে ওঠা দুই কনে। এই ছবির পরতে পরতে লুকিয়ে আছে সামাজিক বার্তা, নারীশিক্ষা, পুরুষের একাধিপত্য, নারীর অসহায়ত্ব, যন্ত্রণা ও অসম্মানের কথা। তবে পরিচালক আড়ম্বরহীন, মোলায়েমভাবে ও হাস্যরসের ছোঁয়ায় সেসব কথা ছবিতে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। তাই এই ছবি কোথাও কাঁদাবে, কোথাও হাসাবে, আবার কোথাও ভাবাবে। আর মন ছুঁয়ে যাবে আনকোরা একঝাঁক তরুণ-তরুণীর সরল-সাদাসিধে অভিনয়। হালে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে লাপাত্তা লেডিস ছবিটি। বলিউড তারকা অভিনেতা আমির খান-এর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়া কিরন রাও পরিচালিত এই ছবির বিষয়বস্তু থেকে শুরু করে শিল্পীদের অভিনয়, নির্মাণ কুশলতায় মুগ্ধ দর্শক। সবাই অকুণ্ঠ চিত্তে প্রশংসা করছেন এ ছবির। কিরণ রাওয়ের পরিচালনার ভূয়সী প্রশংসা যেমন হচ্ছে চারিদিকে, তেমনই সাড়া ফেলেছে 'লাপতা লেডিস' ছবির অভিনেতা, অভিনেত্রীরা। এক্কেবারে আনকোরা তিন মুখ, এখন সবার খুব চেনা। 'লাপতা লেডিস' ছবির অন্যতম প্রধান চরিত্র ফুল কুমারী। যিনি বিয়ের পর বরের হাত ধরে শ্বশুরবাড়ির পথে পাড়ি দিতে গিয়ে হারিয়ে যান স্টেশনে। ফুলের চরিত্রে অভিনয় করা নিতাংশির বয়স মাত্র ১৬। তবে এই বয়সেই সোশ্যাল মিডিয়ায় বিখ্যাত তিনি। তার দুর্দান্ত, পরিমিত, যথাযথ অভিনয় দাগ কেটেছে মানুষের মনে। সেই সঙ্গে তার চোখের সারল্য, যার প্রভাব থাকবে বহুদিন। সম্প্রতি নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়ার পর লাপাত্তা লেডিস নিয়ে উন্মাদনা যেন আরও বেড়েছে। সাম্প্র্রতিক হিন্দি ছবিতে থ্রিলার, অ্যাকশন, প্রতিশোধ ড্রামার গুঁতোগুঁতি। সেই ভিড়ে কিরণ রাওয়ের 'লাপতা লেডিস' যেন এক ঝলক টাটকা বাতাস। হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়, বাসু চট্টোপাধ্যায়ের ছবির মধ্যে যে সরলতা থাকত, বহু দিন পর সেই সারল্যের সঙ্গে পরিচয় করালেন কিরণ। জোর করে গিলিয়ে দেওয়া বার্তা নেই, অনাবশ্যক ড্রামা নেই... আছে মন ভালো করে দেওয়া একটা নিটোল গল্প। 'লাপতা লেডিস'-এর মূল কাহিনি কলকাতার বিপস্নব গোস্বামীর লেখা। সিনেমার উপযুক্ত করে বিপস্নবের সঙ্গে এ কাহিনি গড়েপিটে নিয়েছেন দিব্যানিধি শর্মা ও স্নেহা দেশাই। তার সঙ্গে মিশেছে কিরণ রাওয়ের তুলির সূক্ষ্ণ আঁচড়। ছবির স্থান, কাল, পাত্র কাল্পনিক হলেও, চরিত্রের মধ্যকার আবেগ অচেনা নয়। ২০০১ সালের নির্মল প্রদেশ নামের এক এলাকার গল্প 'লাপতা লেডিস', যেখানে নব্য বিবাহিতা তার স্বামীর নাম মুখে আনতে পারে না। শ্বশুরবাড়ি কোথায় সেটাও ঠিকমতো মনে রাখার তাগিদ নেই। বিয়ে হয়ে গিয়েছে মানে সে এখন বরের সম্পত্তি। নিজের আলাদা কোনো অস্তিত্ব থাকতে পারে সেই বোধটাই নেই। দীপকের বিয়ে হয় ফুলের সঙ্গে। ফুলের গ্রাম এতটাই প্রত্যন্ত যে, কোনো রেল স্টেশনও নেই। মাঝপথে ট্রেন দাঁড় করিয়ে তাতে ওঠে পড়াটাই দস্তুর। স্ত্রীকে নিয়ে দীপক রওনা দেয় তাদের সূর্যমুখী গাঁয়ের উদ্দেশ্যে। ট্রেনের কামরায় আরও কয়েক জোড়া নবদম্পতি। সকলের পরনে একই রকমের সু্যট আর শাড়ি। ট্রেন মধ্যরাতে স্টেশনে পৌঁছলে ঘুমচোখে একগলা ঘোমটা দেওয়া বৌকে ডেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় দীপক। বাড়ি পৌঁছে ঘোমটা খুলতেই দেখা যায় বৌ বদলে গেছে। ফুলের বদলে কোনো এক পুষ্পা রানিকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে দীপক। এবার কী হয়? রেল স্টেশনে বরকে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে ফুল। দীপকও স্ত্রীর বিরহে কাতর। পুষ্পার হেলদোল বরং কম। বাড়ি ফেরার কোনো তাগিদ নেই তার। সেটাই বা কেন? এটুকু রহস্য বরং থাক। লাপাত্তা লেডিস ছবির মঞ্জু রাণী চরিত্রটি গ্রামের একটি তরুণীর। গ্রামের রক্ষণশীল পরিবারের মেয়েটির অমতে বিয়ে হলেও সে তার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে রাজি নয়। সে আরও পড়াশোনা করে অরগ্যানিক চাষাবাদ পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চায়। অর্জিত শিক্ষা গ্রামের কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চায়। তার অমতে বিয়ে হলেও ঘটনাচক্রে রেলগাড়িতে চড়ে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পথে অন্য আরেকজনকে স্বামী ভেবে তার সঙ্গে উপস্থিত হয় ভুল জায়গায়। সেখানে যাওয়ার পর বিব্রতকর কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় তাকে। তবে শেষ পর্যন্ত সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে মেয়েটি তার ইচ্ছা পূরণের জন্য উন্নত কৃষি পদ্ধতি ও প্রযুক্তি বিষয়ে পড়াশোনা করতে যাওয়ার সুযোগ পায়। কিরণ প্রধান চরিত্রে আনকোরা মুখ নিয়েছেন। সেটাই ছবির অন্যতম জোরের জায়গা। স্পর্শ, প্রতিভা, নিতাংশী তাদের সারল্যের জোরে ভীষণভাবে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছেন। ছবির সেরা পারফরম্যান্স রবি কিষণের। ধূর্ত, ঘুষখোর পুলিশের চরিত্রে তিনি দুর্দান্ত। মুচমুচে সব সংলাপ তার মুখেই রয়েছে। হিন্দি ছবির দুর্বলতা হল, কিছু চরিত্র আচমকাই ভোল বদলে ফেলে। রবি কিষণের চরিত্রেও মোচড় আছে তবে অতিরঞ্জন নেই। ছবির বাহুল্যবর্জিত ছোট ছোট দৃশ্যগুলোয় সমাজ দর্শন হয়ে যায়। ট্রেনের কামরায় প্রতিযোগিতা চলে কে কত পণ আদায় করতে পেরেছে তার ফিরিস্তি দেওয়ার। যে ছেলে বড় দাঁও মারতে পারেনি, তার নিশ্চয়ই খুঁত আছে। 'লাপতা লেডিস' সোশ্যাল স্যাটায়ার, যেখানে রাজনীতি আছে আবার নারীবাদও আছে। সঙ্গে আছে মিষ্টি প্রেমের গল্প। বলিউডের নারী স্বাধীনতা কিংবা সামাজিক বার্তাবাহী ছবিগুলো যতটা উচ্চকিত হয়, কিরণের ছবি ততটাই মোলায়েম। 'যত বার নতুন সরকার আসে, তত বার আমাদের গ্রামের নাম বদলে যায়', সংলাপের অন্তর্নিহিত খোঁচা স্পষ্ট। মনে থেকে যাওয়ার মতো আরও একটা চরিত্র রেল স্টেশনের চায়ের দোকানি মঞ্জু মাই, যে সহজ করে বুঝিয়ে দেয় পুরুষজাতির 'ভাঁওতাবাজি'তে কেমন করে মেয়ে মানুষেরা ঠকে। দীপকের মা যেমন ভাবতেই পারে না, মেয়েমানুষের নিজের পছন্দের রান্না করাটা কোনো গর্হিত কাজ নয়! এ ছবি উত্তরণেরও। সামাজিক-মানসিক বাধা কাটিয়ে কেউ স্বপ্নপূরণের পথে এগোয়, কেউ নিজের প্রতিভাকে স্বীকৃতি দেয়, কেউ প্রথম রোজগারের স্বাদ পায়। কেউ বা লজ্জার আগল ভেঙে স্বামীর নাম ধরে ডাকতে পারে... কাহিনির মেজাজের সঙ্গে দৃশ্যায়ন, আবহ সব কিছুই সুন্দরভাবে সঙ্গত করেছে। ঢাক পিটিয়ে, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার যুগে সূক্ষ্ণ রসবোধ যেন হারিয়ে গিয়েছে। সংলাপের আস্ফালন না করেও যে কঠিন সত্যি বলে দেওয়া যায়, তা কিরণ রাওয়ের 'লাপতা লেডিস' দেখিয়ে দিয়েছে।