যৌতুক উপহার নয়, ভিক্ষাবৃত্তি
প্রকাশ | ০৭ মে ২০২৪, ০০:০০
কায়ছার উদ্দীন আল-মালেকী
মানুষের মনুষ্যত্ব ও নীতি নৈতিকতা দিন দিন লোপ পাচ্ছে। যার ফলে, মানুষের অধঃপতন ও চারিত্রিক বিপর্যয় ঘটছে। এ বিপর্যয় থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও মানুষের মনুষ্যত্ববোধকে জাগ্রত করা। বিয়ে একটি সামাজিক বন্ধন। এ পবিত্র বন্ধন হচ্ছে- আলস্নাহর হুকুম এবং হযরত মুহম্মদ (সা.)'র সুন্নাত। এ বন্ধন মানুষকে গুনাহ থেকে বিরত রাখে। আলস্নাহর প্রতিটি সৃষ্টি একে অপরের পরিপূরক। বর্তমান সময়ে এ বন্ধন কে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম বানিয়ে ফেলেছে এক ধরনের অসভ্য সমাজ। যৌতুক একটি ঘৃণিত ও পাপিষ্ঠ কাজ। যৌতুক সামাজিক কুপ্রথা ও কুসংস্কার। যৌতুকের অভিশাপে শতশত মা-বোন অকালে মৃতু্যর মুখে পতিত হচ্ছে। এজন্য কোনো ধর্মকে দায়ী করা যাবে না। প্রতিটি ধর্ম শান্তির কথা বলে। বর্তমানে আমরা লেবাসে ধার্মিক; প্রকৃত অর্থে- বকধার্মিক। যৌতুককে ঘিরে প্রতি দিন-রাত ঘটছে নারী নির্যাতন আর নিপীড়নের বীভৎস চিত্র। শারীরিক মানসিক নির্যাতনের বলির পাঁঠা হচ্ছে নারীরা। নারী নির্যাতনের আর্তনাতে কাঁদছে পৃথিবীর আকাশ-বাতাস। যৌতুক হলো- বর পক্ষ দর কষাকষির মাধ্যমে জোরজবরদস্তিভাবে নগদ অর্থ, স্বর্ণালঙ্কার, ফার্নিচার, টিভি, ফ্রিজ, মোটরযান ইত্যাদি মূল্যবান জিনিস পত্র কনে পক্ষ হতে আদায় করার চুক্তি। মানুষ কতটা অমানবিক হলে কনে পক্ষ থেকে টাকা চায়, আমার বুঝে আসে না। এটা সভ্য সমাজের কাজ নয়। একটা মেয়েকে লালন-পালন, পড়াশুনা এবং শিক্ষিত একজন আদর্শবান নারী হিসেবে গড়ে তুলতে একজন বাবা-মায়ের কত পরিশ্রম ও অর্থ ব্যয় হয় তা বলার অবকাশ রাখে না। আর উপযুক্ত করে বিবাহ দিতে গেলে মা-বাবার ওপর নেমে আসে বিশাল টাকার ঋণের বোঝা। যার বাস্তব একটি ঘটনা আমি বর্ণনা করছি, যাতে আপনারা বিষয়টি বুঝতে পারেন। একদিন আমি আর আমার প্রবাসী বন্ধু শাহাবুদ্দিন খান- পল্টন থেকে যাত্রাবাড়ী আসার জন্য এক ভদ্র লোকের রিকশায় উঠি। বঙ্গভবনের মোড় ঘুরতে জিজ্ঞেস করলাম, মামা কেমন আছেন। বললেন, এই তো আছি। পারিবারিক অবস্থা জানতে চাইলাম। বলল, বাবা! মেয়ে বিয়ে দিয়েছি এক মাওলানার সঙ্গে। ১ লাখ টাকা নগদ দিয়েছি। সব মিলে ৩ লাখ টাকা ঋণের বোঝা নিয়ে কোনো মতে জীবন চলছে। এ কথা শুনে অন্ধকার যুগের কথা মনে পড়ে গেল। ইসলাম নারী জাতিকে যতটুকু সম্মানের আসনে সমাসীন করেছেন; পৃথিবীতে আর কোনো ধর্ম নারী জাতিকে এভাবে সম্মানিত করেনি। অনেক ধর্ম নারীকে উলঙ্গ করে রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে; অথচ ছেলেরা পোশাক পরিধান করে শরীর আবৃত করে চলাফেরা করছে। যৌতুক প্রথার প্রধান কারণসমূহের মধ্যে রয়েছে- অর্থলোভ ও সামাজিক দুর্নীতি। ইসলামী শরিয়তে যৌতুকের কোনো অস্তিত্ব নেই; যৌতুক গ্রহীতাকে ইসলাম জালিম হিসেবে সাব্যস্ত করেছে। প্রকৃত অর্থে- বিয়ে হলো একজন নারী ও একজন পুরুষের মধ্যে নিষ্পন্ন বৈধ বন্ধন ও সামাজিক চুক্তি। বৈধ বৈবাহিক বন্ধনকে ইসলাম উৎসাহিত করেছে। একজন ব্যক্তি তখনই বিয়ের বয়সী হবেন; যখন মানসিক, দৈহিক ও আর্থিকভাবে বৈবাহিক জীবন নির্বাহ করতে সমর্থ হবেন। যৌতুক প্রথার প্রাদুর্ভাবের কারণে হাজারো সংসার অকালে ভেঙে যাচ্ছে। কত নারী নিজেদের পরিবারকে বাঁচাতে হাসিমুখে মৃতু্যবরণ করছে, কত নিষ্পাপ শিশু অকালে মা হারাচ্ছে, কত মা-বাবা অকালে মেয়ে হারাচ্ছে তা আসলেই আমাদের ভাবা উচিত, কত নারী নিজের শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করছে, কত নারী গাড়ি বা ট্রেনের নিচে পড়ে স্বেচ্ছায় মৃতু্যবরণ করছে, কত নারী অবুঝ ছেলে সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করছে; এ দৃশ্যগুলো গা শিউরে ওঠার মতো। এ নির্মম দৃশ্যপট প্রতিদিন ভেসে আসছে পত্রপত্রিকার নিউজে ও টিভির পর্দায়। আজ আমরা যৌতুক নিচ্ছি; কাল বোনের কিংবা নিকটাত্মীয়দের বিয়েতে ছেলে পক্ষকে যৌতুক দিচ্ছি। অর্থাৎ, যে-ই লাউ সে কদু। এ বিষয়গুলো আমাদের বিবেক দিয়ে চিন্তা করা দরকার। যৌতুক প্রথা নারী নির্যাতনেরই এক বীভৎস রূপ। মুসলিম সমাজে যৌতুক প্রথার অস্তিত্ব ছিল না। আধুনিকতার নামে এ প্রথাটি ইসলামে সংযোজিত হয়েছে; এটি ইসলামের কলঙ্কময় অধ্যায়। যারা অর্থলোভে পাত্রী গ্রহণ করতে চায়। যারা বছরের বিভিন্ন উৎসবে উপটোকন হিসেবে ভিক্ষা নিতে চায়। আসলেই তারা মুসলমান নামধারী বেইমান। এ রকম ভিক্ষাবৃত্তির স্থান ইসলামে নেই। বরঞ্চ যারা পরের হক নষ্ট করে তারা দুনিয়া ও আখেরাতে লাঞ্ছনার স্বীকার হবে- এটাই ইসলামের বিধান। ঈদ ও কোরবানিতে যারা ফকির মিসকিনের মতো গরু-ছাগলের জন্য হাত পাততে চায়, নগদ টাকা চায়; তারা আসলে জন্মগতভাবে ফকির ও বদমাইশ। এটা তাদের হীনম্মন্যতা নয়, বরঞ্চ মুদ্রাদোষ। যৌতুকের বিরূপ প্রভাবটা মূলত গরিব সমাজের ওপর বেশি প্রভাব বিস্তার করে। এ কারণে এ পরিবারগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও ঋণগ্রস্ত হয়। যৌতুকের জন্য যারা বিবাহ যুদ্ধে নেমে পড়েন। তারা নিশ্চয়ই নির্লজ্জ কাপুরুষ। কারণ তাদের মধ্যে মনুষ্যত্ব লোপ পায় এবং হিংস্রতা বৃদ্ধি পায়। তারা আসলেই মানবরূপী দানব। তারা মানুষের কাতারে পড়ে না। মানুষের মাঝে দানব বা হিংস্র প্রাণীর বৈশিষ্ট্য দৃশ্যমান হলে বুঝতে হবে; এরা নষ্ট জন্মের ফসল। এরা উর্বর মাটিতে বিনা ইনভেস্টে ফসল বুনতে চায়। অথচ এরা স্ত্রীকে সঠিকভাবে দেনমোহর প্রদেয় করে না। স্ত্রীকে ন্যায্য অধিকার দেয় না। ইসলাম, স্ত্রীকে স্বামীর কাছে আমানত হিসেবে ন্যস্ত করেছে; গোলাম বা দাসি হিসেবে নয়। যারা স্ত্রীকে আমানত হিসেবে না দেখে চাকরানি হিসেবে দেখে এরা ইসলামের শত্রম্ন এবং প্রকৃত মুনাফিক। মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনিম্মস্তরে অবস্থান করবে। মামলা-হামলা দিয়ে যৌতুক বন্ধ করা যাবে না। মানুষের শুভ বুদ্ধির উদয় না হলে এবং মনুষ্যত্ব ফিরে না এলে যৌতুক প্রথা বন্ধ হবে না। কবি কাজী নজরুল তার নারী নামক কবিতায় লিখেছেন,
'বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।'
কোনোকালে একা হয়নিকো জয়ী, পুরুষের তরবারি;
প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে, বিজয়ালক্ষ্ণী নারী। নারী সৃষ্টি সৃজনে, মননে শক্তি জোগায়। অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সহায়তা করে। প্রতিটি মানুষের বিজয়ের পেছনে একজন নারীর অবদান থাকে চিরন্তনভাবে। অথচ আমরা এ নারী জাতিকে অসম্মান, অশ্রদ্ধা, অবহেলা, অপমান করে যাচ্ছি। আসুন, আমরা যৌতুক মুক্ত সমাজ গড়ি। যৌতুকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলি। সুন্দর সমাজ বিনির্মাণ করি।