নারী নির্যাতনের বহু ঘটনা ঘটছে এ সমাজে। কিন্তু ঠিক সেভাবে প্রতিকার বা বিচার হচ্ছে না। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে গত বছর সারাদেশে শুধু থানায় ১৮ হাজার ৯৪১টি মামলা হয়েছে। আদালতেও মামলা হয়। নারী নির্যাতনের মামলা নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিদের মতে, থানায় যত মামলা হয় তার প্রায় ১০ শতাংশের সমপরিমাণ হয় আদালতে। ফলে ২০২৩ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে হওয়া মামলার সংখ্যা ২০ হাজারের কম হবে না। ২০ হাজার মামলা একটি সংখ্যা মাত্র। কিন্তু ভুক্তভোগী নারী, তার সন্তান, তার মা-বাবা, তার স্বজনের কাছে নির্যাতনের ক্ষত উপশমযোগ্য নয়। তাদের বেদনা বয়ে বেড়াতে হয়, বিচারের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ফেরে তাদের ভোগান্তি বাড়ে, থেকে যায় আক্ষেপ। এক সময় অনেকে বিচারের আশাও ছেড়ে দেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের মতে, এখন নাগরিকদেরও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরির কাজে নামতে হবে। গত ৩১ মার্চ তিনি বলেন, সরকার নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার। যখন যে ঘটনা ঘটছে, পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে। এখন গণমাধ্যমকেও সচেতনতা সৃষ্টিতে ভূমিকা নিতে হবে। নারী নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হলে তা পুলিশের পরিসংখ্যানে আসে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে-২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৬ থেকে সাড়ে ২২ হাজার মামলা হয়েছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, মামলার সংখ্যা বছরে গড়ে ২০ হাজার। নির্যাতনের ঘটনাগুলো গুরুতর হলে তা গণমাধ্যমে আসে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ গত বছর পত্রিকায় প্রকাশিত খবর ঘেঁটে ৩৫ ধরনের নারী নির্যাতনের তথ্য সংকলিত করেছে। ভুক্তভোগী নারী ও শিশুর সংখ্যা ছিল প্রায় ৩ হাজার। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসের প্রতিটিতে এ সংখ্যা ছিল ২০০ জনের বেশি। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সংকলিত তথ্য বলছে, গত বছর ধর্ষণের শিকার হন ৫৭৪ জন এবং আরও ৩৩ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। স্বামীর হাতে খুন হন ২০৭ জন। আরও ৬৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে যৌতুকের কারণে। একই কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৪২ জন নারী। যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন ১৪২ জন। এসিড মারা হয়েছে ১০ জনকে। নারী নির্যাতনের কথা জানিয়ে জাতীয় জরুরি সেবা-৯৯৯ এ গত বছর তাৎক্ষণিক অভিযোগ এসেছে ২৬ হাজার ৭৯৭টি। অনলাইনেও হয়রানি ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন নারীরা। পুলিশ সাইবার সাপোর্ট সেন্টার ফর উইমেনের (পিসিএসডবিস্নউ) তথ্য অনুসারে, গত ১৫ মাসে অনলাইনে ভুয়া আইডি (পরিচয়) খোলা, আইডি হ্যাক, প্রতারণা, মুঠোফোনে হয়রানি ও আপত্তিকর আধেয় বা কনটেন্ট ছড়ানোর সাড়ে ১২ হাজারের বেশি অভিযোগ এসেছে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন (রিমি) গত ১৮ মার্চ প্রথম আলোকে বলেন, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে তার মন্ত্রণালয় সচেতনতা সৃষ্টি, নারীর ক্ষমতায়ন ও আইনি সহায়তা দেওয়ার কাজ করছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা যথেষ্ট নয়, সেটা ঠিক। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সংকলিত তথ্য বলছে, গত বছর ধর্ষণের শিকার হন ৫৭৪ জন এবং আরও ৩৩ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। স্বামীর হাতে খুন হন ২০৭ জন। আরও ৬৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে যৌতুকের কারণে। একই কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৪২ জন নারী। যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন ১৪২ জন। এসিড মারা হয়েছে ১০ জনকে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অবস্থিত ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে গত ৩১ মার্চ গিয়ে দেখা যায়, সেখানে চারজন ভুক্তভোগী ভর্তি। তাদের মধ্যে একজন নারী (২১) প্রতারণার মাধ্যমে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, পরিচিত এক বাসচালক তাকে গাজীপুর থেকে রংপুরের বাসে তুলে দেওয়ার কথা বলে বাসায় নিয়ে ধর্ষণ করেন। সেদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অবস্থিত ওসিসিতে থাকা আরও দুই তরুণী অভিযোগ করেন, বিয়ের কথা বলে তাদের ধর্ষণ করা হয়েছে। আর এক কিশোরীর মায়ের অভিযোগ, তার মেয়েকে প্রতারণা করে বিয়ে করেছে এক তরুণ। নারী নির্যাতনের উদাহরণ আরও আছে। যেমন ১৮ এপ্রিল বগুড়ার গাবতলী উপজেলায় স্বামীর সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক তরুণী (২১)। স্বামীকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাকে নির্যাতন করা হয়। ১৯৯৬ সালে ফাহমিদা আক্তার ওরফে নাজমার সঙ্গে চিকিৎসক তোজাম্মেল হোসেনের বিয়ে হয়। ২০০৮ সালের ৬ জুলাই ঢাকার মিরপুরে বাসার শৌচাগারে দুর্বৃত্তদের নিয়ে ফাহমিদাকে রগ কেটে, চোখ উপড়ে ও গরম পানি ঢেলে হত্যা করান তোজাম্মেল। ঘটনার ১৮ বছর পর ২০১৪ সালের ৭ জুলাই ঢাকা জেলা দায়রা জজ আদালত তোজাম্মেল হোসেনসহ দু'জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন। ফাহমিদার ভাই জামসেদ গত ৩১ মার্চ প্রথম আলোকে বলেন, কোভিডের সময় আসামিরা জামিন নিয়ে বের হয়ে যান। মামলার শুনানি খুব একটা হচ্ছে না। অনেকটা ঝুলে গেছে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, একমাত্র ভুক্তভোগী ছাড়া এই ভোগান্তি-কষ্ট কেউ বুঝবে না। উচ্চ আদালত সূত্রে পাওয়া গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তথ্য অনুসারে, সারা দেশের ৯৯টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবু্যনালে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৪৩৮টি মামলা বিচারাধীন। পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৪ হাজারের বেশি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমীনের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণ কী। তিনি কয়েকটি বিষয় তুলে ধরেন : এক. ভুক্তভোগী মামলা করার পর মেডিকেল সনদ, ডিএনএ প্রতিবেদন (ধর্ষণের মামলায় আবশ্যক) পেতে দেরি হয়। ফলে তদন্ত ও অভিযোগপত্র গঠনে দেরি হয়। দুই. বিচার শুরুর পর চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় সাক্ষী হাজির করা। তিন. অনেক ক্ষেত্রেই পাবলিক প্রসিকিউটররা রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পান। ভুক্তভোগীর হয়ে মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে অনেকের বিরুদ্ধে অস্বচ্ছতার অভিযোগ থাকে। ২০০৮ সালের ৬ জুলাই ঢাকার মিরপুরে বাসার শৌচাগারে দুর্বৃত্তদের নিয়ে ফাহমিদাকে রগ কেটে, চোখ উপড়ে ও গরম পানি ঢেলে হত্যা করান তোজাম্মেল। ঘটনার ১৮ বছর পর ২০১৪ সালের ৭ জুলাই ঢাকা জেলা দায়রা জজ আদালত তোজাম্মেল হোসেনসহ দু'জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন। তাসলিমা ইয়াসমীন বলেন, বিচারপ্রক্রিয়ার এই দীর্ঘসূত্রতার কারণে 'অপরাধ করেও পার পাওয়া যাবে', এমন ধারণা পোক্ত হয়, অপরাধপ্রবণতা বাড়ে। মামলা দীর্ঘদিন ধরে চালাতে হবে, এমন আশঙ্কায় কোনো কোনো পরিবার সমঝোতায় যেতে বাধ্য হয়। যেমন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবু্যনাল-৭ এ গত ২০ ফেব্রম্নয়ারি গিয়ে জানা যায়, ধর্ষণের শিকার এক কিশোরীকে (১৪) আসামি আনোয়ারুল হকের (৫৫) সঙ্গে বিয়ে দিয়ে মামলায় আপস করার চেষ্টা চলছে। বিচার চলাকালে বিচারক সাবেরা সুলতানা খানম ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ের বিষয়ে আপত্তি জানান। পরে স্বজনরা জানান, ধর্ষণের মামলায় দুই বছর ধরে আসামি কারাগারে। গত বছর কিশোরীটি একটি মেয়েসন্তান প্রসব করেছে। আসামিপক্ষের আইনজীবী মো. ইসমাঈল ভূঁঞা বলেন, আসামি ও মেয়েটির পরিবার বিয়ের মাধ্যমে আপস চাইছে। আপস চাওয়ার কারণ কী, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল মেয়েটির বড় বোনের কাছে। তিনি বলেন, 'আমার বোন খুবই ছোট। ওর ভবিষ্যৎ আছে, পরিবারের সম্মানের বিষয় আছে। দিনের পর দিন মামলা চালানো, বারবার কোর্টে আসা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।' আইন মন্ত্রণালয় 'জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা'র মাধ্যমে দরিদ্র নারী-পুরুষ, শ্রমিক ও কারাবন্দিদের আইনি সহায়তা দেয়। সংস্থার ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রতিবেদন অনুসারে, ওই বছর সারাদেশে ৩২ হাজারের বেশি মামলায় সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তবে সেখানে নারীর জন্য কতটা সহায়তা দেওয়া হয়েছে, তা আলাদা করা নেই। নারী নির্যাতনের ঘটনায় বিচার কতটা হয়, তা জানা যায় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের 'নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রাম (৪র্থ পর্যায়)' প্রকল্পের আওতায় পরিচালিত ১৪টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) থেকে। ওসিসির তথ্য বলছে, গত ২৩ বছরে সেখান থেকে শারীরিক ও যৌন নির্যাতন এবং দগ্ধ হওয়ার ঘটনায় ৬২ হাজারের বেশি নারী ও শিশু সহায়তা পেয়েছে। মামলা হয়েছে মাত্র ১৯ হাজার ৪৪১টি। এর মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ ক্ষেত্রে রায় হয়েছে এবং সাজা কার্যকর হয়েছে ১ শতাংশের কম। বাংলাদেশে ফৌজদারি মামলায় সাজার হার কম। নারী নির্যাতনের ঘটনায় বিচারের হারটি আরও কম। ঢাকা জেলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবু্যনালে ২০০২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত আসা মামলা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সাজা হয় মাত্র ৩ শতাংশ মামলায়। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে মামলার জট কমাতে বিচারপ্রক্রিয়ায় আমূল পরিবর্তন আনা দরকার বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক। তার পরামর্শ, পাবলিক প্রসিকিউটর রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ না দিয়ে ক্যাডার সার্ভিস থেকে ধাপে ধাপে নিয়োগ দিতে হবে। কঠোর সাজার ভয়ে লোকে অপরাধ করবে না- এই ভাবনা থেকে কোনো কোনো অপরাধের শাস্তি বাড়ানো হয় বলে উলেস্নখ করে শাহদীন মালিক বলেন। এর ফলে বিচারকের আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করার হার কমে। কারণ, বিচারক মনে সামান্য সন্দেহ রেখেও বড় সাজা দিতে চান না। দ্রম্নতবিচার নিশ্চিত করতে বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা দরকার। নির্যাতনের ঘটনায় আগেই ব্যবস্থা নিলে যে অনেক বড় সংকট থেকে রক্ষা পাওয়া যায়, সেটা নিজেকে দিয়ে বুঝতে পারছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার মা তাহমিনা বেগম। দীর্ঘ সময় ধরে সহপাঠীর হেনস্তা (বুলিং) শিকার হয়ে গত ১৫ ফেব্রম্নয়ারি আত্মহত্যা করেন অবন্তিকা। গত ৩০ মার্চ তার মায়ের সঙ্গে মুঠোফোনে যতক্ষণ কথা হলো, ততক্ষণই মেয়ের জন্য কাঁদলেন। তিনি বলেন, 'মেয়ে যে বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে, সেটার প্রতিকার চেয়ে দেড় বছর ধরে আইন বিভাগের চেয়ারম্যান ও প্রক্টরের কাছে ঘুরেছি। কোনো ফল পাইনি। সেদিন তারা ব্যবস্থা নিলে আজ আমার মেয়ে বেঁচে থাকত।'