১৯১২ সালের ১৫ অক্টোবর অবিভক্ত ভারতের মধ্য প্রদেশের করদ রাজ্যের রাজনান গ্রামে প্রথম বাঙালি মুসলিম মহিলা চিকিৎসক জোহরা বেগম কাজী জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আব্দুস সাত্তার ও মাতা আঞ্জুমান আরা। তবে বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলার কালকিনি থানার গোপালপুর গ্রামে তার পৈত্রিক নিবাস ছিল। জোহরা বেগম কাজীর ভাই ছিলেন কাজী আশরাফ ও ছোট বোন শিরিন কাজী।
জোহরা বেগম কাজীর রায়পুর বার্জিস মেমোরিয়াল মিশনারি স্কুলে তার লেখাপড়ার হাতে খড়ি। স্কুলে বছর গড়াতেই পুরো বাইবেল মুখস্ত হয়ে যায় জোহরার। হিন্দি হয়ে গেল তার মাতৃভাষা। মিশনারি স্কুলে পড়া এবং ব্রিটিশ সাহেবদের ছেলেমেয়ের সঙ্গে দৌড়ঝাঁপের কারণে জোহরা হলো সাহসী ও সাবলীল এবং ইংরেজি হলো তার প্রথম ভাষা। রায়পুর স্কুল শেষ করে জোহরা ভর্তি হলো আলিগড় দারুল উলুম এংলো মোহামেডান কলেজ। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় ১৯২০ সালে। উত্তর প্রদেশের আলিগড়ে অবস্থানের কারণে অচিরেই উর্দুতে দক্ষ হলো জোহরা কাজী। পড়াশোনায় মেধাবী জোহরা কাজী ১৯২৯ সালে আলীগড় মুসলিম মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন। ১৯৩৫ সালে দিলিস্নর পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত 'লেডি হার্ডিং মেডিকেল কলেজ ফর ওমেন' থেকে প্রথম বাঙালি মুসলিম ছাত্রী হিসেবে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ করে এমবিবিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সে সময় তাকে ভারতবর্ষের ভাইসরয়ের সম্মানজনক ডিগ্রি প্রদান করা হয়। এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করার পর তিনি ডাক্তার হিসেবে প্রবেশ করেন ইয়োথমাল ওমেনস পাবলিক হাসপাতালে। সেখান থেকে পরে বিলাসপুর সরকারি হাসপাতালে যোগ দেন। সে সময় মহাত্মা গান্ধী নির্মিত সেবা গ্রামে অবৈতনিকভাবে জোহরা বেগম কাজী কাজ শুরু করেছিলেন।
গান্ধী পরিবারের ভালোবাসা পেয়েছিলেন মুসলমান ডক্টর আব্দুল সাত্তারের কন্যা ডা. জোহরা বেগম কাজী। তিনি গান্ধী পুত্র রামদাস, দেবদাস, মনিলাল ও হরিলালের সঙ্গে পাশাপাশি বসে আহার গ্রহণ করেছেন। পরিবেশক ছিলেন স্বয়ং গান্ধীপত্নী কস্তরী বাঈ। পরম মাতৃস্নেহে পাশাপাশি বসিয়ে মুসলমান মেয়েকে খাওয়াতে কোনো সমস্যা হয়নি মাতৃরূপী কস্তরী বাঈয়ের। ডা. জোহরা বেগম কাজীর গুজরাটের আহমেদাবাদে গান্ধী সেবাশ্রমে বা মহাত্মা গান্ধীর সান্নিধ্যে যাওয়ার অবাধ অধিকার ছিল। পেয়েছিলেন বাপুজির অকৃত্রিম স্নেহ। ১৯৩৫ সালে এমবিবিএস পরীক্ষার প্রথম হওয়ার কৃতিত্বে তিনি যে ভাইসরয় পুরস্কার পেয়েছিলেন তার সেই পুরস্কারের মেডেল মহাত্মা গান্ধীকে দেখাতে তিনি ভুলেননি। এমবিবিএস পাস করে পদধূলি নেওয়ার সময় বাপুজি এই মুসলমান মেয়েকে আশীর্বাদ করেছিলেন এই বলে, 'জোহরা, জীবনে চলার পথে কখনো ভয় পাবে না। অন্যায়ের কাছে মাথা নত করবে না। মানুষের মতো মানুষ হয়ে বাঁচবে। জীবনের সবচেয়ে বড় মূল্যবান সম্পদ হলো আর্দশ' গান্ধীজীর এই অমোঘ বাণী ডা. জোহরা কাজী সব সময় হৃদয়ে ধারণ করেছেন। জোহরার পিতা আব্দুস সাত্তারের জীবনও বিচিত্র এবং সাহসিকতার ইতিহাসে পূর্ণ ছিল।
মাদারীপুরের কালকিনি থানার গোপালপুরে পৈত্রিক বাসস্থান ছিল তাদের- যা প্রবন্ধের গোড়াতেই আলোচিত হয়েছে। জমিদারতুল্য বিত্তবৈভবের মালিক ছিলেন আব্দুস সাত্তারের পিতা জমির উদ্দিন। তিনি স্থির করলেন ১০ বছর বয়সে কোরআন মুখস্থ করে হাফেজ হওয়া তার সন্তান সাত্তারকে বড় মৌলানা বানাবেন আলী ভাতৃদ্বয়ের মতো। তাই তিনি সমগ্র ভারতের সর্বোচ্চ মাদ্রাসা শিক্ষার পাদপিঠ দেওবন্ধে ছেলেকে ভর্তি করার মনোনিবেশ করেন। দেওবন্ধের পরিবেশ ছিল তখন দুর্ভাগ্যবশত শ্বাসরুদ্ধকর। শিক্ষকদের অমানবিক ব্যবহারে দারুল উলুম মাদ্রাসা বালক সাত্তারের কাছে অসহনীয় হয়ে উঠল। বিদ্রোহ করে পালিয়ে এসে বিত্তবান পিতা জমির উদ্দিনের অমতে ঢাকা ফিরে সদর ঘাটে অবস্থিত প্রগোজ স্কুলে ভর্তি হলেন আব্দুস সাত্তার। তিনি পরবর্তী সময়ে ১৮৯৫ সালে মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুল থেকে এলএমএফ (লাইসেন সিয়েট ইন মেডিকেল ফ্যাকাল্টি) পাস করেন। আরও পরে কলকাতার কলেজ অব ফিজিয়ানস্ অ্যান্ড সার্জন থেকে পাস করে সার্জনস্ অব ইন্ডিয়া (এমবিবিএস সমতুল্য) সনদ প্রাপ্ত হন। ১৯০৯ সালে মধ্যপ্রদেশের করদ রাজ্য রাজনান গাঁও ব্রিটিশ শ'ওয়ালেস কটন মিলে চিকিৎসক হিসেবে চাকরি নেন। সাহেব পাড়ায় ছিল তার ডাক্তারের বাসস্থান। তিনি সবর্দাই হাতিতে চড়ে গিয়ে রাজবাড়ির অন্তপুরের চিকিৎসা দিতেন। শুক্রবার মসজিদে জু'মার নামাজের ইমামতি করতেন। শার্ট প্যান্ট পড়ে বিকালে টেনিস খেলতেন এবং সন্ধ্যার পর ক্লাবে গিয়ে সাহেবদের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিতেন। তার সুনাম সে সময় ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে ভালো মানব দরদি একজন স্বনামধন্য চিকিৎসক হিসেবে। ছেলেমেয়ের লেখাপড়ায় সাধাসিধে তার মা আঞ্জুমান আরার অবদান কম নয়। মেয়েদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য তিনি নিজে রায়পুর থেকে বি.এ পাস করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি রায়পুর পৌরসভার কমিশনারও নির্বাচিত হন।
এমবিবিএস পাসের কিছুদিনের মধ্যে বৃত্তি নিয়ে ডা. জোহরা বেগম কাজী লন্ডনে চলে যান উচ্চশিক্ষার জন্য। লন্ডনের 'রয়েল কলেজ অবস টেট্রিকস অ্যান্ড গাইনো কোলজিস্ট' থেকে ডিআরসি ও জি ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে এসে গাইনোকোলজিস্ট ডা. জোহরা বেগম কাজী পূর্বের ন্যায় ছুটে যান গান্ধীজির পদধূলি নেওয়ার জন্য। গান্ধী তাকে প্রাণঢালা আশীর্বাদ করেন।
ডা. সুশীলা নায়ার স্বাধীন ভারতের প্রধান স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন লেডি হার্ডিঞ্জ মেডিকেল কলেজে জোহরার সতীর্থ এবং এমবিবিএস পরীক্ষায় তিনি হয়েছিলেন দ্বিতীয়। প্রথম হয়েছিলেন জোহরা বেগম কাজী। সুশিলা সব সময় গান্ধী পরিবারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বাপুজির চিকিৎসক হিসেবে। ডা. সুশীলা নায়ার নেহেরু মন্ত্রী সভার প্রথম স্বাস্থ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চলে আসেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যোগ দেন। তারই প্রচেষ্টায় সেখানে স্ত্রীরোগ ও ধাত্রী বিদ্যা বিভাগ খোলা হয়। তিনিই প্রথম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মহিলাদের পৃথকভাবে চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
গাইনোকোলজি বিভাগের প্রধান ও অনারারি প্রফেসর হিসেবে তিনি মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করেন। অবসর সময়ে তিনি সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ঢাকায় অনারারি কর্নেল হিসেবেও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭৩ সালে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে কনসালট্যান্ট হিসেবে সেবা প্রদান করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের অনারারির অধ্যাপক হিসেবেও কাজ করেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন।
তিনি একমাত্র নারী যিনি ইংল্যান্ড থেকে অনারারি এমআইসিইওজি ডিগ্রি পেয়েছেন। পাকিস্তান সরকার ১৯৬৪ সালে তাকে তমঘা-ই-পাকিস্তান খেতাবে ভূষিত করেন। মানবতার সেবায় নিঃস্বার্থ আত্মনিয়োগের স্বীকৃতিস্বরূপ ডা. জোহরা বেগম কাজীকে বেগম রোকেয়া পদক (২০০২ খ্রি.) এবং একুশে পদক মরণোত্তর (২০০৮ খ্রি.) প্রদান করা হয়। ২০০৭ সালের ৭ নভেম্বর মানবতার সেবায় নিবেদিত মহৎপ্রাণ এই মহীয়সী নারী মৃতু্যবরণ করেন। মৃতু্যকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর (১৯১২-২০০৭ খ্রি.)।