নারীর নিজের সংগ্রাম
প্রকাশ | ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
মালেকা বেগম
পৃথিবী, প্রকৃতি, পরিবেশ, মানুষ ও মানবসভ্যতা আজ বিপন্ন। পশু, পাখি, জমি, কৃষি, শিল্প, ব্যবসা ও বাণিজ্য- সবকিছুই বিপন্ন। এসব বিপন্নতার কারণ প্রাকৃতিক, ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সন্ত্রাস, যুদ্ধ ইত্যাদি।
কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নারী যখন বিপন্ন হচ্ছে, তখন বিশ্লেষণে জানা যায়, 'নারী' বলেই সে বিপন্ন। নারী নিপীড়ন বিভিন্ন ধরনের। কিন্তু সব নিপীড়নেরই কারণ একটি: লিঙ্গ পরিচয়ে সে নারী। তাই নির্যাতিত। প্রচলিত সামাজিক বিশ্বাস ও কুসংস্কার নারীকে লিঙ্গীয় গন্ডিতে আবদ্ধ রেখে প্রমাণ করতে চায়, নারী মানুষ নয়। নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা 'লিঙ্গ'গত হলেও পুরোপুরি সমাজ আরোপিত। সমাজ পরিবর্তনের জন্য নারীর সংগ্রাম তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
রাজনীতিজ্ঞ, রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী, অর্থনীতিবিদ, প্রশাসনিক, ব্যবসায়ী, অধ্যাপক, শিক্ষক, সাংবাদিক, সংগীতশিল্পী, চলচ্চিত্রশিল্পী, চিত্রশিল্পী, লেখক, গবেষক, চিকিৎসক, স্থপতি ইত্যাদি আরও বহু পরিচয়ে বাংলাদেশের নারীরা আজ সম্মানিত হচ্ছেন। অন্যদিকে জানা-অজানা বহু ধরনের নিপীড়নে নারীসমাজ ব্যাপকভাবে বিপন্ন। বাংলাদেশে নারী ও শিশু ধর্ষণ, নির্যাতনের ভয়াবহ অপরাধ নারীর মানবাধিকার অর্জনের পথে হুমকি হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের নারীর বহু সাফল্যের ইতিহাসের পাশাপাশি শোনা যাচ্ছে বিপন্ন নারীদের আর্তনাদ। বাংলাদেশের নারীসমাজের অধিকার আন্দোলন বা সংগ্রাম চলেছে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে এবং নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে।
১৯৭০ থেকে সারা পৃথিবীতে নারীসমাজের অধিকার আন্দোলন দানা বেঁধেছে নারীর সার্বিক বিপন্নতার কারণগুলো দূর করার জন্য। জাতিসংঘের উদ্যোগে পৃথিবীজুড়ে বিশ্ব নারী সংহতির লক্ষ্যে দেশে দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব নারীবর্ষ (১৯৭০), বিশ্ব নারী দশক (১৯৭৫, ১৯৮৫, ১৯৯৫)। এই উদ্যোগ চলেছে অব্যাহতভাবে।
নারীর অধিকার, মানবাধিকার ও নারী মুক্তির লক্ষ্যে চলেছে বাংলাদেশের নারী সংগ্রাম। বিশ্ব নারী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ পরিচালিত বিশ্ব নারী সম্মেলনে (১৯৯৫, বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত) নারী আন্দোলন, সংগঠনের প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের সম্মতিতে গৃহীত ১২টি ইসু্যকে ভিত্তি করে পরিচালিত হচ্ছে নারী আন্দোলন-সংগঠনের সংগ্রাম।
আলোচ্য ১২টি ইসু্য হচ্ছে : শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, দারিদ্র্য, সহিংসতা, মানবাধিকার, পরিবেশ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারী-পুরুষের সমতা, প্রচারমাধ্যম, তথ্যপ্রযুক্তি, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য রাষ্ট্রীয় আইন, অর্থায়ন ও প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ।
একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকেও (২০১৯) বাংলাদেশের নারী নিপীড়িত হচ্ছে 'নারী' হিসেবেই। কিন্তু নারী নিপীড়নের জন্য পুরুষসমাজকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানো নারী আন্দোলনের লক্ষ্য নয়। নারী নির্যাতক বা নিপীড়কের চেহারাটা পুরুষের হলেও পুরুষসমাজকে নারী নির্যাতনের জন্য দায়ী করা হয় না। রক্ষণশীল পুরুষ-আধিপত্য, পিতৃতান্ত্রিক-পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাও সমাজকাঠামো-রাষ্ট্রব্যবস্থা-আইন-দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি নারী নির্যাতনের জন্য দায়ী। পুরুষ ও নারীর মিলিত প্রগতিশীল পদক্ষেপ পরিবর্তন করতে পারে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতা। সেই পথেই নারীসমাজের বিপন্নতা দূর হতে পারে।
বাংলাদেশের নারী আন্দোলন-সংগ্রামের অবিসংবাদী নেত্রী রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২) বলেছেন, 'আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কিরূপে? কোন ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে, সে খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ এবং নারীর স্বার্থ ভিন্ন নহে- একই। জগতের যে সকল সমাজের পুরুষেরা সঙ্গিনীসহ অগ্রসর হইতেছেন, তাঁহারা উন্নতির চরমসীমায় উপনীত হইতে চলিয়াছেন। আমাদের উচিত যে, তাহাদের সংসারের এক গুরুতর বোঝাবিশেষ না হইয়া আমরা সহচরী সহকর্মিনী সহধর্মিণী ইত্যাদি হইয়া তাহাদের সহায়তা করি।'
পরিবার, সমাজ ও ব্যক্তি, প্রশাসন ও রাষ্ট্র যেন অচলায়তনের মতো নারীর জীবনের বিকাশ, আনন্দ ও প্রগতির বাধা হয়ে আছে একুশ শতকেও। প্রগতিবাদীরা নারীর সার্বিক বিকাশের জন্য শিক্ষা, জীবিকা, সংস্কৃতিচর্চা, সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চালাচ্ছেন। মানবাধিকার অর্জনের আন্দোলনে নারী-পুরুষের সমঅংশগ্রহণের সংগ্রাম চলেছে। কিন্তু আশানুরূপ নারীবৈষম্য-নিপীড়ন বন্ধ হচ্ছে না।
নতুন নতুন সংকটে-সমস্যায় নারীর জীবন জর্জরিত ও বিপন্ন হচ্ছে : নারী তুমি কেন কালো? পাত্রপক্ষ কেন তোমাকে পছন্দ করে না? তোমাকে লেখাপড়া শিখিয়ে টাকা খরচ করেছি, তবু কেন বিয়েতে যৌতুক দিতে হবে? স্বামীকে কেন বশে রাখতে পার না? স্বামী কেন আনন্দ খুঁজতে পরনারীতে আকর্ষিত হয়? শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদ পরিজনদের মন জুগিয়ে চল না কেন? সন্তান হয় না কেন? ছেলেসন্তানের জন্ম দিতে পারছ না কেন? কন্যাভ্রূণ হত্যা করতে চাচ্ছ না কেন? শিক্ষিত-ডিগ্রিধারী হয়েও কেন চাকরি পাচ্ছ না? পথে-ঘাটে নিরাপত্তার জন্য তোমার সঙ্গে পাহারাদার লাগে কেন? তোমাকে ছেলেরা কেন উত্ত্যক্ত করে?
পথে-ঘাটে-স্কুলে-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে-অফিসে-আদালতে-ট্রেনে-বাসে-লঞ্চে-বিমানে আলাদা টয়লেট, আলাদা আসন, বিশেষ বিশেষ ব্যবস্থা নারীর জন্য কেন করতে হবে? অন্তঃসত্ত্বাকালীন বিশেষ কয়েক মাস সবেতন ছুটি কর্মজীবী নারীদের কেন দিতে হবে?
কর্মক্ষেত্রে সন্তান রক্ষণাবেক্ষণকেন্দ্রের বিশেষ ব্যবস্থা কেন করতে হবে? নারী তুমি যদি শ্রমজীবী-পেশাজীবী-কর্মজীবী হলেই, তবে পুরুষের তুলনায় অন্য বিশেষ ব্যবস্থা তোমাকে কেন দিতে হবে? নাজুক শক্তি-মেধা-বুদ্ধি সত্ত্বেও নারী তুমি পুরুষের সমান বেতন-মজুরি দাবি কর কেন?
ঘরের বাইরে কাজ করছ, আয়রোজগার করছ, তাই ঘরের কাজ একা করবে না। পরিবারের পুরুষেরও করতে হবে বলে দাবি করছ কেন? সংসারে, কর্মক্ষেত্রে, রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে ভূমিকা রাখতে চাচ্ছ কোন সাহসে?
পারিবারিক আইনে স্বামীর সমান অধিকার চাও কেন নারী? কেন পুরুষ ও পুরুষতান্ত্রিকতার ক্ষমতার রাজত্বে নারী হয়ে সমান অংশীদার হতে চাচ্ছ নারী? পৈতৃক সম্পত্তিতে ভাইয়ের সমান অংশ দাবি করছ কীভাবে? বৈধব্য বা বার্ধক্যের সময় পরিবারের সন্তানেরা বিমুখ হলে রাষ্ট্রের সাহায্য দাবি কর কেন?- প্রতিনিয়ত এ রকম হাজার হাজার প্রশ্নে নারীদের জর্জরিত হতে হচ্ছে। নারীকে প্রতিনিয়ত এ ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। নারীর সংগ্রাম বিষয়ে রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সরোজিনী নাইডু, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, শামসুন্নাহার মাহমুদ, সুফিয়া কামাল প্রমুখ লিখেছেন, আলোকপাত করেছেন, নারীর মুক্তির পথ দেখিয়েছেন, নারী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
সাম্প্রতিককালেও বহু অর্থনীতিবিদ, সমাজতাত্ত্বিক, অধ্যাপক, আইনজ্ঞ, সাংসদ- সবাই নারী আন্দোলনের সমর্থনে ও নেতৃত্বে যুক্ত থাকছেন। নারী নির্যাতনের নির্মম নিষ্পেষণে সমাজে, পরিবারে, আদালতে, সালিসি সভায় নারীকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। ধর্ষণের মামলায় সাক্ষী আনার জন্য বলা হয় (যে ঘটনায় ধর্ষিত নারীই একমাত্র সাক্ষী), পারিবারিক নির্যাতনের বিষয়েও সাক্ষী আনতে বলা হয় (শ্বশুরবাড়িতে নির্যাতিত বধূ সাক্ষী পাবেন কীভাবে?)। বৈষম্য, শোষণ ও নির্যাতনের জাঁতাকলে বিপন্ন নির্যাতিত নারীকে প্রতিনিয়ত হারিয়ে যেতে হচ্ছে পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্রীয় তথ্য থেকে।
বাংলাদেশের নারী ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়ী হয়েছেন, ১৯৬০-এর দশক থেকে ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলনে, রাজনৈতিক স্বাধিকার আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন- এ সবকিছুই নারীর সংগ্রামকে ইতিবাচক পথে এগিয়ে দিয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা মুক্তিযোদ্ধা নারীকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্যাতনে নারীদের জীবন মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ও পরে দুর্বিষহ হয়েছে। তারাও মুক্তিযোদ্ধা, এই যুদ্ধে রেখেছেন অনন্য অবদান। এসবও তো নারীরই সংগ্রাম।
মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা ও অবদান বিষয়ে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বীকৃতি আদায়ের সংগ্রাম নারীসমাজ শুরু করেছে ১৯৭২ সাল থেকে। সেই সংগ্রাম এখনো অব্যাহত। মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান বিষয়ে নারী-পুরুষ লেখক, কবি-গবেষকের গবেষণা, গল্প, কবিতা, উপন্যাস রচিত হচ্ছে। সেসব গবেষণা ও সাহিত্যকর্মের মধ্যেও 'নারীর সংগ্রাম' গুরুত্বের সঙ্গে লিপিবদ্ধ হয়ে চলেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আহ্বান জানিয়েছিলেন জনগণকে নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবাইকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ একাত্তরে নারীসমাজ যেভাবে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে, সেই কাহিনির বিবরণ ও তথ্যাদি এখনো সম্পূর্ণভাবে জানা যায়নি।
নারীসংগ্রাম এখনো নারীর মুক্তিযুদ্ধ হিসেবেই চলছে প্রতিনিয়ত প্রতি ঘরে ঘরে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কর্মস্থলে, পথে-ঘাটে- সর্বত্র।
নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে নারীর সংগ্রাম চলছে। আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-আইনগত-পরিবেশগত সার্বিক পশ্চাৎপদ অবস্থান এবং সেসব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্যের নিরসনকল্পে চলেছে নারীর ক্ষমতায়নের সংগ্রাম। নারীর অবমূল্যায়নের পরিবর্তন চাওয়ার জন্য চলেছে নারীর সংগ্রাম। দরিদ্রতম নারীর অধিকার দাবি এবং অবস্থাপন্ন নারীর অধিকার দাবির মধ্যে মৌলিক অনেক পার্থক্য আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও 'নারীর সংগ্রাম' সব স্তরের নারীসমাজকে একই প্রতিবাদে, মিছিলে শরিক করেছে। 'নারী' হিসেবে লাঞ্ছিত হচ্ছেন সব বিত্তের নারী। সেই লাঞ্ছনার অবসান ঘটানোর জন্য 'নারী মানবাধিকার' প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই চলেছে নারীর সংগ্রাম।