পরিবার ও সমাজে হঠাৎ নারী নির্যাতন বেড়ে গেছে- এমন কথা দেশের সচেতন মহলে প্রায়ই উচ্চারিত হচ্ছে। দেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা যে মাত্রায় বেড়েছে কিংবা বেড়েছে জনসংখ্যা ও অন্যান্য অপরাধ, ঘুষ-দুর্নীতি ঠিক সে মাত্রায় কি নারী নির্যাতন বেড়েছে? এ প্রশ্ন করলে অনেকেই এটাকে অযৌক্তিক হাস্যকর ভাবতে পারেন। অন্ধের হাতি দেখার সঙ্গেও কেউ কেউ তুলনা করতে পারেন। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুষ-দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে, দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভয়াবহ খারাপ। চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই, জোরপূর্বক চাঁদা আদায়, টেন্ডারবাজি, জবরদখল ইত্যাদির মাত্রা যদি সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে না কমে তাহলে নারী নির্যাতন কীভাবে কমবে। দেশে যদি ৩ কোটির ওপর বেকার থাকে এবং এদের বিপুল অংশ যদি বিপথগামী হয় তবে দেশব্যাপী নারী নির্যাতনের এরাও অংশীদার।
যে কোনো নারীকেই তার পারিবারিক ও সামাজিক গন্ডি এঁকে দেয় পুরুষ। পুরুষের স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটলে নারীকে বিপথগামী, কূলটা বলে আখ্যা দেওয়া হয়। যে কোনো মুহূর্তে তার ওপর নেমে আসে অত্যাচার-নির্যাতনের খড়গ। পুরুষ বরাবরই নারীকে ভোগ্যবস্তু ও সেবা দাসী হিসেবে দেখে আসছে। যে সমাজ বা রাষ্ট্রে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন নেই- সেখানে নারী নিরাপত্তা, জননিরাপত্তা বিঘ্নিত তো হবেই- এটাই স্বাভাবিক। আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং তার মাধ্যমে সঠিক শাস্তির বিধান নিশ্চিত করা গেলে সমাজ থেকে নারী নির্যাতনের ভয়াবহতা কমে আসবে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে, যেখানে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত রয়েছে সেখানে নারী নির্যাতনের ভয়াবহতা একেবারেই কম। সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক ভগ্নদশা, দেশব্যাপী মাদকের ভয়াবহ বিস্তার, বেকারত্ব, শ্বশুর বাড়ির অর্থবিত্তে একশ্রেণির পুরুষের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লোভ, একশ্রেণির নারীর শরীর প্রদর্শনের মাধ্যমে বেপরোয়া চলাফেরা ইত্যাদি কারণে সমাজে নারী নির্যাতন বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গেছে। অন্যান্য সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অনুষঙ্গসমূহের ব্যাপারে উদাসীন থেকে বা এর প্রতিকারে এগিয়ে না এসে কেবল নারী অবমাননা, নির্যাতনের শিকার বলে গলা ফাটালে কোনো কাজ হবে না।
\হমনে রাখতে হবে, নারী মুক্তিতে বাধা শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধ, সামাজিক নিয়মনীতি, প্রথা পদ্ধতি, কুসংষ্কার ও অলীক বিশ্বাস। আর এ বাধা দূর করতে হবে রাষ্ট্র তথা সরকারকেই। বিবাহপ্রথা চালু হওয়ার আগে সমাজ স্বীকৃতভাবে নারী এককভাবে কারো অধীনে ছিল না। অর্থ ও ক্ষমতার দাপটে যে নারীকে জয় অথবা করতলগত করতে পারত সেই ভোগ করত। এ ছাড়াও যে বা যারা নারীর মন হরণ করতে পারত সে নারী তারই হতো। তখন নারী ক্ষেত্রবিশেষে শৃঙ্খলিত থাকলেও তার কদর ছিল। অত্যাচার-নির্যাতনের এমন ব্যাপকতা ছিল না।
যখন সবাই মিলে এক নারীকে ভোগ করত, তখন নারী দলিত হতো; কিন্তু অত্যাচারিত হতো কম। নারী কার অধীনে ও অধিকারে থাকবে তা নিশ্চিত ও স্পষ্ট করার জন্য বিয়ে প্রথা চালু করা হলো। ফলে নারী নির্দিষ্ট হয়ে গেল যে, সে শুধু একজনের। একজনই তাকে ভোগ করতে পারবে। নারী এই ধারণার বাইরে যেতে পারবে না। আর গেলেই তার বিপদ।
বিয়ের কাবিন হচ্ছে সম্ভোগের দাসস্বরূপ আর্থিক মূল্যের দলিল। দেনমোহরের পুরো টাকা বা অর্ধেক শোধ করার পরই স্ত্রী বা নারীর প্রতি বৈধ ভোগ-দখল প্রতিষ্ঠিত হয়। কেবল তাই নয়, যে পুরুষ তাকে বিয়ে করে, সে তাকে খাওয়া-পরা, পোশাক-আশাক ও দামি অলঙ্কারে আবৃত করার ফলে তার মধ্যে এ মানসিকতা প্রতিষ্ঠিত হয় যে তোমাকে আমি সব দিয়েছি, তুমি আমার কথার বাইরে চলতে পারবে না। যে পরিবারে বা সমাজে এর ব্যত্যয় ঘটেছে, সেখানেই নেমে এসেছে অবমাননা-নির্যাতন। আজো যে নারী নির্যাতনকেন্দ্রিক ভয়াবহতা আমরা পরিবার ও সমাজে প্রত্যক্ষ করি, এটা ওই মানসিকতারই ফল। বিয়ে করে একজন নারীকে ঘরে আনলেই, খাওয়ালে পরালেই কেবল তাকে শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করার অধিকার জন্মাবে এ মানসিকতা সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। একইভাবে যে অসহায় পুরুষ স্ত্রীর অর্থবিত্তের ওপর চলে, নিজে বেকার বা অকর্মণ্য কিন্তু স্ত্রী রোজগেরে ওই সব পুরুষও ভয়াবহভাবে মানসিক, এমনকি শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে, সামাজিক প্রতিপত্তি, অর্থবিত্তের দাপটের কারণেই বেশিরভাগ সময় নারী নির্যাতিত হচ্ছে, নির্যাতিত হচ্ছে পুরুষও।
\হগ্রামীণ দরিদ্র সমাজের কন্যাদায়গ্রস্ত আর্থিকভাবে অসচ্ছল পিতা তার মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার সময় যৌতুকের টাকা অর্ধেক পরিশোধ করে এবং বাকি অর্ধেক পরিশোধের প্রতিশ্রম্নতি রক্ষায় ব্যর্থ হলে মেয়ের ওপর নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন। স্বামী-দেবর, শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদ সবাই তাকে পিটিয়ে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয় অথবা আগুনে পুড়িয়ে মারে। এই বিপজ্জনক মধ্যযুগীয় বর্বর প্রবণতা ইদানীং মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যেও ঢুকে পড়েছে। এটা কেবল হচ্ছে অর্থের কারণে। আর এর পেছনে কাজ করছে লোভী মানসিকতা। তবে বিয়ে প্রথা চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অনগ্রসর সমাজে এমন পরিস্থিতি ছিল না। বিশেষ করে মাতৃতান্ত্রিক সমাজে এটা নেই। এখনো পৃথিবীর কোথাও কোথাও বিশেষ করে আদিবাসীদের মধ্যে মাতৃতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বিয়ে প্রথা চালু হওয়ার পর যে সমাজে নারী বেশি ছিল সে সমাজে একজন পুরুষ বহুবিয়ে করত, আবার যে সমাজে পুরুষ বেশি ছিল সে সমাজে সবাই মিলে এক নারীকে বিয়ে করত। অর্থাৎ এক নারীর বহু স্বামী গ্রহণে বাধা ছিল না। কিন্নর সমাজে এখনো সব ভাই মিলে একটি বধূকেই ঘরে আনে। ফলে ওই নারীর কদর বেড়ে যায়। নির্যাতিত হওয়ার সুযোগই থাকে না।
সভ্যতার ক্রমবিকাশের ফলে শিক্ষার বিস্তার ঘটার কারণে শাস্ত্রীয় ও ধর্মীয় বিধিনিষেধের কারণে, সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য, সুশৃঙ্খল পরিবার গঠনের নিমিত্তে এক বিয়ে পদ্ধতি চালু হলো। যদিও মুসলিম সমাজে স্ত্রীর অনুমতিক্রমে একাধিক বিয়ে করা যায়। তবে বর্তমানে কোনো নারীই চায় না তার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী থাকুক। ফলে দ্বিতীয় বিয়ের সম্মতি না দেওয়ার কারণেই একাধিক নারীতে আসক্ত পুরুষরা নিজের স্বাধীন ইচ্ছে বা অপকর্মের স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য প্রথম স্ত্রীকে নির্যাতন ও হত্যা করে। পতিপরায়ণ নারী চায় না তার স্বামীর ওপর কেউ ভোগ-দখল করুক। একইভাবে কোনো পুরুষ চায় না তার স্ত্রী পরপুরুষের আসক্ত হোক, কিংবা হোক ব্যভিচারী। এই না চাওয়ার কারণেই পরিবারে ও সমাজে নির্যাতন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পারিবারিক নির্যাতনের যে ভয়াবহরূপ এটা তারই ফল। অবশ্য আফ্রিকার সোয়াজিল্যান্ডের রাজার রয়েছে ২৩ রানী। রাজা বলে কথা।
নারী শিক্ষিত হলে, অর্থনৈতিকভাবে নিজের পায়ে দাঁড়ালে একমাত্র সন্তান প্রত্যাশা ছাড়া তাকে সংসার করার বিশেষ প্রয়োজনীয়তা নেই। এই সমাজে হাজার হাজার নারী রয়েছেন যাদের বিয়ে হয়নি বা করেনি। তারা কি বেঁচে নেই। নারীর স্বাবলম্বীর জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন কারিগরি শিক্ষা। নারীকে প্রশিক্ষণ ও প্রেরণা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের, সমাজসেবীদের এবং রাজনৈতিক দলগুলোর। অথচ তারা এ কাজে বরাবরই উদাসীন।
\হমনে রাখতে হবে ভবিষ্যৎ সুখ স্বপ্নের কথা চিন্তা করে লাখ লাখ টাকা খরচ করে স্বামী নামক পুরুষের হাতে নিজের আদরের কন্যাকে সম্প্রদান করা হলো, এ সমাজে তার জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। স্বামীসুখ পাওয়ার পরিবর্তে লাশ হয়ে ফিরে আসার সম্ভাবনাই তার বেশি। একশ্রেণির পুরুষের অর্থবিত্তের প্রতি সীমাহীন লোভ এবং একশ্রেণির তরুণের বেকারত্বের অভিশাপও এর জন্য কম দায়ী নয়। উচ্চাভিলাষী ও লোভী নারী-পুরুষ মাত্রই পরিবার ও সমাজে ক্ষতিকর। এদের মধ্যে মানবতাবোধ জাগ্রত করা সম্ভব হলে পারিবারিক ও সামাজিক সুস্থতা অনেকটাই ফিরে আসবে। নির্যাতনের এমন ভয়াবহতা থাকবে না।
কোনো মানুষ শিক্ষিত নয়, কিন্তু মানবিক ও বিবেক-বিবেচনা বোধ তার মধ্যে রয়েছে, যুক্তি মানে ও বুঝে। মানুষের দুঃখ-শোকে কাতর হন যিনি, সহমর্মিতা যার মধ্যে জাগ্রত হয় তিনি তো নির্যাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন না। বিবেকবোধ ও মানবিক সব নারী-পুরুষের মধ্যে জাগ্রত হলে নির্যাতনকেন্দ্রিক পারিবারিক ও সামাজিক চিত্র পাল্টে যাবে। তবে তার আগে দরকার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অনিয়ম, অনাচার, ঘুষ, দুর্নীতি বন্ধ করা। গণতন্ত্র ও আইনের শাসন সর্বত্র প্রতিষ্ঠা করা। দেশব্যাপী শিক্ষার বিস্তার ঘটানো। দারিদ্র্যবিমোচনে ও বেকারত্ব দূরীকরণে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া। সবকিছু যদি সঠিক ও সমান্তরালভাবে চলে তবে সমাজ ও রাষ্ট্রও সঠিকভাবে চলবে। আর প্রতিদিন পারিবারিক নির্যাতনের ভয়াবহতা আমাদের প্রত্যক্ষ করা লাগবে না। এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সুনিয়ন্ত্রিত ও সুশৃঙ্খল সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। এটা যতদিন না হবে ততদিন পর্যন্ত নারী নির্যাতনের মাত্রা ও ভয়াবহতা কমবে না। আর এর জন্য সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, প্রতিবাদ সভা-পথসভার মাধ্যমে চিৎকার করেও কোনো ফল হবে না।