বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ কার্তিক ১৪৩১

নারীর উজ্জ্বল দিক

ুশামীম আরা
  ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
নারীর উজ্জ্বল দিক

বর্তমান যুগে দাঁড়িয়ে যখন পেছনে তাকাই তখন ভাবতে অবাক লাগে। হঁ্যা, আমি নারীর চলমান ইতিহাসের কথাই বলছি। নারীকে ঘিরে বর্তমান সময় খুব অস্থির, ব্যস্ত, বিস্ফোরণোন্মুখও বলা যায়। নারীর অস্তিত্বকে মূল্যায়ন করতে যুগের পর যুগ কেটে গেছে। নারীর অন্তঃপুরবাসিনী চিত্র অতিক্রম করে বর্তমান কর্মমুখরও শিল্প বিপস্নবে নিবেদিত যে পরিচিতি, তার পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের বেদনা লাঞ্ছিত ইতিহাস। বর্তমান সময়টা আমরা ইন্টারনেট, মোবাইল, ফেসবুক ও নানা যান্ত্রিক অগ্রগতির সহায়ক শক্তির সঙ্গে অভ্যস্ত। কিন্তু তার সঙ্গে বিপরীত চিত্রও রয়েছে। একদিকে নারীর বিজয়গাথা রচনা করে তারা এভারেস্ট বিজয়ী হয়েছেন, শিল্পোন্নয়নে বিস্ময়কর দক্ষতার সাহায্যে দেশের অর্থনীতিকে পুষ্ট করেছেন। অন্যদিকে, নারী নির্যাতন ও অবমাননার চিত্রও সমাজকে থেকে থেকে চমকে দেয়। তখন মনে পড়ে ফেলে আসা সুদীর্ঘ ইতিহাস। জীবনের বিশাল পশ্চাৎপট থেকে আমরা পেছনের অশ্রম্নলাঞ্ছিত নারী জীবনের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়াই। আজকের নারীসমাজ জীবনের এক অপরিহার্য শক্তি- কিন্তু অতীতে নারীর বিদ্রোহ, নারী দিবস ছিল অপরিচিত, অষ্টাদশ ঊনবিশ শতকেও তারা অন্তঃপুরে অলঙ্কৃত করতেন, সন্তান উৎপাদন ও সংসার পরিচালনা করতেন। ঘরনির ভূমিকাই ছিল তাদের জন্য নির্দিষ্ট। ধর্মীয় এবং সামাজিক বিধিনিষেধের ভয়াবহ অপপ্রয়োগে মেয়েদের জীবনকে জেনানা ফাটকে পরিণত করেছিলেন। কথাটা মর্মান্তিক হলেও কঠোরভাবে সত্য। অতীত গৌরব স্মরণ করতে গিয়ে আমরা চাঁদ সুলতানা, সম্রাজ্ঞী নূরজাহান, কবি জেবুন্নেসা ও সুলতানা রাজিয়ার কথা অহঙ্কারের সঙ্গেই উলেস্নখ করি। সাধারণ সমাজের নারী বা সাধারণ মানুষের অবস্থানগত পরিবর্তনের কোনো আভাস এ থেকে পাওয়া যায় না। এ ছাড়া একেকটি যুগ তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পটভূমির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের অবস্থানকে বদলে দেয়, যেমন দিয়েছিল এ দেশে বিদেশিদের আগমন এবং ঔপনিবেশিক পীড়ন। দীর্ঘ ২০০ বছরের পরাধীন জীবন, ধর্মীয় গোঁড়ামি, শিক্ষার অভাব এবং কুসংস্কার সব সমাজকে অধিকার করেছিল। এক জটিল বদ্ধ পরিবেশে পরদেশি শাসন ও ভাষার চাপ সত্ত্বেও, শত বছরের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষ বিস্ময়করভাবে বাংলা ভাষার চর্চাকে ধরে রেখেছিল। তার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ অব্যাহতভাবে মাতৃভাষাকেই গতিশীল করে তুলেছে।

ইংরেজ শাসনামলে মুসলিমরা এক হতাশাগ্রস্ত জাতি হিসেবে পরিণত হয়। ইংরেজ শাসনের ইতিহাস এ দেশের মুসলমানদের প্রতি বৈরিতার কারণে প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থা ও ব্যক্তির অবমাননা, ফারসি ভাষার পরিবর্তনে মুসলমানদের জাতিগত আত্মাভিমানে কঠিন আঘাত লাগে। মুসলিম আমলে বিদ্যাশিক্ষা পরিচালনা, মাদ্রাসা, মসজিদ রক্ষণাবেক্ষণ শাসকরা প্রচুর ভূসম্পত্তি দান করতেন, যা ছিল করবিহীন। ইংরেজ সরকার এসব লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। ফলে শত শত মুসলমান পরিবার ও প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে, শিক্ষা নারীদের প্রচেষ্টায় শিক্ষাব্যবস্থার বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুর মিশন থেকে হযরত মুহম্মদের (সা.) প্রতি কটাক্ষ করে লেখা প্রকাশিত হয়। ফলে মুসলমানরা সংঘবদ্ধ হয়ে মিশনারি শিক্ষার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। ব্রিটিশ সরকার ১৮৫৪ সালে শিক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন করার জন্য প্রস্তুতি নেয়। ১৮৫৪-৫৬ সালে শিক্ষাবিষয়ক ডিরেক্টরেট প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু এ যুগান্তকারী ব্যবস্থার সুযোগ মুসলমানরা নিতে পারেননি বা নেননি। ধর্মান্ধতা, আশরাফ-আতরাফের ভেদজ্ঞান ও ইংরেজের বৈরিতার মধ্য দিয়ে মুসলমান সমাজ পিছিয়ে গেলেও তৎকালীন হিন্দু সমাজ এ সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে উন্নত শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য গুছিয়ে নেয়। কাজেই বুদ্ধিবৃত্তির চর্চার সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থায় মুসলমান সমাজের অগ্রগতি ছিল পশ্চাৎপদ ও অনিশ্চিত। তবে সেই সঙ্গে ধীরে হলেও এক সময় সমাজের বিরাট অংশ নারী শিক্ষার প্রতি সচেতন হয়ে ওঠে। নানা ধরনের স্থবিরতা সত্ত্বেও হিন্দু সমাজে একটু একটু করে সচেতনতা লক্ষ্য করা যায়। ১৮৪৯ সালের ৭ মে কলকাতায় হিন্দু ফিমেল স্কুল প্রতিষ্ঠা হয়। ফলে নারী শিক্ষার একটা ধারা সৃষ্টি হয়। সেকালের বিদ্বজ্জন কেশবচন্দ্র সেন, রাজা রামমোহন রায়, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ স্ত্রী শিক্ষায় উৎসাহিত হন। তৈরি হয় 'বামা হিতৈষিণী সভা'। স্ত্রী শিক্ষার ক্ষেত্রে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, সংবাদ প্রভাকর ও বামাবোধিনী সে সময়ে বিশেষ অবদান রাখে। অন্যদিকে, দেরিতে হলেও মুসলমান সমাজেও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। নওয়াব আবদুল লতিফ তরুণদের শিক্ষা ও আধুনিকতায় যুগের সঙ্গে তালমিলিয়ে চলার জন্য 'মোহমেডান লিটারারি সোসাইটি' গড়ে তোলেন। তারই চেষ্টায় ১৮৫৪ সালে কলকাতা মাদ্রাসায় ফারসি বিভাগ প্রবর্তিত হয়। সব ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র বিশেষত মুসলিম ছাত্রদের ইংরেজি শিক্ষার সুবিধার জন্য হিন্দু কলেজ প্রেসিডেন্সি কলেজে রূপান্তরিত হয় (অ ংযড়ৎঃ ধপপড়হঃ ড়ভ সু ঢ়ঁনষরপ ষরভব : চ-১২, অ খধঃববভ)। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এসে যে ক'জন শিক্ষিতা সমাজসেবীর কথা উলেস্নখ করতে হয় ধীরে ধীরে নারীর জীবনে আসে আত্মাবিষ্কারের আকাঙ্ক্ষা তারা হলেন কুমিলস্নার নওয়াব ফয়জুন্নেসা, বেগম রোকেয়ার বড় বোন করিমুন্নেসা খানম, দিনাজপুরের বোদা নিবাসী বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী তাহিরুন্নিসা ও শাহাজাদপুরের লতিফুন্নেসা। তাহিরুন্নিসা ছিলেন প্রথম মুসলিম মহিলা গদ্য রচয়িতা। ১৮৬৫ সালে ফেব্রম্নয়ারি-মার্চ সংখ্যা বামাবোধিনী পত্রিকায় নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে লেখা এ রচনাটির মধ্যে একটা বলিষ্ঠতা, স্পষ্ট ভাষণ ও আড়ষ্টতাবিহীন প্রকাশ ভঙ্গি পাওয়া যায়। এ কৃতিত্ব তুলনাহীন। কিন্তু ইতিহাসকে বিচার করলে দেখা যায়, ঘন অন্ধকারের মধ্যে একাধিকবার এরকম বিরল প্রতিভার সন্ধান পাওয়া গেছে। হাজী মুহাম্মদ মুহসীনের বোন জমিদার মন্নুজান তার বিশাল সম্পদকে শিক্ষা বিকাশের জন্যই তার ভাইয়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ১৮৭৩ সালে কুমিলস্নার নওয়াব ফয়জুন্নেসা কুমিলস্নায় একটি উন্নত বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন- যার খ্যাতি ও ধারাবাহিকতা এখনো অক্ষুণ্ন আছে। নওয়াব ফয়জুন্নেসার জীবন ছিল ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতার প্রতীক। তার প্রবর্তিত শিক্ষাকেন্দ্রিক কর্মকান্ডে উৎসাহিত একদল বিদ্বান যুবক ১৮৮২ সালে ঢাকায় গড়ে তোলেন 'মুসলমান সুহৃদ সম্মিলনী'। তারা অতিযত্নে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের পাঠ্যতালিকা নির্বাচন করে নারী শিক্ষা পদ্ধতিকে বিশেষভাবে গতিশীল করেন। ওই সময়ে কলকাতায় বেথুন স্কুলে মুসলমান মেয়েদের ভর্তিকে বাধাগ্রস্ত করা হয়। ফলে আলাদা করে বিদ্যালয় গড়ে তোলার প্রয়োজন দেখা দেয়।

১৮৯৬ সালে লতিফুন্নেসা কলকাতা ক্যাম্পবেল মেডিকেল স্কুল থেকে ৫০ জন বালক ও বালিকার মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৮৯৭ সালে বামাবোধিনী পত্রিকায় (৩৮৯ সংখ্যা জুন ১৮৯৭) তিনি একটি কবিতা লেখেন- যার শিরোনাম ছিল, 'বঙ্গীয় মুসলমান মহিলার প্রতি'। এভাবেই নারীর বুদ্ধিবৃত্তিক আত্মপ্রকাশ শুরু।

নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর কথা এ ক্ষেত্রে প্রথমেই আসে কারণ তিনি শক্ত হাতে দক্ষতার সঙ্গে জমিদারি পরিচালনা করে গেছেন। সেই সঙ্গে স্ত্রী শিক্ষার জন্য মেয়েদের ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠা, জেনানা হাসপাতাল ও আরও অসংখ্য জনহিতকর কাজ করে গেছেন। ব্রিটিশ সরকার তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে নওয়াব উপাধিতে ভূষিত করেন। তা ছাড়া তার আত্মজীবনীমূলক কাব্য রূপ জালাল প্রকাশিত হয় ১৮৭৬ সালে। সে সময়ের পথিকৃৎ গিরীন্দ্র মোহিনী দাসী (১৮৫৫-১৯২৪), কামিনী রায় এবং মানকুমারী বসুরও আগে।

পরবর্তী সময়ে সমাজ কাঠামোর সময়ের অনিবার্য প্রয়োজনে পরিবর্তন দেখা দেয়। দীর্ঘ সময়ের অবহেলা এবং অপচয়ের শেষে বাংলার মুসলমান সমাজের কর্মিষ্ঠ সমাজ সংগঠকরা এগিয়ে আসেন। মৌলভী আবদুল আজিজ বিএ, মৌলভী আবদুর রহিম, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, ফজলুর রহমান, কাজী ইমদাদুল হক প্রমুখ প্রগতিশীল মানুষ এগিয়ে আসেন স্ত্রী শিক্ষা ও মুক্তির আহ্বানে। ফলে ১৯০১ সালে আদমশুমারিতে দেখা যায় '৪০০ মুসলিম মহিলা ইংরেজি শিক্ষা লাভ করেছেন' (মিহির ও সুধাকর)। এর পেছনে কাজ করেছে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল (১৯১১) ও তার জীবনব্যাপী সংগ্রাম। বেগম রোকেয়ার সমগ্র প্রয়াস ছিল অজ্ঞানতা থেকে নারীকে মুক্তি দেয়ার জন্য। জীবন যেন একটি শতাব্দীকে দিয়েছে শিক্ষা, দিয়েছে সমাজ পরিবর্তনের প্রবল আগ্রহ ও শক্তি, বিজ্ঞানমনস্কতা এবং সাহস। তারপর নিরবচ্ছিন্ন অগ্রযাত্রায় নারী গড়েছে ইতিহাস। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে নারী ক্রমেই আত্মজাগরণের পথ খুঁজে পায়। বাঙালি মুসলমান মেয়েদের মধ্যে প্রথম বিএ এবং এমএ পাস করেন ফজিলাতুন্নেসা, তার পর পর আসেন অধ্যাপিকা খোদেজা খাতুন, লীলা নাগ, ডক্টর ফাতেমা সাদেক, ডক্টর নীলিমা ইব্রাহিম, ডক্টর বেগম আখতার ইমাম, জেবুন্নেসা রহমান, অধ্যাপিকা হামিদা খানম, ডক্টর হোসনে আরা, অধ্যক্ষা জেবুন্নেসা রহমান, বেগম আনোয়ারা মনসুর, মহিলা ডিডিপিআই বেগম আজিজুন্নেসা, অধ্যক্ষা হাসনা বেগম প্রমুখ। এসব বিদুষী মহিলা সে সময়ের সামাজিক পরিবর্তনের বিপুল অবদান রাখেন। বিংশ শতাব্দী নারীর সর্বাঙ্গীণ অগ্রগতিকে যে রূপে গড়ে দিয়েছে, তারা এক এক দশকে ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে বিজ্ঞানচর্চায় তাদের ওপর ন্যস্ত প্রতিটি দায়িত্ব পালন করে নিজেদের অবস্থানকে চিহ্নিত করে গেছেন। চলিস্নশ ও পঞ্চাশের দশকে বিজ্ঞানচর্চায় অধ্যাপিকা মালেকা আলরাজী, অধ্যাপিকা কামরুন নাহার ইসলাম, অধ্যাপিকা রহমত আরার নাম উলেস্নখ করতেই হয়। সত্য কথা বললে বলতে হয়, একটি বৃহৎ সময়কালের পূর্ণ তালিকা তৈরি করা অত্যন্ত দুরূহ এবং সময়সাপেক্ষ। তবুও এখানে যতটা সম্ভব শিক্ষার ক্ষেত্রে দেশের ও জাতির অগ্রযাত্রায় যাদের অসামান্য অবদানে এ দেশ ধন্য, তাদের নাম অবশ্যই স্মরণ করতে হবে।

বেগম রোকেয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করে এ দেশের নারী যে বহু বিচিত্র জীবন কর্মে নিয়োজিত হন, তার মধ্যে সাহিত্য জগতের কথাটি মনে রাখা প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে শিক্ষা ও সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, নূরুন্নেসা খাতুন বিদ্যাবিনোদিনী ও সারা তাইফুরের নাম উলেস্নখ করা প্রয়োজন। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত সাহিত্য সংস্কৃতি, সমাজকে তারাই সমুন্নত রেখে গেছেন ও পথ দেখিয়ে দিয়েছেন উত্তর প্রজন্মকে। তারা একাধারে শিক্ষাব্রতী ও সমাজসেবী। এ থেকে তারা প্রতিষ্ঠা করেছেন কর্মযোগ ও জীবন চেতনা। এ সময়ে রাজনীতি ক্ষেত্রেও নারীর অংশগ্রহণ সূচিত হয়। দুটি বিশ্বযুদ্ধের ফলে এ দেশের চিন্তাচেতনায় প্রগতিশীলতার চর্চা গতি পায়।

ইতিহাস পরিক্রমায় লক্ষ্য করা যায়, ১৯৩৮ সালে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় মিসেস হাসিনা মুর্শেদ ও মিসেস ফরহাদ বানু আসন লাভ করেন। ১৯৩৯ সালে ঢাকায় প্রথম মুসলমান মহিলারা প্রকাশ্যে ঈদের নামাজ আদায় করেন বেগম সারা তৈফুরের নেতৃত্বে। ১৯৪১ সালে ব্রিটিশ সরকার তাকে 'কাইসার-এ-হিন্দ' সার্টিফিকেট ও মেডেল প্রদান করে সম্মাননা দেয়। বুদ্ধিবৃত্তিক সাধনার ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানদের সম্পাদিত আজিজন নেসা, নবনূর, মিহির, সুধাকর, সমাচার দর্পণ প্রভৃতি পত্রিকার নাম উলেস্নখযোগ্য। এরই মাঝখানে ১৩২৮ সালে প্রকাশিত হয় সুফিয়া খাতুন সম্পাদিত প্রথম মুসলিম মহিলা মাসিক পত্রিকা আন্নেসা। ১৩৪৪ সালে বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ ও হাবীবুলস্নাহ বাহার যুগ্ম সম্পাদনায় প্রকাশ করেন 'বুলবুল' পত্রিকা। মুসলমান মহিলা সম্পাদিত প্রথম বার্ষিক সাহিত্য পত্রিকা, 'বর্ষবাণী' ও 'রূপরেখা'। প্রকাশ করেন জাহানারা বেগম চৌধুরানী। তারপরে নূরজাহান বেগম ও সুফিয়া কামাল সম্পাদিত 'বেগম' পত্রিকার প্রকাশ ঘটে ১৯৪৭ সালে। সেই সঙ্গে আমরা পাই সাংবাদিক হুসনা বানু খানমকে। বিংশ শতাব্দীর কালানুক্রমে বিশ্ব সভ্যতায় দুটি বিশ্বযুদ্ধ এসে তোলপাড় করে দিয়ে গেছে মানুষের চিন্তাজগৎকে। মানুষের চিন্তাচেতনার জগতে এসেছে বিপুল পরিবর্তন। মানবজীবন পদ্ধতিকে ধারণ করে সাহিত্য, বিজ্ঞান এবং জীবনধারাও বারবার গতি পরিবর্তন করেছে। তারই অংশীদার হয়েছে এ দেশের মানুষ- নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। সাহিত্য জগতে আমরা তারও গতিময় বিকাশ প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হয়েছি।

বিশ্বযুদ্ধের প্রবল প্রভাব যেমন পৃথিবীর সব দেশের জীবনচর্চাকে ওলট-পালট করে দেয়, আমাদের দেশও তার অন্যতম। ১৯৪৮-এর ভারতবর্ষ বিভাজিত হয়। মানুষের ধ্যান-ধারণা, দেশপ্রেম সবই বিচিত্ররূপে প্রকাশ পায়। এ দেশে, জনজীবনে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন সৃষ্টি করে ভিন্ন চেতনা, ভিন্ন রাজনৈতিক চিন্তা। কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক জীবনে নানা পরিবর্তন নিয়ে আসে। মানুষ বিশ্বের অন্যান্য দেশের চিন্তাভাবনা সম্পর্কে পরিচিত হয়। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে আরও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে যায় জীবন যাত্রায়। আন্তর্জাতিক বলয়ে প্রবেশ করে স্বাধীন বাংলাদেশ, এভাবেই একটি জাতির পরিচয় চিহ্নিত হয়ে সে মাথা তুলে দাঁড়ায়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আমরা তার অংশীদার। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় খুঁজে পাই ভিন্নরূপ ভিন্ন সত্তার স্বাধীন নারীর পরিচয়। মানুষ ও ইতিহাস সর্বদা চলিষ্ণু। বাধাগ্রস্ত স্থবিরতার প্রাচীর সরিয়ে নারী যেভাবে বিশ্ব সমাজে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করেছে, তা আমাদের জন্য গৌরব ও আনন্দের। আমরা যেন সেই শিকড়ের পরিচয় কখনো ভুলে না যাই। ইতিহাসের কাছে এসে দাঁড়ানো আমাদের সেই কথাটাই মনে করিয়ে দেয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে