উৎসব আয়োজন সেটা ঈদ হোক, পূজা পার্বণ হোক কিংবা পহেলা বৈশাখের মতো কোনো জাতীয় দিবস; উৎসব মানেই অফুরন্ত আনন্দ। উৎসবকে কীভাবে উদযাপন করা হবে এই ভেবে মাসখানেক আগে থেকে সবার কত শত পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি থাকে, তাই না! তবে যে কোনো আয়োজনেই পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের ভূমিকা ও সম্পৃক্ততা কিন্তু ভিন্নরকম থাকে। নির্দিষ্ট একটা বয়স পর্যন্ত উৎসব উদযাপনের মানসিক উপযোগ থাকে শতভাগ। ছকবিহীন, বাধাহীন। কিন্তু সেই সময়টা পার হয়ে গেলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উৎসব মানে শুধুই ব্যস্ততা। খেয়াল করুন তো, আপনি যখন উৎসবের বিকালে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে বেড়িয়েছেন তখন আপনার মাকে কিংবা পরিবারের অন্য নারী সদস্যদের কী করতে দেখেছেন? উৎসবের দিনগুলো কীভাবে কাটে নারীদের! একটু ভাবুন তো আপনারা নিজেদের বাড়িতেই কী দেখে বড় হয়েছেন? আচ্ছা আমিই একটুখানি বলছি। উৎসবের আগের দিন গভীর রাত অব্দি, আবার কখনো কখনো দুই-তিনদিন আগে থেকে মা খালারা রান্না নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। হরেক পদের রান্না ছাড়াও হয়তো আমাদের উৎসব আয়োজন সম্পন্ন হতো কিন্তু তাতে কারও মন ভরে না! সবার মন রাখার দায়িত্ব নিজ কাঁধে টেনে নেওয়ার অসীম ধৈর্য নিয়ে নারীরা জন্মেছেন। এছাড়া উৎসবকেন্দ্রিক ঘর ঝাড়া, মোছা, ধোয়াধোয়ি আর কেনাকাটার দায়িত্ব তো থাকেই নারীর ওপরে। এই সবকিছু গুছিয়ে আনার পর বলুন তো উৎসবের দিন তারা কী করেন! ক্লান্তিতে শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দেন, তাও বেশি সময়ের জন্য না- কারণ; বাসায় আগত অতিথিদের আপ্যায়ন করাতে হবে তো! এবার বলুন, মিলে গেল না আমার কথাগুলো! সংসারে নারীদের শ্রমসাধ্য এই সাংসারিক কর্মকান্ড জীবনাচরণের অংশ হিসেবে হয়তো স্বাভাবিক তবে পরিণত এ সময়ে এসে এখন মনে হয় উৎসবটা আমাদের মায়েদের জন্যও সমান আনন্দের হওয়া উচিত। সংসারে নারীদের শ্রমসাধ্য এই সাংসারিক কর্মকান্ড জীবনাচরণের অংশ হিসেবে হয়তো স্বাভাবিক- তবে পরিণত এ সময়ে এসে এখন মনে হয় উৎসবটা আমাদের মায়েদের জন্যও সমান আনন্দের হওয়া উচিত। তাদের দরকার ছিল সব কাজ থেকে মুক্তি পাওয়া ফুরফুরে একটি দিন। ভিন্নভাবে চিন্তা করলে আবার এটাও ভাবা যায় পারিবারিক এসব কাজকর্মের মধ্যেই হয়তো তারা উদযাপনের আনন্দ উপভোগ করে থাকেন। তাইতো উৎসব উদযাপন ছাড়াও হঠাৎ বেড়াতে আসা কোনো অতিথিকে ঘরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রেখে রান্নাঘরে গিয়ে পঞ্চাশ ব্যঞ্জন রাঁধতেও প্রশান্তিতে তাদের সব ক্লান্তি উবে যায়। অথচ নানান পদের রান্নাবান্নায় নিজেকে নিয়োজিত করে সময়টা নষ্ট না করলে বেশ জমিয়ে গল্প ও আড্ডা দিয়ে সময়টা উপভোগ করতে পারতেন! পারতেন কিন্তু সেটা তারা করবেন কেন! এটাই অতিথিপরায়ণতা বা বাঙালির আপ্যায়নের সংস্কৃতি। যে সংস্কৃতির ভাঁজে ভাঁজে প্রকটতর বাধ্যবাধকতা আছে- যা খালি চোখে দেখা যায় না। নারীকে অবদমন ও আধিপত্যের সেই সংস্কৃতির বাইরে যাওয়া কিংবা প্রতিবাদ করার কোনো উপায় আসলে নারীর হাতে নেই। আসলেই কি নেই? নাকি অভ্যস্ততা! প্রথা ভেঙে নিজেকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করার শক্তি খুব কম নারীরই থাকে। জীবনের সঙ্গে জড়িত প্রতিটা বিষয় আসলে শিখে পড়েই অর্জন করতে হয়। আমার মাঝে মাঝেই মনে হয় বাঙালি নারীরা কখনোই আনন্দ উদযাপন করতে শেখেনি, নিজেকে সুখী করতে শেখেনি, ভালোবেসে নিজেকে উপহার দিতে শেখেনি। নারীর উৎসব তাই পরিণত হয়েছে কর্তব্যনিষ্ঠায়। যাই হোক, কথা হচ্ছে উৎসব নিয়ে। উৎসব মানেই প্রাণের উৎস। উৎসব মানে প্রিয়জনের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ। আর এতেই প্রতিটা মানুষ সারাবছর কাজ করার প্রাণশক্তি সঞ্চয় করে। বাঙালি নারীরা কখনোই আনন্দ উদযাপন করতে শেখেনি, নিজেকে সুখী করতে শেখেনি, ভালোবেসে নিজেকে উপহার দিতে শেখেনি। নারীর উৎসব তাই পরিণত হয়েছে কর্তব্যনিষ্ঠায়। জীবনের তাগিদে গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তরিত মানুষ উৎসব আয়োজনে ছুটে যায় গ্রামে। কিন্তু শহুরে মানুষ কোথায় যাবে যাদের অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, যাদের শেকড় শহরে! কোনো বিশেষ দিনে কী করব, কোথায় যাব করতে করতে শেষ পর্যন্ত ভাবনার জগতে শুধু রেস্টুরেন্ট উঁকি দেয়। বিনোদন ক্ষেত্রের কী তীব্র ক্রাইসিস! বিষয়টা এমন হয়েছে উৎসব আয়োজনে পারিবারিক, কমিউনিটি মিটআপ কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানোর পরিকল্পনা অবধারিতভাবে গিয়ে দাঁড়ায় রেস্টুরেন্টে। খাবারকেন্দ্রিক বিনোদন ছাড়া শহরবাসীর জন্য নির্মল কোনো বিনোদন একেবারেই নেই। সেইসঙ্গে ঘরের বাইরে উৎসব আয়োজন এখনো নারীবান্ধব না অথবা এভাবে বলা যায় নারীর জন্য দেশ এখনো অবারিত হতে পারেনি। সমাজ দেশেরই তো ক্ষুদ্র অংশ। সেই সমাজে উৎসব মানে নারীর কার্যক্রম হবে সকাল থেকে রাত অব্দি আয়োজন বাস্তবায়নের ভূমিকায় নিবেদিত প্রাণ থাকা। সারা বাংলাদেশের গ্রাম, মফস্বল ও জেলা শহরের চিত্র এটাই। আমার বলয়ের মধ্যে খুব কম নারীকেই দেখেছি নিজের বাবা-মা ও ভাইবোনের সঙ্গে উৎসব পালন করতে সেটা ধর্মীয় হোক কিংবা জাতীয় ঐতিহ্যবাহী কোনো উৎসব। গ্রামগঞ্জে ধর্মীয় উৎসবের চেয়ে মেলা জাতীয় উৎসবে নাইওর প্রথা সামাজিক সংস্কৃতি হিসেবে গড়ে উঠেছে। অর্থাৎ তাদের বিশেষ উৎসবে নারী তার জন্মস্থানে আমন্ত্রিত হয়। এ সময়ে নারী মুক্ত বিহঙ্গ। সব রকম উদযাপনের অংশীদার। অথচ নাইওরের বাইরে নারীর কাছে উৎসব মানেই রাজ্যের ব্যস্ততা। শুধুই দায়িত্বের বেড়াজাল, সময় নেই অবসরের, দম ফেলার ফুরসত নেই। আমাদের দেশে বসবাসকারী অনেক আদিবাসী গোষ্ঠীতে মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা আছে। তাদের জীবনাচরণ, উৎসব আয়োজন, উত্তরাধিকার সবকিছুই একচ্ছত্র ক্ষমতা বলে নারীর সিদ্ধান্ত অগ্রগণ্য। একদম বেগম রোকেয়ার সুলতানার স্বপ্নের মতো, আহা! আমি তো মনে করি, শুধু রান্নাঘরে ঢুকতে না হলে নারীর উদযাপন তখনই অর্ধেক সম্পন্ন! আচ্ছা, কেন এত চাপ নিচ্ছি বলুন তো, তাও আবার এই ডিজিটাল যুগে এসে! এখন কারসাজি শুধু ক্লিকের। একটু পরিকল্পনা করে চললেই উৎসব আয়োজনে নিজেকে মুক্ত রাখা যায়। সব কাজ একা হাতে সারতে গিয়ে উৎসবের দিনে অসুস্থ না হয়ে বরং আসুন চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনি। রুটিরুজি সংস্থান করতে সারা বছরই প্রত্যেকের ব্যস্ত সময় যায়। বিশেষ দিনে নিজের জন্য একটা নির্ভার সময় রাখা ভীষণরকম প্রয়োজন। দেশে এখন প্রচুর সেবাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আছে যারা নাগরিক জীবনকে সহজ করে তুলেছে। এক ক্লিকেই পেয়ে যাবেন রেস্টুরেন্ট যারা উৎসব আয়োজনে নির্দিষ্ট সেই উৎসবকেন্দ্রিক মজাদার সব পস্ন্যাটার অফার করে থাকে। উৎসবের দিনে অর্ডার ঠিক সময়মতো ঘরে পৌঁছে দেবে। এছাড়া প্রচুরসংখ্যক নারী উদ্যোক্তা যারা গ্রাহকের অর্ডার অনুযায়ী উৎসবের সব খাবার বাসায় সরবরাহ করে থাকেন। পেয়ে যাবেন হোম ক্লিনিং সার্ভিস। উৎসবের সপ্তাহখানেক আগে সেটাও করিয়ে নিতে পারেন। এছাড়া আছে আরও অনেক রকমের সেবা খাত! উৎসবের ছুটিতে কোথাও বেড়াতে যাবেন ভাবছিলেন? কিন্তু ঘরের গৃহপালিত প্রাণীর কথা ভেবে ভাবনাটা এগোতে পারেননি। আপনার এই সমস্যার সমাধান দেবে গৃহপালিত প্রাণী নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। খরচ বেশি হবে ভাবছেন তো! উৎসবে প্রাপ্ত বোনাস থেকে অথবা নিয়মিত খরচ থেকে একটা দুইটা খাতের অপচয় কমিয়ে ফেললে খুব আনন্দের সঙ্গে এই সার্ভিসগুলো আউটসোর্স করতে পারবেন। দেখবেন উৎসব আয়োজনের আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। তবে সবচেয়ে আনন্দ যোগ হবে তখনই যখন দেখবেন হাত হালকা হওয়ার কারণে ঘরের নারী পরিবারের সবার সঙ্গে সময় কাটানোর ফুরসত পেয়েছেন। এমন সুখী আত্মা দেখলে আয়ু বাড়ে, জানেন তো!