নারীর শিক্ষা ও স্বাধীনতা
স্বাধীনতার পর পাঁচ দশকে শিক্ষায় নারীরা যেভাবে এগিয়েছে, তার প্রতিচ্ছবিই যেন কদমতলা পূর্ব বাসাবো স্কুল অ্যান্ড কলেজটি। তৎকালীন শিক্ষা অধিদপ্তরের 'অ্যানুয়াল রিপোর্ট অন পাবলিক ইন্সট্রাকশন ফর দ্য ইয়ার-১৯৭০-৭১' প্রতিবেদন অনুসারে, তখন দেশের মোট শিক্ষার্থীর ২৮ শতাংশের কিছু বেশি ছিল ছাত্রী। সরকারের শিক্ষা, তথ্য ও পরিসংখ্যান বু্যরোর (ব্যানবেইস)-২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষায় মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রীর হার প্রায় ৫১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে
প্রকাশ | ০২ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
তাহমিনা আদিবা
দেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে মাত্র ৩৭ জন শিক্ষার্থী নিয়ে রাজধানীর সবুজবাগে যাত্রা শুরু করে কদমতলা পূর্ব বাসাবো স্কুল অ্যান্ড কলেজ। তখন বিদ্যালয়টিতে ছাত্রী ছিল ১৭ জন। আশির দশকে এই স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে প্রায় ৩০০ জনে উন্নীত হয়; ছাত্রীর সংখ্যা দাঁড়ায় এক-তৃতীয়াংশে। কদমতলা পূর্ব বাসাবো স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. সাইফুল জানান, এখন সেখানে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার শিক্ষার্থীর ৪৯ শতাংশই ছাত্রী।
স্বাধীনতার পর পাঁচ দশকে শিক্ষায় নারীরা যেভাবে এগিয়েছে, তার প্রতিচ্ছবিই যেন কদমতলা পূর্ব বাসাবো স্কুল অ্যান্ড কলেজটি। তৎকালীন শিক্ষা অধিদপ্তরের 'অ্যানুয়াল রিপোর্ট অন পাবলিক ইন্সট্রাকশন ফর দ্য ইয়ার-১৯৭০-৭১' প্রতিবেদন অনুসারে, তখন দেশের মোট শিক্ষার্থীর ২৮ শতাংশের কিছু বেশি ছিল ছাত্রী। সরকারের শিক্ষা, তথ্য ও পরিসংখ্যান বু্যরোর (ব্যানবেইস)-২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষায় মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রীর হার প্রায় ৫১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকেও প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী ছাত্রী। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মেয়েদের হার কিছুটা কম, ৩৮ শতাংশ।
সরকারি প্রতিবেদন, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মতে, সরকারি সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি, অভিভাবকদের সচেতনতা এবং শিক্ষার মর্যাদা উপলব্ধি থেকে শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণের হার দিন দিন বাড়ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দা তাহমিনা আখতার বলেন, বাল্যবিয়ে, দারিদ্র্য, বখাটেদের উৎপাতসহ নানা কারণে মেয়েদের শিক্ষা ব্যাহত হলেও সার্বিকভাবে সাধারণ শিক্ষা ও পেশাগত শিক্ষা মেডিকেল, প্রকৌশল এবং কারিগরি সব ক্ষেত্রে মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। শিক্ষার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের হার বেশি। উপবৃত্তিসহ নানা সুযোগ-সুবিধার কারণেও অনেক অভিভাবক মেয়েদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন।
১৯৭৩ সালে কদমতলা স্কুলটির প্রথম ভর্তি হওয়া ছাত্র ছিলেন ইয়াহিয়া সোহেল। তিনি এখন স্কুলের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান। তিনি বললেন, তাদের স্কুলে এলাকার দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবারের অনেক মেয়েও পড়ছে। দরিদ্র পরিবারগুলোও এখন মেয়েদের পড়ালেখা করার গুরুত্ব বুঝতে পারছে।
নারী শিক্ষা-১৯৭১ থেকে বর্তমান ব্যানবেইসের আর্কাইভ থেকে পাওয়া ১৯৭০-৭১ সালে দেশের শিক্ষা পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের আগের বছরের একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে দেওয়া হয়েছে। এতে দেখা যায়, ওই বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে নারী শিক্ষায় হঠাৎ পিছিয়ে যায় দেশ। স্বাধীন বাংলাদেশ ওই পিছিয়ে যাওয়া অবস্থা থেকে নারী শিক্ষা নিয়ে শুরু করে নতুন যাত্রা।
'অ্যানুয়াল রিপোর্ট অন পাবলিক ইন্সট্রাকশন ফর দ্য ইয়ার-১৯৭০-৭১' প্রতিবেদন অনুসারে, ওই সময় দেশে মোট শিক্ষার্থীর ২৮.৪ শতাংশ ছিল মেয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ১৮৮টি অনুমোদিত ডিগ্রি কলেজে ৯ শতাংশের বেশি এবং তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৩ শতাংশের মতো ছাত্রী ছিলেন। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ হাজার ৯৪৯ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে নারী ছিলেন ১ হাজার ২৯৪ জন। তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (এখন বুয়েট) ১ হাজার ৭১৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী ছিলেন ১২ জন। ময়মনসিংহে অবস্থিত একমাত্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ হাজার ৭৮১ শিক্ষার্থীর মধ্যে কোনো ছাত্রীর তথ্য নেই প্রতিবেদনে। ১০টি আইন কলেজ ও দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ৩ হাজার ৭১৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী ৩৬ জন, সরকারি তিব্বিয়া কলেজসহ ৯টি মেডিকেল কলেজে ৩ হাজার ৩৪৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী ছিলেন ৬১১ জন। ২টি কমার্স কলেজ ও ৫টি কমার্শিয়াল স্কুলে ৪ হাজার ৩১ জনের মধ্যে ছাত্রী ৫৫ জন, চিত্রাঙ্কন ও হস্তশিল্পের ১টি কলেজ ও ২টি স্কুলে ২৯৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী ছিল ৮৭ জন। ৬ হাজার ১৪৭টি সরকারি ও বেসরকারি সিনিয়র মাদ্রাসা, জুনিয়র মাদ্রাসা, হাফিজিয়া ও ফোরকানিয়া মাদ্রাসায় ৭ লাখের বেশি শিক্ষার্থী থাকলেও ছাত্রীর সংখ্যা কত ছিল, সে তথ্য দেওয়া নেই প্রতিবেদনে।
এর আগের বছরে ১৯৬৯-৭০ সালে প্রাথমিকে ৩৪ শতাংশের বেশি এবং মাধ্যমিকে প্রায় ২৯ শতাংশ মেয়ে পড়ত। ১৯৭২-৭৩ সালে ৩২ শতাংশের কিছু বেশি মেয়ে শিক্ষার্থী ছিল। প্রাথমিকে মেয়ে ছিল প্রায় ৩৫ শতাংশ। ১৯৭৩-৭৪ সালে ২৯ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী ছিল দেশে। প্রাথমিকে মেয়ের হার ছিল ৩৩ শতাংশ।
দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নকালে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা প্রকল্পের অধীনে ১৯৮১ সালে প্রথম প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর গঠন করা হয়। এরপর ১৯৯২ সালে এটি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগ এবং ২০০৩ সালে স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় হিসেবে গড়ে ওঠে। ২০০৩ সালে প্রাথমিকে মেয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির হার ছিল ৪৯ শতাংশ। মাধ্যমিকে গ্রামীণ পর্যায়ে প্রায় ৫৪ এবং শহরাঞ্চলে এ হার ৫১ শতাংশের কিছু বেশি ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেন্ডার অ্যান্ড স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজের মতে, প্রাথমিকে মেয়ে শিক্ষার্থীর হার বেশি বলে আত্মতৃপ্তিতে ভুলে গেলে হবে না। তিনি বলেন, শিক্ষার সঙ্গে নারীর ক্ষমতায়ন জড়িত। তাই উচ্চশিক্ষাতেও যেন নারীর অংশগ্রহণ বাড়ে সে লক্ষ্যে নারীবান্ধব শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। অনেক অভিভাবক প্রাথমিক শিক্ষা দিলেও উচ্চশিক্ষায় মেয়ের জন্য বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হন না।
মেয়েদের পাস বেড়েছে। রাজধানীর বাসাবো এলাকায় স্বামীর সঙ্গে ভ্রাম্যমাণ দোকানে চটপটি বিক্রি করেন এক নারী। স্বামী অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। আর তিনি নিজে কখনো স্কুলের গন্ডিতে পা রাখেননি। তবে পড়াশোনায় মেয়ের আগ্রহ দেখে ভর্তি করে দেন স্থানীয় এক স্কুলে। মেয়েটি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক মেয়েটি জানান, তার আশপাশে পড়ালেখা দেখিয়ে দেওয়ার মতো কেউ ছিল না। এমনও হতো, ঠিকঠাক বুঝে পড়তে না পেরে ফেলও করেছেন। কিন্তু মায়ের অনুপ্রেরণা ও শিক্ষকদের সহায়তায় তিনি একপর্যায়ে ভালো ফল করতে শুরু করেন।
উপবৃত্তির সুফল দরিদ্র পরিবারের শিশুদের স্কুলে ভর্তি নিশ্চিত করা, শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতি বাড়ানো ও ঝরে পড়া ঠেকাতে সরকার ১৯৯৩ সালে শিক্ষার জন্য খাদ্য কর্মসূচি হাতে নেয়। শহর এলাকা বাদে ২৭ শতাংশ এলাকায় এ কর্মসূচি ছিল। ১৯৯৯ সালে পৌর এলাকা বাদে অবশিষ্ট ৭৩ শতাংশ এলাকার জন্য প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করে ছাত্রছাত্রীদের মাসে ২৫ টাকা হারে উপবৃত্তি দেওয়া শুরু হয়। এই হার এখন অনেক বেড়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার দেওড়া পশ্চিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মাজহারুল হক খান বলেন, তার স্কুলে উপবৃত্তির কারণে ঝরে পড়া কমেছে এবং উপস্থিতি বেড়েছে। স্কুলের ৩৭৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে অর্ধেকের বেশি মেয়ে। তার এলাকায় প্রাথমিক স্কুলে ভর্তির হার প্রায় শতভাগ।
মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল একটি বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণ। বাংলাদেশের সংবিধানেও এর প্রতিফলন আছে। কিন্তু ৫৩ বছরেও আমরা বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণে ব্যর্থ হয়েছি। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য বিদেশের প্রশিক্ষণ নেয়া শুরু হয়েছিল আশির দশকেই। তা বহুগুণ বাড়ছে নব্বইয়ের দশকে। প্রযুক্তি এবং কৃষি ক্ষেত্রেও বাদ থাকল না মহিলাদের পদচারণ। কতগুলো পেশার সংস্কারও ভেঙে গেল নব্বইয়ের দশকে। তা হলো কেবিন ক্রু, বিজ্ঞাপন ও মডেলিং। শিক্ষিত পরিবারের মেয়েরা পেশাদারিত্বের দাবি নিয়ে এসে সেখানেও দাঁড়াল। তারা প্রশিক্ষণ নিল, চাকরি নিল, আকাশে উড়ল এবং মডেলিংয়ে প্রশংসা পেল। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়েদের জন্য এ ধরনের কাজ ছিল অসম্ভব সমালোচনা এবং নিন্দার। মনে রাখতে হবে, নারী ভিন্ন গ্রহের কোনো প্রাণী নয়, নারী এই সমাজের মা, বোন, কন্যা। নারী মানুষ। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র গঠনে সভ্যতা নির্মাণে ঐতিহ্য সৃষ্টিতে নারীরও আছে সমান সংগ্রাম, শ্রম এবং মেধা। অনেকে ভ্রান্ত ধারণার বশে নারীবাদকে পশ্চিমা এজেন্ডা বা পুরুষের বিরুদ্ধে নারীর প্রাধান্য স্থাপন বলে মনে করে। কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক সমাজে নারীর হাতেই ছিল নেতৃত্বের দন্ড। ধীরে ধীরে সে ধারা ফিরে আসছে। পৃথিবীর বহু দেশে নারী হয় রাষ্ট্রপ্রধান না হয় সরকারপ্রধান। সুতরাং, নারীর শিক্ষা ও স্বাধীনতা নিয়ে এগিয়ে যাবে স্বমহিমায়- এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।