কৃষিকাজে নারীর অবদান অনস্বীকার্য। নারীর সাহায্য ছাড়া কৃষি কাজ করা পুরুষের পক্ষে অসম্ভব। এই দেশে সেই প্রাচীন কাল থেকে কৃষিকাজে নারীরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে তার কাজের ফিরিস্তি শুরু হয়। হাত-মুখ ধুয়ে নামাজ আদায় করে অথবা মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে প্রথমে ঘর ঝাড়ু দিয়ে কাজ শুরু করেন। অতঃপর গোয়াল ঘরে গিয়ে গরুর ঘাসটা দিয়ে আসেন, হাঁস-মুরগির ঘরটা খুলে দেন। তারপর রান্নাঘরে এসে স্বামী, বাচ্চা, শ্বশুর ও শাশুড়ির জন্য নাশতা প্রস্তুত করা শুরু করেন, তাদের খাইয়ে নিজে খেতে বসেন। খাওয়ার পর হাঁড়ি-পাতিল ধুয়ে ঘর-দুয়ার পরিষ্কার করেন। অতঃপর, বাচ্চাকে স্কুলে পাঠান। তারপর বাড়ির আঙিনায় সবজি অথবা গোয়াল ঘর থেকে গাভীটিকে বাড়ির পাশের জমিতে ঘাস খাওয়ার জন্য বেঁধে দিয়ে আসেন। তারপর দুপুরের খাওয়া তৈরির জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন অথবা চাল করার জন্য ধান সিদ্ধ করেন। সেগুলো আবার উঠানের রোদে শুকাতে দেন, নেড়ে দেন। ধান শুকানোর পর আবার বিকালে গোলায় গুদামজাত করেন। এর ফাঁকে দুপুরে রান্না করেন। কল থেকে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করেন। এতটুকু ফুরসত নেই। বাচ্চাকে গোসল করিয়ে নিজে গোসল করেন। তারপর স্বামী ও পরিবারের অন্য সদস্যদের খাইয়ে নিজে দুপুরের খাওয়া শেষ করেন। তারপর চাটাইতে সম্ভব হলে একটু গড়াগড়ি দেন অথবা কাঁথা সেলাই করতে বসেন। অতঃপর সন্ধ্যায় মাঠে গিয়ে গাভীটা নিয়ে আসেন। হাঁস-মুরগি ঘরে তোলেন। তারপর রাত্রের খাবার রান্না করেন। বাচ্চাকে পড়াতে বসিয়ে সহপাঠীদের নিয়ে সম্ভব হলে একটু গল্প করেন। রাত্রে স্বামী বাড়ি এলে তাকেসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের খাইয়ে নিজে খেতে বসেন। তারপর হাঁড়ি-পাতিল গোছগাছ করে রান্নাঘর পরিষ্কার করে সবার শেষে ঘুমাতে যান। আর এভাবে একজন বাঙালি নারী প্রতিনিয়ত তার ব্যস্ততম দিন অতিবাহিত করেন। আর এই হলো আবহমান কাল থেকে বাঙালি নারীর চরিত্র। নিজের সুখ আহ্লাদ ত্যাগ করে পরিবারের সুখের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দেন।
সুতরাং, আমরা বলতে পারি কৃষিকাজে নারীর অবদান বলে শেষ করা যাবে না। আর এটা কখনো টাকা দিয়ে মূল্যায়ন করা যাবে না। বীজ সংগ্রহ, বপন/রোপণ থেকে শুরু করে ফসলের যত্ন, ফসল কাটা, ফসল সংগ্রহ, ঝাড়াই, মাড়াই, হাঁস-মুরগির লালন-পালন, ফলগাছ রোপণ, যত্ন নেওয়া, সবজি বাগানের যত্ন, পানি সেচ, রান্না-বান্না, ঘর-দুয়ার পরিষ্কার-পরিছন্ন করা, কোন কাজে নেই মেয়েরা? নারীরা আজ পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। অফিস-আদালত থেকে শুরু করে দেশ রক্ষায় তারা পুরুষের সঙ্গে অতন্দ্র প্রহরীর মতো কাজ করছে। গার্মেন্ট সেক্টরে শতকরা ৮০ ভাগ নারী শ্রমিক কাজ করছে- যা বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
জাতি গঠনে নারীর অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন নারী শিক্ষিত হলে তার ছেলেসন্তান শিক্ষিত হবে। এজন্য জ্ঞানীজনরা বলেছিলেন, আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেব। আশার কথা হলো- বর্তমানে উচ্চশিক্ষায় অর্ধেকের বেশি নারী। অফিস-আদালত, কলকারখানা, গার্মেন্ট, বিমানের পাইলট, পুলিশ, সেনাবাহিনী, রাজনীতিবিদ- প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিরোধী দলের নেত্রী, স্পিকারসহ সবাই নারী। নারী ক্ষমতায়নে বিশ্বে বাংলাদেশ এখন রোল মডেল।
অতএব, জাতি গঠনে, দারিদ্র্য দূরীকরণ ও সমাজের উন্নয়নের জন্য নারীর অবদান অনস্বীকার্য। তবে কৃষিক্ষেত্রে নারীর অবদান স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো। এজন্য নারীকে বলা হয় কৃষির জননী। দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা নারী। তাদের বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন কল্পনা করা যায় না। তাদের অংশীদারত্ব ও দায়িত্ববোধের জন্য বাংলাদেশ আজ কৃষিক্ষেত্রে অনেক উন্নতি সাধন করেছে। খাদ্য উৎপাদানে বাংলাদেশ আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ। ধান, সবজি, আম, পেয়ারা, মাছ, ডিম ও মাংস উৎপাদনেও বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণতার কাছাকাছি পৌঁছেছে। আর এতকিছু সম্ভব হয়েছে দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা নারীর কৃষিক্ষেত্রে অবদানের জন্যই।