নারী পাচার
প্রকাশ | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
নন্দিনী ডেস্ক
যতই দিন যাচ্ছে উদ্বেজনক হারে বাড়ছে নারী পাচার। কিছুতেই রোধ করা যাচ্ছে না এ পাচার। 'প্রায় সাত মাস আগে আমার ভাতিজি ভারতে পাচার হয়। এখনো তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা যায়নি। তাকে দেশে ফেরাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। অপেক্ষায় আছি, কখন মেয়েটি আমাদের কাছে ফেরে!' এভাবেই বলছিলেন পাচার হওয়া ওই তরুণীর চাচা রানা।
শুধু এই তরুণী নন, গত দুই বছরে (২০২২ও ২০২৩ সাল) দেশ থেকে প্রায় দেড় হাজার নারী ও শিশু পাচার হয়েছে। তাদের বেশিরভাগ এখনো উদ্ধার হয়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এ তথ্য দিয়েছে। সর্বশেষ রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকা থেকে নিখোঁজ দুই কিশোরী ভারতে পাচার হয়েছে বলে জানা গেছে। ঘটনার তদন্তে নেমে কবির হোসেন নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে নারী ও শিশু পাচারকারী একটি চক্রের সন্ধান পায় তারা। কবিরের তথ্য অনুযায়ী, চক্রটি ফেসবুকে বিদেশে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে নারীদের পাচার করে আসছিল। এ চক্রের বিষয়ে গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, 'সম্প্রতি রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকা থেকে দুই কিশোরী নিখোঁজের ঘটনায় একটি মামলা হয়। তদন্তে নেমে আমরা একটি মানব পাচার চক্রের সন্ধান পাই, যারা ফেসবুকে সহজে টাকা-পয়সা ছাড়াই চাকরি দেওয়ার নামে নারী ও শিশুদের পাচার করে আসছে। এই চক্রের ফাঁদে পা দিয়ে খুলনা থেকে এক নারী তার সন্তানকে নিয়ে সাতক্ষীরার কলারোয়ার সীমান্ত এলাকায় চলে যান। চক্রের সদস্যরা তাদের পাচারের উদ্দেশ্যে নো-ম্যানস ল্যান্ড এলাকায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাদের উদ্ধার করা হয়। তবে যে মামলার তদন্তে নেমে এই চক্রের সন্ধান পাওয়া গেছে, সেই দুই মেয়েকে আগেই পাচার করা হয়।
ডিবি বলছে, কলারোয়ায় ভারতীয় সীমান্তের জিরো পয়েন্ট লাগোয়া গ্রাম কেরাগাছি এলাকার আব্দুল হামিদের দুই ছেলের নেতৃত্বে চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে কম বয়সি নারী ও শিশুদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে সীমান্ত দিয়ে পাচার করে আসছিল। তার অন্যতম সহযোগী বড় ভাই কবির হোসেন। চক্রটি শতাধিক নারীকে পাচার করেছে বলে দাবি ডিবির।র্ যাব ও পুলিশের ভাষ্য, নারী ও শিশু পাচারের একাধিক মামলায় তদন্তে নেমে তারা জানতে পেরেছে, গত বছর টিকটক চক্রের মাধ্যমে ভারতে পাচার হওয়া বাংলাদেশি এক তরুণীকে হত্যা করা হয়। তার লাশ উদ্ধারের পর গুজরাট পুলিশ ফোনে তরুণীর বাবাকে এ তথ্য জানায়। নিহত তরুণীর নাম টুম্পা আক্তার। ঢাকার কোনাপাড়া এলাকা থেকে নিখোঁজ হন ওই তরুণী। তার বাবা রহিম সেখ বলেন, টুম্পাকে হত্যার খবর গুজরাট পুলিশ মোবাইল ফোনে তাকে জানিয়েছে। তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, গত দুই বছরে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কয়েক হাজার নারী নিখোঁজের অভিযোগে বিভিন্ন থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। এর মধ্যে দেড় হাজারের বেশি নারী পাচার হয়েছে বলে প্রাথমিক তথ্য পেয়ে তদন্ত চলছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, পাচার হওয়া বেশিরভাগই কিশোরী ও তরুণী। তাদের ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাচার করা হচ্ছে। সিআইডিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে তাদের ফেরানোর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন বলে জানা গেছে। পাচার হওয়া নারীদের আইনি সহায়তা দিয়ে আসছে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, 'প্রতিবছর দেশ থেকে অনেক নারী পাচার হওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে কিশোরী-তরুণী এমনকি শিশুও রয়েছে। এসব পরিবার ও ভুক্তভোগীদের আইনগত সেবা দিই আমরা। দেশ থেকে নারী পাচারের সঙ্গে একটি রাঘববোয়াল চক্র জড়িত। তারা যশোর ও সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী এলাকায় বেশি তৎপর। এর বাইরে সারাদেশে চক্রের পাঁচ শতাধিক সদস্য রয়েছে।
বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি গত দুই বছরে পাচার হয়ে দেশ ফেরা ৯০০ নারীকে আইনি সহায়তা দিয়েছে। এর মধ্যে কিশোরী ও তরুণী বেশি। গত দুই বছরে কম করে হলেও দুই হাজার নারী পাচারের অভিযোগ পেয়েছেন তারা। পাচার হওয়া এক কিশোরীর পরিবারের ভাষ্য সাত মাস আগে পাচার হওয়া ১৪ বছরের এক কিশোরী এখন গুজরাট রাজ্যের পুলিশের তত্ত্বাবধানে একটি চিলড্রেন হোমে রয়েছে। এর আগে প্রেমের ফাঁদে ফেলে আবির নামের এক যুবক তাকে এক নারীর সহায়তায় ভারতে পাচার করেন। এ ঘটনায় নারায়ণগঞ্জের ফতুলস্না থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে পাঁচজনের নামে মামলা করা হয়েছে। এই মামলায় আবির ও রাশেদা নামে দুজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। মামলার অন্য তিন আসামি হলেন- মো. হাসান, জামাল ও সোনিয়া।
গত ২৮ জানুয়ারি রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে নিখোঁজ হওয়া দুই কিশোরী পাচার হয়ে বর্তমানে ভারতে রয়েছে বলে জানতে পেরেছে তার পরিবার। এ ঘটনায় নিখোঁজ এক কিশোরীর মা হাজারীবাগ থানায় একটি জিডি করেছেন। পাচার হওয়া দুই কিশোরীর সঙ্গে এক নারীসহ পাঁচ ব্যক্তির কথোপকথনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে দুই জনের বাড়ি যশোর ও সাতক্ষীরায়। এদের সঙ্গে ভারতীয় কয়েকটি মোবাইল ফোন নম্বরের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে।
দেশে ফেরা এক তরুণী বলেন, 'ভারতে পাচার হওয়ার পর বীভৎস নির্যাতনের শিকার হই। বেঙ্গালুরুর একটি ম্যাসাজ সেন্টার থেকে জানালা ভেঙে পালাতে সক্ষম হই। সেখান থেকে ট্রেনে কলকাতায় আসি। পরে দেশে ফিরি। পরে হাসপাতালে চিকিৎসা নিই।' তিনি বলেন, 'আমার বড় বোন ও ছোট খালাও পাচার হয়েছে। আমি তাদের সন্ধান চাই।' এর আগে ভারতে পাচার হওয়া চার তরুণী দেশে ফিরে তাদের ওপর নির্যাতনের তথ্য দিয়েছেন। দেশে ফেরা তরুণীরা রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় মানবপাচার ও পর্নোগ্রফি আইনে পাঁচটি মামলা করেন। এসব মামলায় ২০ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। নারী পাচার চক্রের ২০ জনকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ জানতে পারে, এই পাচারচক্রে দেশ-বিদেশের কয়েকশ' সদস্য যুক্ত। তারা শুধু ভারতে নয়, মালয়েশিয়া ও আরব আমিরাতেও নারী পাচার করেছে। মানবপাচারের সঙ্গে যশোরের শার্শা এলাকার একাধিক জনপ্রতিনিধির সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। সংক্ষিপ্ত ভিডিও শেয়ারিং পস্ন্যাটফরম টিকটকে মডেল করার লোভ দেখিয়ে বিভিন্ন দেশে নারী পাচার করছে তারা।