নারী শুধু মা নয়, নয় শুধু গৃহিণী, সহধর্মিণী। নারী বিশ্বের সেতুবন্ধন। পুরুষের কাঁধে কাঁধ রেখে একই কদমে হেঁটে চলেছে নারী। দুঃসাহসিক অভিযানে পালস্না দিয়েছে পুরুষের সঙ্গে। ধর্ম ও সমাজ সংস্কারে তার ভূমিকা অনন্য। সাহিত্য-বিজ্ঞানে বিশ্বজয়ের স্বীকৃতি। নারী এখন সংগ্রামী জীবনের অংশীদার। বীরাঙ্গনা বেশে যুদ্ধ করেছে শত্রম্নর সঙ্গে। কিন্তু দুঃখের বিষয় নারীর অবদানের ইতিহাসকে অবজ্ঞা করা হয়েছে। বলা চলে, যে ফুলের সৌরভ আছে তাকে যতই পদদলিত করা হয় না কেন, তার সুমিষ্ট গন্ধই তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়। ইতিহাসের কোথাও না কোথাও এক কর্ণারে ঠাঁই মিলে। তেমনি কাগজের খোদাই করা এক ইতিহাস ১৯৫২ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। এই ভাষা আন্দোলনের নেপথ্যে রয়েছে নারীর অবদানের এক অমরত্বের ইতিহাস। যে ইতিহাস মানুষের অগোচরে থেকে গেছে। সেই সংগ্রামী বীরাঙ্গনা দুঃসাহসিক যোদ্ধা, যাদের সক্রিয় অংশগ্রহণে বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে উচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে সেসব মহান নারীর বীরত্বগাঁথা তুলে ধরলাম।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সর্বপ্রথম পরিকল্পিত ও সুসংগঠিত আন্দোলন শুরু হয় সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। জন্মলগ্ন থেকেই সংগঠনটি সঙ্গে নারীরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করে আসছিল। নারী ভাষা সৈনিকদের মধ্যে আবুল কাশেমের স্ত্রী রাহেলা, বোন রহিমা এবং রাহেলার ভাইয়ের স্ত্রী রোকেয়া আন্দোলনকারী ছাত্রদের আজিমপুরের বাসায় দীর্ঘদিন রান্নাবান্না করে খাইয়েছেন। ১৯৫২ সালে ২৩ জানুয়ারি ভোর ৪টায় পুলিশ তার বাড়ি ঘেরাও করে এবং দরজায় বারবার আঘাত করতে থাকে। ঠিক তখন রাহেলা পুলিশের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ তর্র্কবিতর্ক করতে থাকেন। এই সুযোগে আবুল কাশেমসহ অন্যরা পেছনের দেওয়াল টপকে পালাতে সক্ষম হন।
আটচলিস্নশ ও বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনে তৎকালীন এ দেশের নারীসমাজের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। তারা পুরুষের পাশাপাশি মিছিল, স্স্নোগান, সভা-সমিতিতে অংশগ্রহণ করেন।
ঢাকার বিভিন্ন স্কুল-কলেজ বিশেষ করে কামরুন্নেসা স্কুল এবং ইডেন কলেজের ছাত্রীদের ভূমিকা ছিল সংগ্রামী। যশোরে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে একজন হামিদা রহমান। বগুড়ার ছিলেন রহিমা খাতুন, সালেহা খাতুনসহ অনেকে।
ভাষা আন্দোলনে সিলেটের নারীদেরও অবদান ছিল অপরিসীম। এই আন্দোলনে সংগ্রামী ভূমিকা রাখেন হাজেরা মাহমুদ, জোবেদা খাতুন চৌধুরী, শাহেরা বানু, সৈয়দা লুৎফুন্নেছা খাতুন। ১৯৪৯ সালে ১৩ আগস্ট গ্রেপ্তার হন লিলি চক্রবর্তী পোস্টার ও প্রচারপত্রের মাধ্যমে আন্দোলন সচল রাখার তৎপরতা চালানোর সময়। তিনি নারী ভাষা আন্দোলনের সহযোগিতাও করেন। যারা এই আন্দোলনকে বেগবান করে তুলেছিল তাদের মধ্যে নিবেদিতা নাগ, সারা তৈফুর মাহমুদ, সাহেরা বানু উলেস্নখযোগ্য।
'৫২-র ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে ছাত্রীরাও দুঃসাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন। ২১ ফেব্রম্নয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙায় যারা ভূমিকা রেখেছিলেন তারা হলেন শামসুন্নাহার, রওশন আরা সুফিয়া। যারা পূবর্বাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের বর্জন করেন তাদের মধ্যে আনোয়ারা খাতুন ছিলেন অন্যতম। এছাড়া নারায়ণগঞ্জে ভাষা আন্দোলনের নেত্রী মমতাজ বেগম গ্রেপ্তার হলে জনতার মধ্যে প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়েছিল।
১৪৪ ধারা ভঙ্গে সেদিন পুলিশের লাঠিচার্জ ও টিয়ার সেলে অনেক ছাত্রী আহত হন। এদের মধ্যে রওশন আরা বাচ্চু, সারা তৈফুর, বোরখা সামসুন, সুফিয়া ইব্রাহিম, সুরাইয়া ডলি ও সুরাইয়া হাকিম ছিলেন।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ হামিদা রহমানের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল বের হয়। তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার পরোয়ানা জারি হওয়া সত্ত্বেও পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে রাতে যশোর কলেজে বৈঠকে তিনি ছেলেদের পোশাক পরে সভায় যোগ দেন। '৫২-র ভাষা আন্দোলনের সময় ডাক্তার কাজী খালেদা খাতুন মিছিল, সমাবেশ ও অবরোধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। স্কুল ছাত্রছাত্রীদের সমাবেশে একুশে ফেব্রম্নয়ারি আমতলার সভায় তিনি বক্তব্য রেখেছিলেন। ড. সাফিয়া খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীনিবাস, চামেলি হাউসের ছাত্রীদের নিয়ে '৫২ ভাষা আন্দোলনের এক দুর্জয় প্রতিরোধ সৃষ্টি করেন। এছাড়া ভাষা আন্দোলনের প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন কমলা ভট্টাচার্য। তিনি ছিলেন ১৬ বছরের এক কিশোরী।
এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাতের অন্ধকারে ভাষার দাবিতে পুলিশের তাড়া খেলে ছাত্রীরা তাদের নিজেদের কাছে লুকিয়ে রাখেন। ভাষা আন্দোলনে জড়িত হওয়া অনেক নারী জেলও খেটেছেন। কেউ কেউ হারিয়েছেন সংসার। আবার কেউ কেউ নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার হয়েছেন। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো আন্দোলনের খরচ চালানোর জন্য অনেক গৃহিণী অলংকার খুলে দিয়েছিলেন। কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, নারীরা যারা কারফিউ ভেঙে মিছিল নিয়ে গিয়েছিলেন তারা দ্রম্নত একটি শহীদ মিনার তৈরি করেছিলেন। প্রফেসর আনিসুজ্জামানের মা সেই শহীদ মিনারে গিয়ে তার গলার সোনার চেইনটি রেখে এসেছিলেন যে ইট, বালু কিনে শহীদ মিনার তৈরি করার জন্য।
রংপুরে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে মিছিলে গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে যারা বিক্ষোভ মিছিল করেছিলেন তারা হলেন- নিলুফা আহমেদ, বেগম মালেকা আশরাফ, আফতাবুন্নেসা প্রমুখ। রাজশাহীতে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তারা হলেন- ডক্টর জাহানারা বেগম বেণু, মনারা বেগম বেণু, ডাক্তার মহাসিনা বেগম, ফিরোজা বেগম ফুনু, হাফিজা বেগম টুকু, হাসিনা বেগম ডলি, খুরশিদা বানু খুকুু প্রমুখ।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই বাঙালি জাতি পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারের অবহেলা, বঞ্চনা ও শোষণের জাঁতাকালে পিষ্ট হচ্ছিল। মাতৃভাষা বাংলার প্রতি অবমাননা বাঙালি সর্বস্তরের মানুষের মনে প্রবল নাড়া দিয়েছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল এ দেশের ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি পাকিস্তানিদের হাতে কিছুই নিরাপদ নয়। তাদের এই উপলব্ধিবোধ থেকে আস্তে আস্তে এদের ভেতর বিদ্রোহের দানা বাঁধতে থাকে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে এটি ছিল বাঙালি জাতির প্রতিবাদ এবং জাতীয়তাবাদের প্রথম প্রেরণা। এর পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। এ আন্দোলনের তীব্রতা এত গুণ বেড়ে গিয়েছিল যে নারী পুরুষ কেউ আর ঘরে বসে থাকতে পারেনি। নারী ছিল পুরুষের সহযোদ্ধা।
নারীর দূরদর্শিতা, চেতনাবোধ, অদম্য মনোবল, সাহসিকতা, অসীম প্রজ্ঞা, আন্তরিক ভালোবাসা সেদিন নারীকে এই আন্দোলনের প্রথম সারিতে দাঁড় করিয়েছিল। নারী যে শুধু যুদ্ধ করেছিলেন তা নয়, ভাষা আন্দোলনকারীদের আশ্রয় দিয়ে, খাবার দিয়ে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, অস্ত্র লুকিয়ে রেখে, সেবা দিয়ে নানাভাবে যে সহায়তা করেছিলেন তার দৃষ্টান্ত কিন্তু কম নয়। কিন্তু সেভাবে তাদের প্রতিদানের কথা জনসম্মুখে আসেনি। অন্ধকারেই রয়ে গেছে তাদের কৃতী। তাই বলব, আজ সময় হয়েছে ভাষা আন্দোলনে নারীর কীর্তি, তাদের অবদান, দুঃসাহসিক অংশগ্রহণ জনসম্মুখে তুলে ধরা। তাহলে তাদের এই উজ্জ্বল দৃষ্টান্তে নারী হবে অনুপ্রাণিত। জাগ্রত হবে চেতনাবোধ। হয়তো একটু স্বীকৃতি, একটু সম্মাননা আগামী প্রজন্মের জন্য আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে নারী জাতিকে। (তথ্য সংগৃহীত)