রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়ন
নারীর ক্ষমতায়নে জাতীয় সংসদে ৫০টি আসন সংরক্ষিত রয়েছে। সেখানে অবশ্য সরাসরি নির্বাচন হয় না। রাজনৈতিক দলগুলোর সব কটিতে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, এ লক্ষ্য অর্জন করার কথা ছিল। সম্প্রতি শেষ হয়ে গেল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যেখানে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ হয়েছিল নারী প্রার্থীদের। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এবারের নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন মাত্র ১৯ জন নারী প্রার্থী।
প্রকাশ | ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
হাসি ইকবাল
ফ্রকপরা ছোট নারী শিশুটিকে একটা চকলেটের লোভ দেখিয়ে যেদিন প্রথম তার শরীরকে অসম্মান করা হয়েছিল সেদিন সে বুঝতেই পারেনি বাকি জীবনটা তাকে হাতে চুড়ি পরে থাকতে হবে। সেদিনও সে ভাবতে পারিনি ভ্যানিটি ব্যাগে বাবার কিংবা স্বামীর কাছে থেকে হাতপাতা দু'-একটি টাকা নিয়ে উন্মুক্ত মৌমাছির মতো সে কোনোদিনও ঘুরে বেড়াতে পারবে না। হারমোনিয়ামে সারেগামা বলা তো দূরের কথা তাকে পড়ে থাকতে হবে হাড়ি পাতিলের মাস্টার হয়ে লাকড়ি আর গ্যাসের চুলার কাছে।
কাঁচি হাতে সমাজের ভ্রষ্টতা আর অসভ্যতার মূলকে ঘ্যাচাং করে কাটা নয় বরং চকলেট মুখে চুষতে চুষতে সে হয়তো কোনো পুরুষের ভোগ ভক্ষণের আঙুর চকলেট হয়েই থাকবে। বহু কষ্টে কথাগুলো বলছি। কারণ মৃত স্বামীর সঙ্গে আগুনে পুড়ে আবার এই নারীকে স্বর্গে পাঠানোর আয়োজন করা হচ্ছে সর্বত্র। কীভাবে নারীকে ছোট করে রাখা হবে চারদিকে চলছে সেই আয়োজন।
নারী বঞ্চনার তিক্ত অভিজ্ঞতা পেরিয়ে নারীর ক্ষমতায়নে দেশ বেশ এগিয়েছে। বর্তমান বিশ্বে সর্বাধিক আলোচিত বিষয়সমূহের মধ্যে একটি হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়ন। বহুল আলোচিত এ প্রত্যয়টিকে এখন সামাজিক উন্নয়নের সূচক হিসেবে বিবেচিত করা হয়। ক্ষমতায়ন কোনো মানবিক দর্শন নয়। ক্ষমতায়নকে মানবিক অভিধায় ব্যবহার করার জন্য প্রয়োজন সচেতনতা, শিক্ষা, মূল্যবোধ, নৈতিকতা, সততা যা চেতনার কালগত গভীর আলো।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার এক বিশাল অংশ নারী ও শিশু। লিঙ্গ বৈষম্যের করাল স্র্রোতে নারী অধিকার বিষয়টি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বেশ আলোচিত বিষয়। নারী অধিকার এবং অবস্থানের ক্ষেত্রে নারীরা এখন পর্যন্ত বেশ পিছিয়ে। নারীর অধিকারের প্রশ্নে সাংবিধানিক ও আইনগত জোড়ালো সমর্থন থাকা সত্ত্বেও পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিদ্যমান থাকার কারণে আমাদের সমাজে নারীর এখনো সমঅধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ফলে প্রতিদিনই অসংখ্য নারীর মানবাধিকার হরণ হচ্ছে, অধিকারহীনতা আর অসহায়ত্ব বেড়ে চলছে।
নারী অধিকার পরিভাষাটি বলতে বোঝায় এক ধরনের স্বাধীনতা, যা সব বয়সের মেয়ে ও নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়। এই অধিকার হতে পারে প্রাতিষ্ঠানিক, আইনানুগ, আঞ্চলিক সংস্কৃতি দ্বারা সিদ্ধ বা কোনো সমাজের আচরণের বহিঃপ্রকাশ। যেসব বিষয়ের ক্ষেত্রে নারী অধিকার প্রযোজ্য হয় তা সুনির্দিষ্ট না হলেও এগুলো মূলত সমতা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতাকেন্দ্রিক। যেমন- ভোটদানের অধিকার, অফিস আদালতে এক সঙ্গে কাজকর্ম করার অধিকার, কাজের বিনিময়ে ন্যায্য ও সমান প্রতিদান (বেতন ও অন্যান্য সুবিধাদি) পাবার অধিকার, সম্পত্তি লাভের অধিকার, শিক্ষার্জনের অধিকার, সামরিক বাহিনীতে কাজ করার অধিকার, আইনগত চুক্তিতে অংশগ্রহণের অধিকার এবং বিবাহ, অভিভাবক ও ধর্মগত অধিকার। কিন্তু এই অধিকারগুলো এখন পর্যন্ত যথাযথভাবে পূরণ না হওয়ার কারণে নারী ও তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু স্থানে পুরুষের সমঅধিকার আদায়ের সপক্ষে বিভিন্ন প্রকার ক্যাম্পেইন ও কর্র্মশালা চালিয়ে যাচ্ছে।
নারী অধিকার মানবাধিকার থেকে ভিন্ন কিছু নয়। মানবাধিকারের সব বিষয়গুলোই নারী অধিকারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যা নারীদেরকে আরও কিছু অধিকার ও একান্ত স্বকীয়তা তার মর্যাদার ও অধিকারকে সুষ্ঠুভাবে লালন করতে শেখায়। মলূত এটি সর্বজনীন ও অধিকার বিশেষায়িত। বিশেষায়িত অধিকারগুলো আইন, আঞ্চলিক সংস্কৃতি, প্রতিষ্ঠান, জাতি ও রাষ্ট্রভেদে ভিন্ন হতে পারে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে অধিকারগুলোর সামাজিক কর্মকান্ড ও রীতি দ্বারা সিদ্ধ হতে পারে।
মানবাধিকারের যে শাখাটি নিয়ে সারাবিশ্বেই তোলপাড় তা হলো নারী অধিকার। নারী অধিকার নিয়ে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আইন রয়েছে, রয়েছে আন্তর্জাতিক আইন ও সনদ জাতীয় গন্ডির ভেতরে প্রায় প্রত্যেক দেশেরই নিজস্ব আইন আছে সেই আইন কখনো সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত আবার কোথাও বিশেষ আইন দ্বারা স্বীকৃত। আমাদের সংবিধানে থাকলেও নারীর প্রতি বৈষম্য বিরাজ করছে সমাজের সর্বক্ষেত্রেই। বিভিন্ন কর্মকান্ড আর অংশীদারিত্বে নারীর অবদান থাকলে নারী উন্নয়নে বৈষম্য আর অবহেলা দেখলে সত্যি যেন মনটা মুষড়ে ওঠে। মনে হয় এই কি নিয়তি না কি কোনো শুভাংকরের দুষ্ট চক্রের ফাঁকিবাজির চোরাগলিতে আটকে যাচ্ছে আমাদের নারী অধিকার?
ঘুমন্ত বিড়ালের মতো উঠোনের ধারে শীতের হীম অন্ধকারে নারী অধিকার আজ নিজেকে কাতুকাতু দিয়ে ঘুম ভাঙানোর অপেক্ষায় হাই তোলে। বারবার কোনো অশুভ শক্তি অকাল বসন্তের শরীরে রাসায়নিক হাটবাজার বসিয়ে ভুতুরে সন্ধ্যায় নারীদেরকে বানায় সমাজবাদী?
হুম, হয়তো তাই অবলীলায় নারী কঁচি মনে ঘরকন্নার শাশ্বত বাসনাকে পুনরাবৃত্তির কারণে আবারও ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নারী বেলাতে।
নারীর ক্ষমতায়নে জাতীয় সংসদে ৫০টি আসন সংরক্ষিত রয়েছে। সেখানে অবশ্য সরাসরি নির্বাচন হয় না। রাজনৈতিক দলগুলোর সব কটিতে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, এ লক্ষ্য অর্জন করার কথা ছিল। সম্প্রতি শেষ হয়ে গেল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যেখানে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ হয়েছিল নারী প্রার্থীদের। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এবারের নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন মাত্র ১৯ জন নারী প্রার্থী। যা গত ২০১৮ সালে ছিল ২২ জন। যা কিনা আমাদের নারী নেতৃত্ব দানের ক্ষেত্রে অনেক কম এবং তাদের অধিকাংশই রয়েছেন সরকারি দলের প্রার্থী। সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হলো, দ্বাদশ জাতীয় সংসদের মন্ত্রিসভায় মাত্র ৪ জন নারী স্থান পেয়েছেন। সরকার প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই রয়েছেন এ মন্ত্রিসভার নেতৃত্বে। আরও আছেন পূর্ণমন্ত্রীর সঙ্গে দু'জন প্রতিমন্ত্রী।
যেখানে নারীরা আজ বিমান ও ট্রেন চালানোর মতো দুঃসাহসিক কাজকে চ্যালেঞ্জ করছেন সেখানে আবারও ফ্রকপরে পুতুল নিয়ে নাড়াচাড়া করতে নারীদেরকে পাঠানো হচ্ছে সেই গ্যাসের চুলায়। বিষয়টা এমন যেন ঘুরেফিরে একটি কাজেরই দায়িত্ব তারা পেয়েছেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ব্যাঙের কুয়া ব্যাঙটাকেই জগৎ মনে করে। যুগের যুগের পর যুগ আমাদের গ্রামীণ নারীসমাজকে এমনিভাবে কোনঠাসা করে রেখেছে সমাজব্যবস্থা। সেখানে পৌর নির্বাচনে নারীদের অংশগ্রহণ সাধারণ কোনো নেতৃত্ব নয়, আমরা এটাকে আগামী দিনের নারী নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জের জায়গাটায় দেখে থাকি। সেখানে জাতীয় সংসদে নারীর অংশগ্রহণ ও তাদের নেতৃত্ব নারী নেতৃত্বের ক্ষেত্রে এক মাইলফলক হিসেবে ক্ষমতায়নের দ্বারকে শুধু উন্মোচিতই নয় বরং নারীকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করে। কারণ নেতৃত্ব ছাড়া ক্ষমতায়ন অসম্ভব। ক্ষমতায়ন হলো বস্তুগত জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা অর্জন করা। যেখানে বস্তুগত, মানবিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের ওপর ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা থাকে।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির রির্পোট অনুযায়ী জেন্ডার ক্ষমতায়নকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও পেশাগত- এই তিন দিক থেকে পরিমাপ করা যায়। নারী এসব ক্ষেত্রে কতটা অগ্রগতি অর্জন করেছে তার ওপর নির্ভর করে সে কতটা ক্ষমতার অধিকারী। রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নই নারীর সার্বিক ক্ষমতায়নের মূল ভিত্তি। ক্ষমতায়ন একটি বহুমাত্রিক এবং স্পাইরাল প্রক্রিয়া। এটি এমন একটি বিষয় যার দ্বারা ব্যক্তি নিজের জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা অর্জন করতে পারে। রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নারীর সার্বিক ক্ষমতায়নের মূল ভিত্তি। কারণ রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন সব ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়নকে সুদৃঢ় ও মজবুত করে।
নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণের প্রধান অন্তরায় হলো আর্থিক পরনির্ভরশীলতা। সম্পদের মালিকানা থেকেও তারা বঞ্চিত। অধিকাংশ নারীর নিজস্ব আয় নেই, আবার থাকলেও ব্যয়ের স্বাধীনতা নেই। আর এই আর্থিক পরনির্ভরশীলতা ও সম্পদের অপ্রতুলতা নারীকে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। ফলে নারীরা নিজেই পুরুষের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। এর ফলে রাজনীতিতে কিংবা সাংগঠনিক কার্যক্রমে নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নারী নেত্রীদের মতে, গণতান্ত্রিক নির্বাচনে নারীকে রাজনৈতিকভাবে পিছিয়ে দেওয়ার বঞ্চনার সূত্রপাত হয় মনোনয়নের প্রহসনের মধ্য দিয়ে। আর তৃণমূল পর্যায়ে নারী প্রতিনিধিরা পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন ভোটের আগে ও পরে। পদে পদে বৈষম্য চলছে ত্রাণ বণ্টন থেকে শুরু করে উন্নয়ন ভাতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতায়।
দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে উন্নয়নে, দেশের একটি বিরাট অংশ নারী জনগোষ্ঠী উন্নয়নে অংশীদারিত্ব করছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে সরকার এ স্বপ্নকে বাস্তবতায় রূপ দিতে বদ্ধপরিকর। দেশের তৃণমূল পর্যায়ে প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে ইতিমধ্যে ৪৫৭৮টি ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপন করা হয়েছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার। তৈরি করা হয়েছে বিশ্বের অন্যতম বিশাল ন্যাশনাল ওয়েব পোর্টাল। শুধু রান্নাঘর আর গৃহকর্মের লাগাম ছেড়ে আমাদের নারীরা আজ প্রযুক্তির হাত ধরে এগিয়ে গেছে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বহু দূর।
দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে স্পিকার, সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, পুলিশ, সেনাসদস্য, বৈমানিক, বিচারক, উদ্যোক্তা, ক্রিকেটার এমনকি মহান মুক্তিযুদ্ধেও নারীর সফল অংশগ্রহণে বাংলাদেশের বিজয় পতাকা আজ উড়ছে এভারেস্ট চূড়াতে। নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া এখন পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পারলেও নারীরা এখন পর্যন্ত অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। সেখানে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রক্রিয়া নারী নেতৃত্বে ও ক্ষমতায়নে একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলা যেতে পারে।
আশা করছি, নারীর ক্ষমতায়নে নীতি নির্ধারকদের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। সনাতনী চিন্তা ও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা পরিহার করে রাজনৈতিকভাবে নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ আরও বেড়ে যাক, পাশাপাশি তৃণমূল থেকে জাতীয় সংসদেও মন্ত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদমর্যাদায় নারীদের আসন আরও বাড়ানো হোক- আমরা সে আশায় অধির আগ্রহে দিন গুনছি।