নারীরা কেন পরিহাসের শিকার হবে
প্রকাশ | ২৩ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
আর্নিয়া খানম আন্নি
সন্তান জন্মদানে সক্ষম প্রতিটি নারীর জীবনের অবধারিত একটি ঘটনার নাম পিরিয়ড। সম্প্রতি আমি এক দোকান থেকে প্যাড কেনার জন্য দোকানিকে বলায় দোকানিসহ পাশের ক্রেতারা এমনভাবে তাকালো মনে হলো ভারী লজ্জার বিষয় আমি স্বাভাবিকভাবেই বলে ফেললাম। কেনই বা দৃষ্টিকটু চোখে তাকানো হলো, কেনই বা ঠোঁটের কোণায় তাচ্ছিল্যের হাসি। পিরিয়ড প্রতিটি নারীর জীবনের এমন একটি অংশ যেখানে নারীরা এর তীব্র জালাময় অনুভূতি স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করে। ছয় ঋতুর আবহাওয়া পরিবর্তনের এই দেশে প্রতিটি নারীকে গুণতে হয় প্রতি মাসের নির্দিষ্ট সময়ের এক বিশেষ ভিন্ন অনুভূতি। এই একটি জীবনপ্রক্রিয়া ছাড়া আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে মানব জাতির বিস্তার ঘটা হয়তো সম্ভবই হতো না। কোনো পুরুষ চাইলেই বাবা ডাক শুনতে পেত না। অথচ সভ্যতার এই যুগে এখনো নারীরা হয়রানির শিকার। এখনো এই স্বাভাবিক ও সার্বজনীন ব্যাপারটিকে নিয়ে আমাদের দেশসহ পৃথিবীর নানা জায়গায় চলে আসছে অসংখ্য অহেতুক গোপনীয়তা, কুসংস্কার, ট্যাবু। শুধু ঘরের বাইরে নয়, বরং পরিবারের মাঝেও পুরুষদের দ্বারা নানা কুরুচিপূর্ণ আচরণের শিকার হতে হয় সদ্য বয়ঃসন্ধিতে বা পিরিয়ডে পা রাখা মেয়েদের। একটা নির্দিষ্ট সময়ে ধর্মীয় কাজ থেকে বিরত থাকলেই দেখা যাচ্ছে ব্রম্ন কুচকে জিজ্ঞেসা করা হয়। বিশেষ করে রোজার মুহূর্তগুলো নারীদের জন্য হয়ে উঠে লুকোচুরি খেলা। রোজা বা নামাজ পড়েছে কিনা সে বিষয়ে বারংবার তাদের প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেয়া হয়। পরিবার তথা সবখানেই তাদের লুকিয়ে খেতে বা রাখতে হয়। 'পিরিয়ড মেয়েলি ব্যাপার' বলে পুরুষদের যে চিন্তা তৈরি হয়, সেটাকেই আরও উসকে দেয়ার দরুন পরিবারের ছেলেরা মেয়েদের এ সব বিষয়ে সাহায্যের প্রতি এতটাই বিচ্ছিন্ন। কিন্তু আমাদের সমাজ এই বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই নিতে পারত। মেয়েদের এই বিষয়ে সতর্কসহ, তাদের বোঝাতে পারতো এটা কোনো লজ্জার বিষয় নয় বরং এটি নারীর স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বাংলাদেশ সরকার বিভিন্নভাবে নারীদের এই বিষয়ে সতর্ক করলেও এর সঠিক শিক্ষা থেকে এখনো পিছিয়ে অনেক নব্য বয়ঃসন্ধিতে পা দেয়া মেয়েরা। পাঠ্যপুস্তকে এই সব বিষয়ে অবগত করা হলেও শিক্ষকরা দেখা যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের পড়াতে পিছ পা হচ্ছেন। 'বাসায় পড়ে নিও' বলে তারাও বিষয়টি শিক্ষার্থীদের মাঝে আরো গোপনীয়তায় আবদ্ধ করে তুলছেন। কিন্তু এই বিষয়ে সঠিক শিক্ষা তাদেরই দেয়া প্রয়োজন। কেন না, এমন অনেক পরিবার আছে বা বিশেষ করে গ্রামীণ পরিবারগুলো এই বিষয়ে সঠিকভাবে অবগত নয়। অনেকেই স্যানিটারি প্যাডের পরিবর্তে কাপড় ব্যবহার করেন- যা কিনা জরাযু ক্যানসারসহ নানা রোগের মাধ্যম। বিশেষ করে নারীর প্রজননস্বাস্থ্য এবং মাসিকের সময় পরিচ্ছন্নতা বা নিরাপদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বাধা হচ্ছে- একটি সমাজের প্রচলিত ট্যাবু, অন্যটি স্যানিটারি প্যাডের দাম। ১০টি স্যানিটারি প্যাডের একটি প্যাকেট দরিদ্র ও সীমিত আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে। যার দরুণ ঋতুস্রাব চলাকালীন অপরিচ্ছন্ন ও অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের জন্য দেশের অধিকাংশ নারী প্রস্রাবের ইনফেকশন ও জরায়ুমুখ ক্যানসারে আক্রান্ত হন। ইউনিসেফ বাংলাদেশ ও ওয়াটারএইডের যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর সবশেষ জরিপ 'ন্যাশনাল হাইজিন সার্ভে-২০১৮'এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, সচেতনতার অভাব ও দাম বেশি হওয়ায় দেশের ৪৩ শতাংশ কিশোরী ডিসপোজিবল প্যাড, ৫০ শতাংশ পুরনো কাপড় এবং বাকিরা নতুন কাপড় ও তুলা ব্যবহার করে। প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের মধ্যে ২৯ শতাংশ ডিসপোজিবল প্যাড ও ৬৮ শতাংশের বেশি পুরনো কাপড় ব্যবহার করেন। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কি! বাংলাদেশ সরকারের এ বিষয়ে নজর দেয়া উচিত। নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি রক্ষায় স্যানিটারি প্যাডের দাম সহনীয় করা এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কি কি করণীয় সে বিষয়ে সবাইকে সচেতন করায় বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এছাড়া পিরিয়ড প্রতিটি নারীর একটি অংশ এবং এটি কোনো উপহাসের বিষয় নয়, সে বিষয়ে নানা ক্যাম্পেইন করার ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু তাই নয়, পরিবারের সদস্যদের প্রয়োজন সদ্য পিরিয়ড হওয়া মেয়ের প্রতি নজর রাখা এবং এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, লজ্জার বিষয় নয় এই বিষয়টি সঠিকভাবে অবগত করা। সমাজে সব একত্রিত হয়ে যারা মেয়েদের এ সব বিষয়ে উত্ত্যক্ত করে বা নানারকম কুরুচিপূর্ণ কথা বলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। তাছাড়া স্কুল-কলেজগামী মেয়েদের প্রতি নজর দেয়া এবং পিরিয়ড সম্পর্কে সব তথ্য তাদের জানাতে হবে। একটি সুস্থসমাজ গড়ে তুলতে হলে আমাদের একটি সুস্থ মনের প্রয়োজন। পিরিয়ড প্রতিটি নারীর অহংকার, দাম্ভিকতা, এটি কোনো উপহাস নয়।