১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। যা সর্বজনস্বীকৃত। একটি দেশে নারী পুরুষের সমান অংশগ্রহণে এগিয়ে যায় দেশ। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদে সব নাগরিককে আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমঅধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছিল। তারপর পেরিয়ে গেছে অনেক বছর। দীর্ঘদিন পর প্রণীত হয় জাতীয় নারী নীতি-২০১১।
গত দেড় দশকে চোখে পড়েছে নারীদের জন্য উলেস্নখযোগ্য কিছু উদ্যোগ। সরকার নারীদের উন্নয়নে প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত কাজ করার চেষ্টা করেছে। সে লক্ষ্যে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা ৫টি বাড়িয়ে ৫০টি করা হয়েছে। রাজনীতিতে নারীর বর্ধিত অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করার জন্য ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে নারী আসন এক-তৃতীয়াংশ উন্নীতকরণ ও সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নারী ও শিশুর সুরক্ষা আইনি সহায়তা প্রদানের জন্য পারিবারিক সহিংসতা আইন-২০১০, নারী ও শিশু নির্যাতন আইন-২০২০ প্রণয়ন করা হয়েছে। যার আলোকে কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়েছে। নারীদের কর্মপরিবেশ উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সম্প্রসারণ, প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নারী শ্রমশক্তির অংশগ্রহণের হার ২০১০-এর ৩৬ শতাংশ থেকে বেড়ে বর্তমানে ৪৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে ১ হাজার ৫৩৯ জন কর্মজীবী নারী শ্রমিকের জন্য স্বল্পমূল্যে আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নারী ও শিশুদের সেবা প্রদানের জন্য মোট ১৪টি ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস স্টোর, ৪৭টি জেলা সদর হাসপাতালে ও ২০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে ৬৭টি ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেল স্থাপন, নারী ও নির্যাতন প্রতিরোধ এবং বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে ২৪ ঘণ্টা হটলাইন সেবা ১০৯ চালু করা হয়েছে। গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের ই-কমার্সে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে ই-কমার্স মার্কেট পেস্নস 'লালসবুজডটকম' পস্ন্যাটফর্মের উন্নয়ন করা হয়েছে।
বর্তমানে সাড়ে ১৪ হাজার উদ্যোক্তা 'লালসবুজডটকম'-এ নিবন্ধন ও পণ্য আপলোড করে বিক্রয় করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গ্রামীণ সুবিধাবঞ্চিত নারীদের তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকারের লক্ষ্যে 'তথ্য আপা: ডিজিটাল বাংলাদেশ' প্রকল্প দেশের ৪৯০টি উপজেলায় বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। এর মাধ্যমে নারীদের আত্মনির্ভরশীল করা ও তাদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা হয়েছে। জেন্ডার সমতার জন্য জেন্ডার সংবেদনশীল নীতিকৌশল গ্রহণ ও তার কার্যকর বাস্তবায়নের ফলে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের জেন্ডার গ্যাপ ২০২২ সালে ১৪৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৫৯তম অবস্থানে উঠেছে।
সার্কভুক্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। কর্মজীবী মায়েদের নিরাপদ কাজ সম্পাদনের নিশ্চয়তা প্রদানের জন্য ১২৫টি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে ৫ হাজার ৭৩০ জনকে দিবাকালীন সেবা প্রদান করা হচ্ছে। নারীর জন্য শোভন কর্ম সৃজনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। নারীদের আত্মকর্মসংস্থান ও আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে ৬৪টি জেলার ৪৮৮টি উপজেলার মাধ্যমে ২.২৭ লাখ জনকে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করা হয়েছে। নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে কোনো জামানত ছাড়াই সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা এসএমই ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে মেয়েদের ভর্তির হার এখন ৫১ শতাংশ এবং মাধ্যমিকে তা ৫৩ শতাংশ। শিক্ষা খাতের পাশাপাশি অর্থনীতিতে বাংলাদেশের নারীদের অংশগ্রহণ দৃশ্যমান। জিডিপিতে নারীর অবদান প্রায় ২০ শতাংশ। কর্মজীবী নারীর অংশগ্রহণ সহজ করতে মাতৃত্বকালীন ছুটি ১৮০ দিন এবং ডে কেয়ার সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। প্রান্তিক নারীদের স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে খোলা হয়েছে গ্রামভিত্তিক কমিউনিটি ক্লিনিক। সব জেলায় নারী নির্যাতন সংশ্লিষ্ট মামলা মোকদ্দমার জন্য জেলা জজের সমমর্যাদায় পৃথক আদালত স্থাপন করা হয়েছে।
এত উন্নয়নের পরও একজন নারী হিসেবে সরকারের কাছে প্রত্যাশা অনেক। কারণ, বিশ্ব অনেক এগিয়ে গেছে। সেই সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে নারীসমাজ। বাংলাদেশ ও তার ব্যতিক্রম নয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। নতুন সরকার শিগগিরই শপথগ্রহণ করবে। একজন নারী ভোটার হিসেবে নতুন সরকারের কাছে কিছু নিবেদন রইল। আশা করি, নতুন সরকার আমদের নিবেদন গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে নারীর অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে কাজ করবে।
আমরা চাই, নতুন সরকারের উন্নয়ন ও প্রশাসন কার্যক্রম নারীনীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করে প্রণীতধারা অব্যাহত থাকুক। নারীর ক্ষমতায়ন, জেন্ডার সমতা, অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং নারীর উন্নয়নে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির কার্যক্রমে অব্যাহত থাকুক। গ্রামীণ নারীদের সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং শ্রমে অংশগ্রহণ সুযোগ বৃদ্ধি করা হোক। কর্মক্ষেত্রে নারীদের নিরাপত্তা, কর্মবান্ধব পরিবেশ, মাতৃত্বকালীন ছুটি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হোক। শিশুদের জন্য ডে কেয়ার সেন্টার ঢাকা ও জেলা সদরে হোস্টেল নির্মাণ কর্মসূচির বাস্তবায়নও অব্যাহত থাকুক।
নারী, শিশু পাচার কঠোর হাতে দমন করবে নতুন সরকার। ই-কমার্সের সঙ্গে সংযুক্ত নারীদের বা নারীর মালিকানাধীন ব্যবসার জন্য অনুদান ঋণও বিনিয়োগ উদ্যোগের মাধ্যমে পুঁজির অভিগম্যতা সহজতর করা হোক। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নারী শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ ৩৬.৩০ শতাংশ থেকে আরও অনুপাত বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করবে নতুন সরকার। জয়িতা ফাউন্ডেশনের সব কার্যক্রম ঢাকার ভেতরে সীমাবদ্ধ না রেখে সব বিভাগীয় সদরে এবং জেলা উপজেলা পর্যায়ে নারীবান্ধব বিপণন অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। নারী নির্যাতন সংশ্লিষ্ট পৃথক আদালতের মাধ্যমে বাদীপক্ষকে সরকারি খরচে আইন সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থাকে কার্যকরী করে তুলবে। বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন-২০১৭ কার্যকর করার ব্যাপারে অধিকতর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তাছাড়া সাইবার বুলিং থেকে নারীকে নিরাপত্তা এবং নারীর প্রতি নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে নতুন সরকার, এই প্রত্যাশা।
বর্তমানে বিশ্বের মধ্যে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ নবম স্থান অধিকার করেছে। ধীরে ধীরে এই অবস্থান শীর্ষ তিনের মধ্যে নিয়ে আসার জন্য কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের নারীরা এখন রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে শুরু করে সমাজের নানা স্তরে নিজেকে বিকশিত করছেন তাদের মেধা ও দক্ষতার মাধ্যমে। নতুন সরকার নারীদের ক্ষমতায়নে রাষ্ট্রের সব স্তরে অংশগ্রহণ এবং শতভাগ নারী নির্যাতনমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য লেভেল পেস্নয়িং ফিল্ড তৈরি করতে সক্ষম হবে এই প্রত্যাশা করছি।
গ্রাম-বাংলায় কনকনে শীত উপেক্ষা করে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতি, সাংসারিক ব্যস্ততা রেখে ভোটকেন্দ্রে যাওয়া, বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া নারী ভোটারদের প্রত্যাশা নতুন সরকারের কাছে অনেক। কোনো কোনো ভোটকেন্দ্রে পুরুষের আগেই নারী ভোটারদের উপস্থিতি লক্ষণীয় ছিল। এসব নারী ভোটারের উপস্থিতির প্রতি কৃতজ্ঞতায় নতুন সরকার প্রতিদান হিসেবে নারীদের পাশে থাকবে এই আশা। কোনো কোনো কেন্দ্রে স্বামী, সন্তানের কোলে বা হুইল চেয়ারেও নারীরা এসেছেন ভোট দিতে- যা আমি স্বচক্ষে দেখেছি। আমাদের নারী সমাজের প্রত্যাশা কম, একটি শোষণমুক্ত সমাজ আমাদের কাম্য। সেই সঙ্গে নারী তার প্রাপ্য সম্মান এবং অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারলেই খুশি। সম্পদের ন্যায্যহিস্যা, নির্যাতনের বিভীষিকা থেকে মুক্তি এবং শিক্ষায় সমানাধিকারই নারী ভোটারদের কাম্য।