মাতৃভূমির স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন এক সাধারণ নারী। তার নাম রোশনী বেগম। তিনি ছিলেন মহীশূূরের একজন রাজ-নর্তকী। নাচের মাধ্যমে ভারতীয় সৈন্যেদের ব্রিটিশবিরোধী যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য অনুপ্রাণিত করেন। তার প্রত্যক্ষ অনুপ্রেরণায় একদল ভারতীয় সৈন্য বিদ্রোহ করে এবং মৃতু্যভয়কে তুচ্ছ জ্ঞান করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
এই রোশনী বেগমের জন্ম ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের আদানি নামক গ্রামে। তার তখন নাম ছিল পুম কুসুর। পরিবার থেকেই নাচগানে পারদর্শিতা লাভ করেন এই কন্যা। তারপর অপূর্ব সুন্দর এই কন্যা ১৭৭০-এর দশকের কোনো এক সময়ে এক বোনসহ মহীশূরের রাজপ্রাসাদে রাজ-নর্তকী হিসেবে যোগ দেন। কিছু দিনের মধ্যেই তিনি নিজ গুণে মহীশূরের রাজপুত্র টিপু সুলতানের কাছাকাছি আসার সুযোগ পান। কথিত আছে এ সময়েই তাদের বিয়ে হয় এবং তাদের এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। যার নাম দেয়া হয় ফতেহ্ আলী হায়দার।
সে যাক, পিতা হায়দার আলীর মৃতু্যর পর ১৭৮২ সালে টিপু সুলতান মহীশূরের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তার পরপরই 'মহীশুরের বাঘ' নামে খ্যাত স্বাধীনচেতা টিপু সুলতান ইংরেজদের আগ্রাসনের তীব্র প্রতিবাদ জানান। তিনি মহীশূর থেকে ইংরেজদের বিতাড়নের জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করেন। যুদ্ধের একপর্যায়ে টিপু সুলতান নিজেই সৈন্য পরিচালনার দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেন। কিন্তু ইংরেজরা নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে মহীশূরের সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে দেয়। এ অবস্থায় বীরের মতো যুদ্ধ করতে করতে ১৭৯৯ সালে যুদ্ধ ক্ষেত্রেই নিহত হন টিপু সুলতান।
তারপর ইংরেজরা টিপু সুলতানের রাজবংশকে ধ্বংস করে ফেলার জন্য রাজপ্রাসাদের সব নারীকে বন্দি করে নিয়ে যায় মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির ভেলোর দুর্গে। এই শত শত নারীদের মধ্যে একজন ছিলেন রাজ নর্তকী এবং টিপুর প্রথম স্ত্রী রোশনী বেগম। যদিও তাকে সত্যিকার অর্থে টিপু সুলতানের স্ত্রীর মর্যাদা দেয়া হয়নি কখনো।
ভেলোর দুর্গে থাকাকালীনই রোশনী বেগম গুয়েজির নামক একটি মেয়েকে দত্তক নেন। তাকেও তিনি নাচগানে পারদর্শী করে গড়ে তোলেন। সেখানেই রোশনী বেগম একদল মেয়েকে নিয়ে গড়ে তোলেন নাচগানের দল। আশপাশের মেয়েরাও সে দলে যোগ দেয়। ১৮০৬ সালে রোশনীর দলে নাচে গানে যোগ দেয়া মেয়েদের সংখ্যা দাঁড়ায় আটাশ থেকে নয়শত পর্যন্ত। রোশনী বেগম তাদের সবাইকে নাচগানের পাশাপাশি দেশপ্রেমে দীক্ষিত করেন। নাচের মাধ্যমে ভারতীয় সৈন্যদের স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করার কৌশলও আয়ত্ব করে এই নাচের দলের মেয়েরা।
এই খবর পৌঁছে যায় মাদ্রাজের গভর্নর উইলিয়াম বেন্টিকের কাছেও। বেন্টিক তখন রোশনী বেগমসহ রাজ পরিবারের মেয়েদের ভাতা কমিয়ে দেন। রোশনীর দলের মেয়েদের সংখ্যা কমানই ছিল এ সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য। এতে খুবই অপমানিত বোধ করেন রেশনী বেগম। তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এ সময়েই টিপু সুলতানের চার কন্যার বিয়ের আয়োজন করা হয়। এসব বিয়ের অনুষ্ঠানেও আয়োজন করা হয় জমকালো নাচগানের অনুষ্ঠানে। এসব অনুষ্ঠানে নাচের মাধ্যমে ইংরেজ শাসনের ফলে সৃষ্ট দুর্দশাসমূহ তুলে ধরা হয়। নাচগানের মাধ্যমে ভারতীয়দের ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়। অনুষ্ঠানের পূর্বেই এ লক্ষ্যে স্ক্রিপ্ট তৈরি করা হয় এবং অনুশীলন করা হয়।
এসব অনুষ্ঠানে ভারতীয় সৈন্যদের ব্রিটিশদের পক্ষে আনুগত্যে আঘাত করা হয়। নাচের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেয়া হয়, 'ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেয়া পোশাক, মাথার টুপি পরিধান করা গোলামির শামিল। এটা ভারতীয়দের জন্য অপমানজনক। এই সৈন্যদের কারণেই ব্রিটিশরা ভারতে থাকতে পারছে এবং লুটপাট চালাতে পারছে। এমন একদিন আসবে, তখন এ দেশের মানুষ খাবার পাবে না, বস্ত্র পাবে না। সবকিছু ব্রিটিশরা লুটপাট করে নিয়ে যাবে। এ জন্য কোনো ভারতীয় মেয়ে এই সৈন্যদের বিয়ে করতেও চায় না, ঘৃণা করে সবাই'।
\হরোশনী বেগম ও তার দলের এসব নাচগান ভারতীয় সৈন্যদের মনে দারুণ প্রভাব ফেলে। তারাও মনে মনে বিদ্রোহ করার কথা চিন্তা করতে থাকে। এরকমই এক নাচের অনুষ্ঠান শেষে একদিন ভারতীয় সৈন্যদের একটি দল ভেলোর দুর্গে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তারা দুর্গ থেকে ব্রিটিশদের পতাকা নামিয়ে ফেলে এবং তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারপর সেখানে তারা মহীশুরের পতাকা উড়িয়ে দেয়া। একই সঙ্গে তারা রোশনী বেগমের ছেলে ফতেহ্ আলী হায়দারকে নিজেদের রাজা বলে ঘোষণা দেয়। এ সময়ে তারা দুর্গের দখল নেয়ার জন্য একশত ত্রিশজনের মতো ইংরেজ সৈন্যকে হত্যা করে।
এ ঘটনা ব্রিটিশ সেন্যদের মধ্যে দারুণ ক্ষোভের সৃষ্টি করে। বিচলিত হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। অনতিবিলম্বে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির ইংরেজ সৈন্যরা এসে ভেলোর দুর্গ ঘিরে ফেলে এবং হামলা শুরু করে। ভেঙে যায় ভেলোরে ভারতীয় সৈন্যদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। ইংরেজ সৈন্যরা ৬০০-৮০০ বিদ্রোহী সৈন্য ও তাদের সমর্থককে হত্যা করে এবং দুর্গের দখল নেয়।
তারপর ইংরেজ বাহিনী টিপুর কয়েকশ' আত্মীয়স্বজনকে বন্দি করে এবং নির্মমভাবে টানাহেঁচড়া করে দুর্গ থেকে বের করে কলকাতার দিকে পাঠিয়ে দেয়। এ সময়ে রোশনী বেগমের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা অজানাই থেকে যায়।
রোশনী মানে আলো। আদানি নামক এক স্থান থেকে উঠে আসা এই রোশনী আলোই ছড়িয়েছেন। স্ত্রীর মর্যাদা না পেলেও তিনি টিপু সুলতানের সন্তানের মা' হয়েছেন। আর তার দু্যতি ছড়িয়েই তিনি ভারতীয় সেনাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে। তারা তাই করেছে এবং দেশ মাতৃকার জন্য জীবন বিসর্জন দিয়েছে। এ ঘটনা ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে ভারতে ইংরেজ শাসনের। অসামান্য নারী এই রোশনী বেগমের বুদ্ধিমত্তা আর বীরত্বগাথা ইতিহাসে তেমন আলোচিত হয়নি। তবে, অধুনা, ব্রিটিশ লাইব্রেরির এক গবেষণা জানান দিয়েছেন রোশনীর এ অসামান্য অবদানের কথা। হয়ত একদিন রোশনী বেগমও স্থান করে নেবেন ইতিহাসের পাতায়, মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গকারী হিসেবে।
আশা করা যায়, অচিরেই তাকে যথাযোগ্য সম্মান জানাবে আলোর পথে এগিয়ে আসা পরবর্তী প্রজন্ম।