বীরকন্যা আত্মঘাতী নারীযোদ্ধা কিইলি
প্রকাশ | ০৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
তপন কুমার দাশ
ভারতবর্ষের এক অসীম সাহসী কন্যা বীরযোদ্ধা কিইলি। ব্রিটিশদের কবল থেকে নিজ মাতৃভূমি রক্ষার জন্য হতদরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া এই কন্যা নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন ব্রিটিশ সৈন্যদের অস্ত্রাগারে। ধ্বংস করে দেন গুদামের সব গোলা বারুদ। অস্ত্রভান্ডার হারিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে প্রাণ নিয়ে পালায় ইংরেজ বাহিনী ও তাদের দেশীয় দোসররা। শত্রম্নমুক্ত হয় শিবগঙ্গা রাজ্য এবং পুনরায় রাজ সিংহাসনে আরোহণ করেন রানী ভ্যালু নাছিয়ার। সম্ভবত, এটাই বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের ইতিহাসে প্রথম আত্মঘাতী বোমা হামলা। আর এ ইতিহাসের মহানায়ক বীরকন্যা কিইলি।
কিইলি জন্ম নেন ১৭০০-এর দশকে বর্তমান তামিলনাড়ুর শিবগঙ্গা জেলার কুঞ্চাবাদী কৃষক পরিবারে। কিইলির মা রাকুও ছিলেন এক অসীম সাহসী নারী। বন্য ষাঁড়ের হাত থেকে গ্রামের ফসল রক্ষা করতে গিয়ে তিনি জীবন দেন। কিইলির বাবা তখন মেয়েকে নিয়ে শিবগঙ্গাইতে চলে আসেন এবং সেখানে জুতা সেলাই করার কাজ শুরু করেন। আর কিইলি যোগ দেন শিবগঙ্গাইয়ের রানী ভ্যালু নাছিয়ারের সেনা দলে।
কিছুদিনের মধ্যেই কিইলি নিষ্ঠা সাহস ও যোগ্যতার পরিচয় দেন। এতে সন্তুষ্ট হয়ে রানী তাকে রানীর গার্ড রেজিমেন্টের সেনাপতির দায়িত্ব প্রদান করেন। এ সময়ে কিইলি অসীম সাহস আর ক্ষিপ্ততার সঙ্গে সব অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন করেন। বারবারই তিনি নিজের জীবন বিপন্ন করে নানা আক্রমণ থেকে রানীর জীবন রক্ষা করেন। একবার এক যুদ্ধকালীন ঘুমের মধ্যে রানীকে হত্যার চেষ্টা চালায় শত্রম্নরা। কিইলি সেবারেও নিজ জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে অসি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন শত্রম্ন সেনার ওপর। তার অসির আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় শত্রম্নর সব পরিকল্পনা। সে সময়ে মারাত্মকভাবে আহত হন কিইলি। তবে তাতেও তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে সমান তালে অসি চালিয়েছেন শত্রম্নদের ওপর। কথিত আছে রানীর মতো পোশাক পরিধান করে এই বীর নারীযোদ্ধা যুদ্ধের সময়ে সৈন্য পরিচালনা করতেন, আর সবার সন্মুখ থেকে এগিয়ে যেতেন শত্রম্নবাহিনীর দিকে বীরদপে। এতে সেনাদলের সাহস বেড়ে যেত কয়েক গুণ। কিইলির সঙ্গে থাকতো তার অনুগত নারী সৈন্যের একটি দল। তারা সবাই ছিল দেশ মাতৃকার মন্ত্রে উজ্জীবিত।
সে যাক, ১৭৭২ সালে শিবগঙ্গাইয়ের রাজা মুথুভাতুগানাথ থেবার ইংরেজদের ষড়যন্ত্রের কারণে পূর্ব শত্রম্নতার জের ধরে আর্কেটের নবাবের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। ব্রিটিশ বাহিনীও নবাবের পক্ষে এ যুদ্ধে যোগ দেয়। ফলে রাজা থেবার পরাজিত ও নিহত হন। এরপর থেবারের স্ত্রী ভ্যালু নাছিয়ার রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু এক পর্যায়ে তাকে রাজ্য ছাড়তে হয় এবং তিনি তখন ভিরুপাচির কাছে হিন্দিগুলে চলে যান। সেখানে তিনি সেনাদল গঠন করেন ও হারানো রাজ্য শত্রম্নমুক্ত করার লক্ষ্যে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। এ সময়ে রানী পার্শ্ববতী রাজা গোপাল নায়কার এবং মহিশূরের হায়দার আলীর সঙ্গে জোটবদ্ধ হন। ১৮৮০ সালে রানী তার সেনাদল নিয়ে শিবগঙ্গাইয়ের দিকে রওনা দেন এবং ব্রিটিশ সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ব্রিটিশ সৈন্যদলও যুদ্ধে যোগ দেয়, শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। কিন্তু আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ইংরেজ সৈন্যদের সঙ্গে রানীর সৈন্যদের টিকে ওঠা মুশকিল হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় যুদ্ধ জয়ের বিকল্প উপায় খুঁজতে থাকেন রানী এবং যুদ্ধের অন্যতম সেনানায়ক কিইলি। এক পর্যায়ে তারা ব্রিটিশদের অস্ত্র গুদামের সন্ধান পান। সঙ্গে সঙ্গেই আত্মঘাতী হামলার জন্য মনস্থির করেন কিইলি। তার শরীরে তেল ও ঘি ঢেলে দেওয়ার জন্য তিনি তার সৈন্যদলকে নির্দেশ দেন। তারপর নিজ শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে এ বীরকন্যা ঢুকে পড়েন ব্রিটিশদের অস্ত্রাগারে, গোলা বারুদের গুদামে। মুহূতেই বিস্ফোরণ ঘটে, ধ্বংস হয়ে যায় অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ। নিঃশ্বেষ হয়ে যায় ব্রিটিশদের সব শক্তির উৎস। হতোদ্যম হয়ে রণেভঙ্গ দেয় ব্রিটিশ বাহিনী, সরে যায় শিবগঙ্গাই এলাকা ছেড়ে। তারপর রানী ভ্যালু নাছিয়ার সিংহাসনে বসেন ১০ বছর রাজ্য শাসনের পর ১৮৯০ সালে মারা যান।
সম্ভবত, কিইলির এই হামলাই সারা বিশ্বে আত্মঘাতী বোমা হামলার প্রথম দৃষ্টান্ত। আর এ দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন এ আদিবাসি কন্যা, বীরযোদ্ধা কিইলি।
অনেকে বলে, ইতিহাস ব্যক্তি নিরপেক্ষ নয়। ইতিহাস রাজা-রাজড়াদের কথা বলতেই বেশি পছন্দ করে। হয়ত সে কারণেই কিইলির এ বীরত্ব আর আত্মত্যাগের কথা ইতিহাসে চিত্রিত হয়নি তেমনভাবে। তেমন করে আঁকা হয়নি এ বীরত্বগাথার রূপকার এ বীরকন্যার একটি পোট্রেটও। অনেকেই জানে না প্রায় আড়াই শত বছর আগে দেশের জন্য এ বীর নারীর আত্মদানের কথা।
তবে, এরই মধ্যে তামিলনাড়ু সরকার কিইলির অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ শিবগঙ্গায় একটি স্মারক নির্মাণ করেছে। যা দেখে হয়ত অনুপ্রাণিত হয় বর্তমান প্রজন্ম, মনে করে কিইলির কথা শ্রদ্ধাভরে।