শেখ হাসিনা
শেখ হাসিনা পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে অনন্য রেকর্ড সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন বিশ্বরাজনীতিতে। বিশ্বে শেখ হাসিনাই সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতাসীন নারী সরকারপ্রধান। ১৯৮১ সাল থেকে দেশের অন্যতম প্রাচীন দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আছেন। দেখেছেন অনেক সংকট, পেরিয়েছেন চড়াই-উতরাই। ছুঁয়েছেন সাফল্যের চূড়া। স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছার জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ হাসিনা। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। এ সময় বিদেশে ছিলেন শেখ হাসিনা ও তার ছোটবোন শেখ রেহানা। দীর্ঘ নির্বাসন শেষে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন শেখ হাসিনা। তৎকালীন কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে সেদিন লাখো জনতা বৃষ্টি উপেক্ষা করে তাকে স্বাগত জানান। তার রাজনৈতিক কর্মজীবন চার দশকেরও বেশি সময় বিস্তৃত। আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে থাকা অবস্থায় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ নানা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন শেখ হাসিনা। দীর্ঘ ২১ বছর পর তার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধুকন্যা ২০০৮ সালে জনগণের বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হন। সে সময় থেকে টানা তিন মেয়াদে (২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সাল) প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে রয়েছেন তিনি। এবার বিজয়ী হয়ে টানা চার মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন তিনি। দেশের ইতিহাসে এমন রেকর্ড আর কারও নেই। ফোর্বস সাময়িকীর দৃষ্টিতে, বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ১০০ নারীর তালিকায় ২০২০ সালে তার অবস্থান ছিল ৩৯তম, ২০১৯ সালে তার অবস্থান ছিল ২৯তম, ২০১৮ সালে ২৬তম এবং ২০১৭ সালে ৩০তম। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফরেন পলিসি নামক সাময়িকীর করা বিশ্বব্যাপী শীর্ষ ১০০ বৈশ্বিক চিন্তাবিদের তালিকায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা জায়গা করে নিয়েছেন।
ইন্দিরা গান্ধী
পন্ডিত জওহরলাল নেহরুর কন্যা ইন্দিরা গান্ধী। ভারতের ইতিহাসে তিন মেয়াদে ক্ষমতায় ছিলেন ১৫ বছরের কিছু বেশি সময়। প্রথমবার দুই মেয়াদে অর্থাৎ ১৯৬৬ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৭৭-এর মার্চ টানা ১০ বছর ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয় মেয়াদে ১৯৮০ সালের ১৪ জানুয়ারি আবার প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হন। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদের ক্ষমতা শেষ হওয়ার আগে ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর আততায়ীর গুলিতে নিহত হন ভারতের এই স্বর্ণকন্যা। ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন ভারতের তৃতীয় এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র নারী প্রধানমন্ত্রী। তার ছাত্রজীবন কেটেছে সুইজারল্যান্ডে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। শৈশবে তিনি 'বাল চড়কা সংঘ' প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৪ সালে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর মৃতু্যর দুই বছর পর কন্যা ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় আসেন। ইন্দিরাকেও বাবার মতো একই সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছিল। বিরোধীরা ইন্দিরাকে কর্তৃত্ববাদী বলে সমালোচনা করলেও ব্যাপক সামাজিক কর্মসূচির কারণে তিনি দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ১৯৬৪-৬৬ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ছিলেন। এরপর ১৯৬৭-১৯৬৯ পর্যন্ত সামলেছেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। ১৯৬৭-১৯৭৭ পর্যন্ত পরমাণু শক্তিবিষয়ক দপ্তরের মন্ত্রী পদে কাজ করেন। ১৯৭০-১৯৭৩ পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া ১৯৭২-১৯৭৭ পর্যন্ত মহাকাশ দপ্তরের মন্ত্রী হিসেবেও কাজ করেছেন। ১৯৮০ সালে তিনি যোজনা কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। ১৯৬০-৬৪ সাল পর্যন্ত ইউনেস্কোর ভারতীয় প্রতিনিধিদলেও তিনি ছিলেন। রাষ্ট্র সংঘের সদর দপ্তরে তার উপস্থিতি ছিল উজ্জ্বল। এমনকি বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা বিদেশি ব্যক্তিটি এই ইন্দিরা গান্ধী।
১৯৭৫ সালের ২৪ অক্টোবর আইসল্যান্ডের রাজধানী রেইকাভিকের সমান অধিকারের দাবিতে রাস্তায় নামে হাজার হাজার মহিলা। যাদের মধ্যে ছিলেন ভিগদিস ফিনবগাদত্তিরও; যিনি পরে আইসল্যান্ডের প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট হন এবং তিনি ১৬ বছর আইসল্যান্ডের ক্ষমতায় ছিলেন। তখন তিনি ছিলেন রেইকাভিক থিয়েটার কোম্পানির আর্টিস্টিক ডিরেক্টর।
সে সময় তার স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়িও হয়ে গিয়েছিল এবং তিনি একাই সন্তান প্রতিপালন করছিলেন। সেই ভিগদিস ফিনবগাদত্তিরই ১৯৮০ সালে আইসল্যান্ডের প্রথম নারী হিসেবে নির্বাচনে জয়লাভ করেন। সেবার নির্বাচনে তিনি ৩৩ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন। সেবার ভিগদিস শুধু আইসল্যান্ডের নন; বরং বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম নারী রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতায় আসেন। এমনকি ইউরোপেরও প্রথম নারী রাষ্ট্রপতি ছিলেন ভিগদিস। ভিগদিস আইসল্যান্ডে এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে, পরবর্তী সময়ে নির্বাচনের দৌড়ে তিনি তিনবার পুনর্র্নিবাচিত হয়েছিলেন। এর মধ্যে দুবার সম্পূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং শেষবার ৯৬ শতাংশের বেশি ভোটে নির্বাচনে জয় পেয়েছিলেন। দীর্ঘ ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও বিশ্ব রাজনীতিতে ভিগদিস খুব বেশি আলোচিত নন। তবে আইসল্যান্ডের ম্যাগ থেকে জানা যায়, ভিগদিসই প্রথম রাষ্ট্রপতি যিনি শিশু দত্তক নিয়েছিলেন। ভিগদিস ফিনবগাদত্তির ছিলেন ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি নির্বাচিত নারী রাষ্ট্রপ্রধান এবং সমকামিতাকে অনুমোদন দেওয়া আইসল্যান্ডের একমাত্র নারী রাষ্ট্রপতি। তার শাসনামলে দেশ-বিদেশে দেশটির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিল। দেশটির ইতিহাসে আরেকজন নারী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন- তার নাম জোহানা সিজুরগাদাতির।
চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা
শ্রীলঙ্কার জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়ক তিনি। তিনি শ্রীলঙ্কার সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রীর কন্যা। মা সিরিমাভো বন্দরানায়েক যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তিনি তখন ভূমি সংস্কার কমিশনের পরিচালক এবং ওয়াসা কমিশনের চেয়ারপারসন ছিলেন। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে পড়াশোনা শেষ করা চন্দ্রিকা ১৯৯৩ সালে দেশটির মূল-ধারার রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯৭৪ সালে শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টির সক্রিয় কর্মী হিসেবে মহিলা লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য হন। ১৯৭২-৭৬ সালে তিনি ভূমি পুনর্গঠন কমিশনের প্রধান পরিচালক ছিলেন। ১৯৭৬-৭৭ সালে জনভাষা কমিশনের চেয়ারম্যান এবং ১৯৭৬-৭৯ মেয়াদে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার পরামর্শকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৪ সালে তিনি শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
এর বাইরেও চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা ছিলেন শ্রীলঙ্কার পঞ্চম রাষ্ট্রপতি। ১১ বছর রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ১৯৯৪ এবং ১৯৯৯ সালে তিনি নির্বাহী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দুবার নির্বাচিত হন। ২০০৫ সাল পর্যন্ত চন্দ্রিকা শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টির (এসএলএফপি) দলীয় প্রধান ছিলেন। শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টি ত্যাগ করে স্বামী বিজয় কুমারাতুঙ্গার দল শ্রীলঙ্কা মহাজন পার্টিকে সমর্থন দেন। স্বামীর মৃতু্যর পর দেশত্যাগ করে যুক্তরাজ্যে চলে যান ও জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নমুখী অর্থনীতি গবেষণা বিশ্ব সংস্থায় কাজ করেন। দেশের দীর্ঘ সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরিবারে তার জন্ম। বাবা সলোমন বন্দরনায়েক ছিলেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী।