মানবসন্তান হিসেবে একটি শিশু জন্ম নেওয়ার পর থেকে শুরু হয় ছেলেসন্তানকে পুরুষ এবং মেয়েসন্তানকে নারীরূপে দ্বিতীয়বার জন্ম দেয়া। নারী ও পুরুষ হয়ে ওঠে দুই সংস্কৃতির অধিবাসী। তাদের জীবন, জগৎ, অভিজ্ঞতা, স্বপ্ন হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন। শৈশব থেকেই বাবা-মা, সমাজ-সংস্কৃতি-সভ্যতা শেখায় কার মেজাজ কেমন হবে, তারা হাসবে, দাঁড়াবে, বসবে কীভাবে, পালন করবে কে কী ভূমিকা, আর কার হবে কী মর্যাদা বা অবস্থান। দুটি মানুষকে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় নারী ও পুরুষ করে তোলা হয়। তাদের শৈশব থেকেই অভ্যস্ত করে তোলা হয় নারী বা পুরুষের ভূমিকায়। প্রতিটি সংস্কৃতি চায় ছেলেরা হবে সক্রিয়, পেশিশক্তিসম্পন্ন, আক্রমণাত্মক; আর মেয়েরা হবে নিষ্ক্রিয়, অন্তর্মুখী বা আত্মসমর্পণাত্মক। নাম রাখার ক্ষেত্রেও বিশেষ ভাবনা, মেয়েসন্তানের নাম মেয়েলি শোনাতেই হবে।
সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত শারীরিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পুরুষের শরীর পেশল হয়, এটা অনেকটা জৈবিক। কিন্তু সাংস্কৃতিকভাবেই খাদ্য, ব্যায়াম খেলাধুলার ধরন প্রভৃতির সাহায্যে নিজের পেশি গঠনে উৎসাহ দেয়া হয় পুরুষকে, ধরে নেওয়া হয় পেশিতে পুরুষের অধিকার জন্মগত। অন্যদিকে, নারীকে তার স্ফীত মাংস নিয়ে বিব্রত রাখা হয়, তাকে নমনীয় কোমলমতি, লাজুক, বিনয়ী, মৃদুভাষী, সর্বংসহা মৃত্তিকা মনোভাব চাপিয়ে গড়ে তোলা হয়। পেশিশক্তি অর্জন করে নারীর আত্মবিশ্বাসী ও বলিষ্ঠ হয়ে ওঠা পিতৃতন্ত্রের কাম্য নয়। কিন্তু পুরুষাধিপত্য পেশিশক্তির ওপর নির্ভরশীল হওয়া কতটা যৌক্তিক? প্রকৃতপক্ষে আধুনিককালে প্রযুক্তির ব্যবহারে পেশির মূল্য বেশ কমে গেছে, পৃথিবী চলে বুদ্ধিশক্তিতে। বুদ্ধিমান নারীর পরামর্শ স্বাচ্ছন্দ্যে অবহেলা করা হয়, নির্বোধ পুরুষের পরামর্শ শিরোধার্য। অথচ নারী-পুরুষ উভয়ের বুদ্ধিশক্তির সমন্বয় হলে সমাজ, জাতি, দেশ সর্বোপরি বিশ্ব অনেক এগিয়ে যেত।
আমাদের সমাজব্যবস্থায় আদর্শ নারীর শর্ত- সে পতিপ্রাণা, স্বামী-সন্তানের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেবে, পরিবারের জন্য আত্মবিসর্জন নারীর বৈশিষ্ট্য। নারী কাজ করে- তবে নিজের জন্য নয়, সে কাজ করে স্বামী, সন্তান ও পরিবার-পরিজনের জন্য। গৃহের চার দেয়ালের মধ্যে নারী উদয়াস্ত যে কঠোর পরিশ্রম করে, তার মেহনতের পরিমাণ পুরুষ অপেক্ষা অনেক বেশি। তবু নারীকে পরগাছা ভাবা হয়; কারণ সংসারে নারীর কর্মের কোনো অর্থনৈতিক মূল্য দেয়া হয় না। কেবল নির্দিষ্ট একটি দেশেই নয়, নারীরা দুনিয়ার সর্বত্রই দরিদ্র ও নিপীড়িত। বিভিন্ন পিতৃতান্ত্রিক সমাজে পুরুষরা নানাভাবে নারীর অর্থনৈতিক ও উৎপাদনমূলক শ্রমকে আত্মসাৎ করে। নারীকে পরিচয় করানো হয় স্বামী বা সন্তানের পরিচয়ে, তার পৃথক অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না। পুরুষের অধীনতার নাগপাশে আবদ্ধ নারীকে পরিবার আত্মীয়স্বজন বা বাইরের কোনো ব্যাপারে নীতিনির্ধারণ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা দেয়া হয় না। বর্তমান সময়ে বহুসংখ্যক নারী স্বাবলম্বী হয়েও অধিকাংশের উপার্জনে পুরুষের আধিপত্য বিদ্যমান। বুদ্ধিবিবর্জিত, নির্বোধ মেয়েছেলে, ভাবাবেগতাড়িত অস্থির চিত্ত নারী হিসেবে তুলে ধরে তাকে বশে রাখা পুরুষতন্ত্রের উদ্দেশ্য। 'নারীকে তার মতামত প্রতিষ্ঠার সুযোগ দিলে সমাজের অনর্থ ঘটবে'- ধর্মীয় অনুশাসনের নামে এমন ধারণা প্রচার করা হয়।
নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত স্বপ্ন দেখেছিলেন- নারীরা সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হবে, রাষ্ট্রের কর্ণধার নারী হবে, বিচারকের আসনে নারী বসবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষা ও যোগ্যতায় নারী সে ক্ষমতার অধিকারী হলেও- সামগ্রিকভাবে এবং সামাজিক অবস্থানগত দিক থেকে নারী মর্যাদা পায়নি। কেবল ক্ষুধা নিবৃত্তির উপায়স্বরূপ ঘরের বাইরে কর্মক্ষেত্রে নারীকে কাজ দেয়া হচ্ছে, কিন্তু পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ উলেস্নখযোগ্যভাবে বাড়েনি। এখনো কন্যার বিয়ে, জমি ক্রয়, ব্যবসায় মূলধন নিয়োগ এসব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নারীর মতামত মূল্যায়ন করা হয় না।
প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও তা প্রকাশে নারী দ্বিধাগ্রস্ত, নিজেকে জাহির করার সুবাদে তাকে তিরস্কার পেতে হতে পারে- সর্বদা এই আশঙ্কা নারীর মনে বিরাজ করে। বলতে দ্বিধা নেই- ছেলে এবং মেয়েসন্তানের পৃথক পৃথক ক্ষেত্রে একজন মায়ের মনোভাবেও তার নিজের অজান্তেই সূক্ষ্ণ স্বার্থপূর্ণ বৈষম্যে বিরাজ করে, এ মনোভাব সামাজিক সৃষ্টি। শেষ জীবনে ভরণপোষণ এবং অবলম্বনের তাগিদে ছেলেসন্তানকে সুস্থ ও কর্মঠ পুরুষরূপে গড়ে তোলার জন্য তার খাদ্যব্যবস্থা, পুষ্টি মেয়েসন্তানের চাইতে সেরাটা হওয়া চাই। অন্যদিকে, মেয়েসন্তানের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির বিষয়ে গুরুত্ব না দিয়ে বরং তাকে অন্যের সংসারের দায়িত্ব গ্রহণে সক্ষম, নির্যাতন সইবার ধৈর্য অর্জন কিংবা নীরবে সব কষ্ট যন্ত্রণা মেনে নেওয়ার এবং আত্মবিসর্জনের শিক্ষা দেয়া হয়।
নানা সভা-সমাবেশে শোনা যায় নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে- নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে উচ্চমহলে বেশ আলোড়ন চলে। হঁ্যা, নারীর কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি এবং কর্মক্ষেত্রে নারীর অগ্রাধিকার বাস্তবায়নে সরকার অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু সামাজিক মর্যাদায় নারী অনেক পিছিয়ে। বাস্তবিক পক্ষে নারীর স্বকীয়তা ও ধীরশক্তির মূল্যায়ন না করে, বরং তার বিকাশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়। নারীর কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন আজও হয়নি। আন্তর্জাতিক ও জাতীয় বাজারে নারীকে পণ্যের মডেল হিসেবে তুলে ধরছে মিডিয়া। এটা কী নারীকে তার স্বাধীনতা দেয়া? বরং সেলিব্রেটি হওয়ার সুযোগ দেখিয়ে স্বাধীন হওয়ার প্ররোচনা দিয়ে তার অঙ্গসৌষ্ঠব বাড়ানোর জন্য নখ, ঠোঁট ইত্যাদি রঞ্জিত করে, স্বল্পমাপের পোশাক পরিধান করার শর্ত ছুড়ে দেয় একটি ব্যবসায়ী পুরুষমহল এবং রূপের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে অবশেষে নারী হয়ে ওঠে পণ্যের সমতুল্য দর্শনীয় বস্তুতে। শ্রমিক যেমন নিজের কাছ থেকে নিজে বিচ্ছিন্ন হয়ে যন্ত্রে পরিণত হয়, নারীও তেমনি আপন ব্যক্তিসত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পুরুষ নিয়ন্ত্রিত পুতুলে পরিণত হয়। মালিক যেমন শ্রমিকের উৎপাদিত পণ্য নিয়ন্ত্রণ করে, তেমনি নারীর কাজের ফল বা শ্রমের বিনিময়ে উপার্জনের অর্থ, এমনকি নারীর শরীরটাও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নিয়ন্ত্রণ করে। নারী অধিকার নিয়ে সমাজপতিরা যতই বুলি আওড়াক না কেন, ভাবতে কষ্ট হয়- অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীর গর্ভপাত বা বন্ধ্যাকরণের সিদ্ধান্ত নারীর হাতে থাকে না।
সমাজ এটাও ঠিক করে দেয় নারীর যাতায়াতব্যবস্থা কেমন হবে। প্রয়োজনের তাগিদে কিংবা সময় স্বল্পতার কারণে কর্মস্থল পৌঁছনোর পথে একজন কর্মজীবী নারী তার পরিচিতজন বা সহকর্মীর বাইকের পেছনে চড়ে বসলে সমাজ কটাক্ষ করে দেখে, অথচ যানবাহনের ভিড়ে যখন কোনো মেয়ে বাস বা টেম্পোতে অধিক যাত্রীর চাপাচাপি সহ্য করে, এবং অপরিচিতের শরীরের ঘেঁষাঘেঁষিতে পিষ্ট হয় সমাজ তা মেনে নেয়। অচেনা ব্যক্তির অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ সমাজ মুখবুজে গ্রহণ করে। সে ক্ষেত্রে প্রতিবাদ করা মেয়েকে নানা বিব্রতকর প্রশ্নে ঝাঁঝরা হতে হয়। ধাক্কাটা ঠিক কোথায় লেগেছে, কেমন করে লেগেছে, ব্যথা পেয়েছে কিনা... এসব তামাসাপূর্ণ প্রশ্নের মাধ্যমে সব পুরুষ যাত্রীর উৎসুক দৃষ্টি পড়ে ওই মেয়েটির ওপর। এটা নারীর প্রতি অহরোজ সমাজ প্রদত্ত মানসিক নির্যাতন, যার প্রতিকার হয়নি, হচ্ছে না।
নারী স্বার্থ রক্ষা আইন কেবল পুস্তকে লিপিবদ্ধ, বাস্তবে কার্যকর হয় না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। বরং নারী নির্যাতনকারী অপরাধী কিংবা ধর্ষকের সুরক্ষার অলিখিত ব্যবস্থা করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। দুয়েকটি ক্ষেত্রে জেল-জরিমানা হলেও দুর্বিষহ জীবনযাপনের দুর্ভোগ অবস্থার কবলে নারীকেই পড়তে হয়। নারীকেই ধিক্কার দেয় সমাজ। আরও বেশি নাজেহাল হওয়ার ভয়ে অনেক পরিবার নির্যাতনের হৃদয় বিদারক ঘটনাকে অস্বীকার করতেও বাধ্য হয়।
আমাদের সমাজ রাষ্ট্র আদালত ধর্ষিতাকে নিয়ে তামাশা করে, ওই মেয়েকেই প্রমাণ করতে হবে সে ধর্ষিতা। এতে নারীর মানসিক অবস্থা বিপর্যস্ত এবং সামাজিক অবক্ষয় হুমকিস্বরূপ। বিচার বিভাগ যেন দিন দিন দুর্বৃত্তের কবলে পতিত হচ্ছে। এই তো কিছুদিন আগেও তনু হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনার তদন্তে পরীক্ষালব্ধ আলামতকে কি নিখুঁত কৌশলে নিশ্চিহ্ন করা হলো। কেন এই প্রবণতা?
নারী ভিন্ন গ্রহের কোনো প্রাণী নয়, নারী এই সমাজের মা, বোন, কন্যা। নারী মানুষ। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র গঠনে সভ্যতা নির্মাণে ঐতিহ্য সৃষ্টিতে নারীরও আছে সমান সংগ্রাম, শ্রম এবং মেধা। অনেকে ভ্রান্ত ধারণার বশে নারীবাদকে পশ্চিমা এজেন্ডা বা পুরুষের বিরুদ্ধে নারীর প্রাধান্য স্থাপন বলে মনে করে। কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক সমাজে নারীর হাতেই ছিল নেতৃত্বের দন্ড।
বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নারী উন্নয়ন নীতি এবং তা বাস্তবায়নে নানা পদক্ষেপ গৃহীত হলেও সামাজিকভাবে নারী নিষ্পেষিত। অর্থনৈতিকভাবে নারীর উন্নয়ন সাধিত হলেও আজ নারীরা দাঁড়িয়ে আছে অপমান, অসম্মানের পিলারে ঠেস দিয়ে। নারী ও পুরুষের অখন্ড ব্যক্তি সমবায় মানব সমাজের মূল কাঠামো। কিন্তু সমাজ ও সভ্যতার অপরিহার্য এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েও নারীরা আজ অবহেলিত ও বৈষম্যের শিকার।
সুষ্ঠু সমাজ, জাতি নির্মাণে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ নারীর ভূমিকা অপরিহার্য। তরুণ সমাজের বোধের জায়গায় নারী সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে হবে। তাহলে সুদূর ভবিষ্যতে নারী নির্যাতন এবং ধর্ষণের মতো সামাজিক ক্ষতচিহ্ন নির্মূল সম্ভব হবে। নারীর প্রতি অহিংসা মনোভাব তৈরির মাধ্যমে সমাজের নতুন প্রজন্মকে শিক্ষা দিতে এই সমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে। যৌতুক প্রথার চর্চা বন্ধ করতে জনমনে সচেতনতা আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। পরিশেষে নিরাপত্তার সঙ্গে কলুষমুক্ত স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য সমাজে নারীর প্রতি অন্যায় অবিচারের সঠিক বিচারকার্য পরিচালনায় সরকারকে আরও নজরদারি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রখর আবেদন জানাই।