প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধা

পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার জর্জ বার্নাড শ'

২০১৬ সালে বব ডিলান সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে পর্যন্ত জর্জ বার্নার্ড শ'একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন, যিনি একাধারে নোবেল ও অস্কার পেয়েছেন

প্রকাশ | ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

অরুণাভ সেন
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাকে উপাধি দিতে চায়, তিনি বিনীতভাবে বললেন তার নামের আগে, পেছনে উপাধির দরকার নেই। ১৯২৫ সালে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেলে স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে প্রথমে নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানালেন। কে এই ভদ্রলোক! নিজের সৃষ্টির বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি স্বরূপ পুরস্কার গ্রহণে এত অনীহা! নোবেল কমিটির একান্ত অনুরোধে পুরস্কারের পদকটি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পুরস্কারের অর্থ তিনি দান করে দেন। ১৯৩৯ সালে অস্কার পেলেন। ২০১৬ সালে বব ডিলান সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে পর্যন্ত তিনিই একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন, যিনি একাধারে নোবেল ও অস্কার পেয়েছেন। জীবনের প্রথম পর্বে লেখক হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন, প্রকাশকদের কাছে উপন্যাসের পান্ডুলিপি পাঠাতেন- তবে কেউ সেই লেখা ছাপতে রাজি হতেন না। হতাশ হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর যাই হোক তিনি কোনো দিন লেখক হওয়ার চেষ্টা করবেন না। শেষ পর্যন্ত নিজের প্রতিজ্ঞা ধরে রাখতে পারেননি, আবার লেখা শুরু করলেন- তবে উপন্যাস নয়, নাটক। আর সেই নাটক তাকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দিল। তিনি-ই পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার জর্জ বার্নাড শ'। বিশ্বের প্রথম ব্যক্তি যিনি একাধারে নোবেলজয়ী, আবার অস্কার জিতেছেন। ছোটবেলায় ধরাবাঁধা ছকের পড়াশোনা, পরীক্ষা এ সবকিছুই তার ভালো লাগত না। পাঠ্য বইয়ের থেকে বাইরের জগৎ আকর্ষণ করত। কিশোর বয়সে স্কুলের বদলে বাড়িতেই পড়েছেন সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শনের অনেক বই। তবে এসবের মধ্যে মুগ্ধ করেছিল শেক্সপীয়রের নাটক, মনে মনে ভাবতেন একদিন তার মতো মস্ত নাট্যকার হবেন। জীবনে চলার পথ মসৃণভাবে চলল না, বাবার ব্যবসায় মন্দার ফলে জমির দালালির অফিসে চাকরি নিলেন। অফিসের কাজ করেন, ফাঁকে লেখেন। পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন, তবে সেখানেও তার লেখা কেউ ছাপে না। শেষ পর্যন্ত একদিন একটি চিঠি একটি পত্রিকায় ছাপা হলো। সেটাই বার্নাড শ'য়ের জীবনের প্রথম মুদ্রিত লেখা; তখন তিনি পনেরো বছরের। চাকরিতে পদোন্নতি হলো, যদিও চাকরিটা খুব একটা ভালো লাগত না, একদিন ভাবলেন চাকরি করে নিজের জীবনের আসল লক্ষ্য থেকে সরে যাচ্ছেন। দশ পাউন্ড সঙ্গে নিয়ে লন্ডনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। তখন সবে টেলিফোন চালু হয়েছে, সেখানেই নতুন চাকরি নিলেন, কোম্পানি বন্ধ হওয়ায় বার্নাড শ'য়ের চাকরিটা চলে গেল। তবে ওই চাকরির প্রতি এমনি কোনো দিন আলাদা ভালোবাসা ছিল না, একদিক থেকে ভালো হলো, মন একদম স্থির, আর চাকরি-বাকরি নয়- লিখবেন, সাহিত্যিক হবেন। মাঝে মাঝে কিছু অর্থ পেতেন যদিও সংসার চালাবার জন্য যথেষ্ট নয়। ছয় বছরে লিখলেন ছয়টি উপন্যাস, কিন্তু পরিতাপের বিষয়, একটি উপন্যাসও প্রকাশ করার জন্য প্রকাশক পাওয়া গেল না। এ সময় বার্নাড শ' নিয়মিত ব্রিটিশ মিউজিয়ামে গিয়ে পড়তেন। বিভিন্ন স্থানে বক্তব্য রাখতেন। এভাবেই পেলেন সাংবাদিকতার চাকরি। বইয়ের সমালোচনা থেকে চিত্র, সঙ্গীতের সমালোচনা করতেন। তার সমালোচনার ভাষা, বুদ্ধিদীপ্ত রচনায় মুগ্ধ হলো ইংল্যান্ডের বিদগ্ধ সমাজ। যখন বার্নাডকে ইংল্যান্ডের মানুষ বেশ ভালোভাবেই চিনতে পেরেছে তখন একদিন বন্ধু উইলিয়াম আর্চার বললেন, ভালো নাটকের বড় অভাব। কিন্তু বাধ্য হয়ে নিন্মমানের সব নাটক মঞ্চস্থ করতে হচ্ছে। বন্ধুর কথায় নাটক লিখতে শুরু করেও লেখা শেষ করলেন না। মাঝে অনেক দিন চলে গিয়েছে অসমাপ্ত নাটক আবার লেখায় হাত দিলেন। নাটকের নাম দিলেন 'দি উইডোয়ার্স হাউসেস'। ১৮৯২ সালের ৯ ডিসেম্বর নাটক মঞ্চস্থ হলো- তবে দর্শকরা নাটককে গ্রহণ করলেন না। যদিও রাতারাতি এই নাটকটি বার্নাড শ'কে নাট্যকার হিসেবে পরিচিতি দেয়। ১৮৯৩ সাল প্রকাশিত হলো দ্বিতীয় নাটক 'দি ফিলান্ডারার'। বার্নাড শ'য়ের চতুর্থ নাটক আর্মস অ্যান্ড দি ম্যান দেখে প্রিন্স অব ওয়েলস বলেছিলেন নাট্যকার নিশ্চিত পাগল। পরপর চারটি নাটক লিখে বার্নাড শ' উপলব্ধি করলেন যত বাধা-বিপত্তি আসুক তিনি তার লক্ষ্যে অটল থাকবেন। শুরু করলেন নতুন নাটক 'ক্যান্ডিডার'। লন্ডনের স্ট্রান্ড থিয়েটারে প্রথম অভিনীত হলো নাটকটি, পেল দর্শকদের অকুণ্ঠ ভালোবাসা। আরও বেশি নাটক লিখবেন বলে সাংবাদিকতা ছেড়ে দিলেন, খ্যাতি, যশ তখন হাতের মুঠোয়। তবে এতদিনের জীবন সংগ্রামে শরীরের যত্ন নিতে পারেননি। অসুস্থ হয়ে পড়লেন; ডাক্তাররা বলেছিলেন, তিনি আর বাঁচবেন না। ততদিনে জীবনে এসেছেন চার্লোট। দিন-রাত সেবা করে বার্নাডকে সুস্থ করে তুললেন। তারপর চার্লোট হলেন বার্নাড শ'য়ের জীবনসঙ্গী। শুধু জীবনসঙ্গী বললে ভুল হবে তিনি ছিলেন স্বামীর প্রকৃত সঙ্গী, সখী, গৃহিণী, বন্ধু। 'সিজার অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা'র পরে বার্নাড শ' লিখলেন তার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক 'ম্যান অ্যান্ড সুপারম্যান'।এই নাটক অভিনীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সবাই স্বীকার করল বার্নাড শ' শুধু ইংল্যান্ডের নয়, বিংশ শতকের পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে জোয়ান অব আর্কের জীবন অবলম্বনে লিখেছেন 'সেন্ট জোয়ান'। এই নাটক বার্নাড শ'কে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষা বলে মান্যতা দিল। তার প্রকাশিত নাটকের সংখ্যা ৬২। এই নাটকগুলো তাকে বিশ্বের অন্যতম প্রতিভাবান নাট্যকারের খ্যাতি এনে দেয়। নাটকগুলো বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তার সম্পর্কে গোটা বিশ্বের মানুষের অভিমত তিনি দেশকাল জাতির ঊর্ধ্বে। তিনি বিশ্ব মানব, বিশ্ব বিবেক, তিনি বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার বার্নাড শ'। তার প্রয়াণ দিবসে, তাকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।