তিতাস তীরের জীবনচিত্র তিতাস একটি নদীর নাম
প্রকাশ | ০১ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
মারুফ হোসেন
একটি নদী কীভাবে একটি জনপদের জীবন-জীবিকা ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গিয়ে একাকার হয়ে যেতে পারে 'তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসটি পড়লে আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারি। উপন্যাসটির পরতে পরতে জীবন সংগ্রামের নিগূঢ় বাস্তবতা প্রকাশ পেয়েছে। এখানে লেখক তিতাস তীরের মালোদের জীবনযাপন ও তিতাসের ওপর তাদের নির্ভরতা ও আত্মিক সম্পর্ককে শৈল্পিক কারুকাজে চিত্রায়িত করেছেন। উপন্যাসটিকে প্রবাস খন্ড, নয়া বসত, জন্ম মৃতু্য বিবাহ, রামধনু, রাঙা নাও, দুরঙা প্রজাপতি, ভাসমান ইত্যাদি খন্ডে ভাগ করা হয়েছে। এসব খন্ড চারটি অংশে বিভক্ত। উপন্যাসটির প্রধান চরিত্রের মধ্যে রয়েছে: কিশোর, অনন্তর মা, বাসন্তী, সুবল, অনন্ত, অনন্তবালা, বনমালী ইত্যাদি।
লেখক প্রথমে তিতাস নদী নিয়ে এবং তিতাসের নাম কেনই-বা তিতাস হলো সে সম্পর্কে আলোচনাপূর্বক তিতাসের সঙ্গে তিতাস তীরের মানুষের হৃদ্যতার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। লেখকের ভাষায়: 'তিতাস একটি নদীর নাম। এ নদীর বু্যৎপত্তিগত অর্থ তার তীরের লোকেরা জানে না। জানিবার চেষ্টা কোনোদিন করে নাই, প্রয়োজনবোধও করে নাই। নদীর কত ভালো নাম থাকে- মধুমতী, ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, সরস্বতী, যমুনা। কিন্তু নদী এ নামে যত প্রিয়, ভালো একটা নাম থাকিলে তত প্রিয় হইতই যে, তার প্রমাণ কোথায়! ভালো নাম আসলে কি? কয়েকটি অক্ষরের সমষ্টি বৈ তো নয়। কাজললতা মেয়েটিকে বৈদুর্যমালিনী নাম দিলে, আর যাই হোক, এর খেলার সাথীরা খুশি হইবে না। তিতাসের সঙ্গে নিত্য যাদের দেখাশোনা, কোন রাজার বিধান যদি এর নাম চম্পকবতী কি অলকানন্দা রাখিয়া দিয়া যায়, তারা ঘরোয়া আলাপে তাকে সেই নামে ডাকিবে না, ডাকিবে তিতাস নামে। নামটি তাদের কাছে বড় মিঠা। তাকে তারা প্রাণ দিয়া ভালোবাসে, তাই এই নামের মালা তাদের গলায় ঝোলানো।'
দীননাথ মালোর মেয়ে বাসন্তীর বিয়ের কথা ছিল কিশোরের সঙ্গে। কিন্তু কিশোরের সঙ্গে তার আর বিয়ে হয় না। কারণ পাগলের সঙ্গে কে মেয়ে বিয়ে দেয়? কিশোর কিন্তু পাগল ছিল না। কীভাবে অত্যন্ত ভালো, বিবেচক, ডানপিটে ছেলেটি পাগলের বেসে প্রবাস থেকে ফিরে এল; সেটিই একটু পর স্পষ্ট হবে। চলুন, আলোচনায় যাওয়া যাক। কিশোর আর সুবাল ছোটবেলা থেকেই ভালো বন্ধু। তারা মাত্র তিন বছরের বড়-ছোট। একদিন তাদের দু'জনকে পাঠশালায় পাঠানো হলো কিন্তু সেখানে তাদের মন বসেনি। তিনদিনের দিন যে পাঠশালা পালাল আর তাদের পাঠশালায় ফেরা হয়নি। অবশেষে মালোদের মতো তাদের হাতেও জাল উঠল। মৎস্য শিকার করে অল্পদিনেই ভালো জেলে বনে গেল তারা। লেখকের ভাষায়: 'অল্পদিনের মধ্যেই পাকা জেলে বলিয়া পাড়ার মধ্যে তাদের নাম হইয়া গেল।'
ওদিকে তিতাসে আগের মতো মাছ পাওয়া যাচ্ছিল না। লেখকের ভাষায়: 'মাছের জো ফুরাইয়া গিয়াছে। মালোদের অফুরন্ত চাহিদা মিটাইতে গিয়া, দিতে দিতে তিতাস ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে।' মাছ পাওয়ার আকাল লক্ষ্য করে কিশোর সিদ্ধান্ত নিল প্রবাসে যাবে। প্রবাসে কিশোর-সুবলের সঙ্গী হলেন প্রবীণ তিলকচাঁদ। শুকদেবপুর গিয়ে উঠলেন তারা। সেখানে একজন কিশোরের সঙ্গে আত্মীয়তা (মেয়ে বিয়ে দেওয়ার) করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। বাঁশিরাম মোড়ল ও তার স্ত্রীর সহায়তায় তা সম্পন্ন হয় (মালাবদল হয়)। ওদিকে বাসুদেবপুর ও শুকদেবপুরের মধ্যে এক দাঙ্গার সৃষ্টি হয়। মোড়ল আসন্ন বিপদ আঁচ করতে পেরে কালবিলম্ব না করে কিশোর ও তার সঙ্গীদের নববধূসহ বিদায় দেওয়ার বন্দোবস্ত করেন। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজ গন্তব্যের দিকে নৌকা ভাসায় কিশোর। ওদিকে নববধূকে নিয়ে বৃদ্ধ তিলক পড়লেন দুশ্চিন্তায়। লেখকের বর্ণনা অনুযায়ী: ''সারা বেলা নৌকা বাহিয়া, বিকেল পড়িলে তিলকের মাথায় এক সমস্যা আসিয়া ঢুকিল। খানিক ভাবিয়া নিয়া, নিজে নিজেই সেই সমস্যার সমাধান করিয়া বলিল, ডাকাইতের মলস্নুক দিয়া নাও চালামু, তার মধ্যে আবার মাইয়ালোক। আমি কই, কিশোর, তুমি একখান কাম কর। পাটাতনের তলে বিছনা পাত। কেউ যেমুন না দেখে না জানে।'' কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। ডাকাতদল নববধূ ও মুনাফার দুইশত টাকাসহ কেটে পড়ে। এসব দেখে লেখকের ভাষায় কিশোরের অবস্থা: 'হায়, কি হইল রে' বলিয়া কিশোর পাগলের মতো গলা ফাটাইয়া এক চিৎকার দিল। চারিপাশের জলোচ্ছ্বাসের উপর দিয়া সেই চিৎকার ধ্বনি ধীরে ধীরে ডুবিয়া গেল। কোনো প্রতিধ্বনিও আসিল না।''
নতুন বউকে হারানোর বেদনা সহ্য করতে না পেরে কিশোর পাগল হয়ে যায়।
প্রবাস থেকে তাদের (কিশোর, সুবল, তিলকচাঁদ) ফেরার পর সুবলের সঙ্গে বিয়ে হয় বাসন্তীর। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস বিয়ের অল্প কদিন পর সুবলকে হারিয়ে বিধবা হয় বাসন্তী। সুবল কালোবরণের নৌকায় মাসিক বেতনধারী হিসেবে মাছ ধরতে যায়। কিন্তু সে যাত্রাই যে তার শেষ যাত্রা হবে কে জানত! নৌকার মালিকের অসঙ্গত আদেশ পালন করতে গিয়ে তার নির্মম মৃতু্য হয়।
ডাকাতের হাত থেকে রক্ষা পেতে নববধূ পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিল। পরে সে ভাসতে ভাসতে এক বালুচরে গিয়ে ওঠে। তাকে এ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে বৃদ্ধ দুই ভাই গৌরাঙ্গ ও নিত্যানন্দ এগিয়ে আসে এবং তাকে উদ্ধার করে নিজ সংসারে আশ্রয় দেয়। দুই ভাইয়ের সংসারে ভালোই কাটছিল অনন্ত আর অনন্তর মায়ের। চার বছর পর গৌরাঙ্গ ও নিত্যানন্দকে নিয়ে অনন্তর মা ও অনন্ত কিশোরের গ্রামের দিকে যাত্রা করে। নৌকায় যাত্রাপথে একমাত্র সন্তানকে নিয়ে নানা কথা ভাবতে লাগল অনন্তর মা। লেখকের ভাষায়: 'এবার অনন্তর দিকে চাহিয়া তার মনে মমতা উছলিয়া উঠে। অনন্তর বড় গাঙ দেখার অত সাধ। বড় গাঙের কথা, তার বুকে মাছ ধরার কথা...কুড়াইয়া-পাওয়া তার মা হয়ত হইবে বড় নদীর বড় জেলের মা, সেও কি তখন অনন্তকে মনে করাইয়া দিবে যে, অনন্ত, তোর মা ডাকাতের নৌকা হইতে জলে ঝাঁপ দিয়া এক দুর্দিনের রাতে বড় নদীতে পড়িয়াছিল, তুই তখন পেটে। তোর মা মরি-বাঁচি করিয়া একটা বালুচরে উঠিয়াছিল মাত্র। আর কিছু মনে নাই। তারপর এই দুই বুড়া, তোর দাদা, কোথা থেকে কোথা নিয়া আসিল। কোথায় ভবানীপুর গ্রাম, কোথায় কি।'
অনন্ত আর অনন্তর মা যখন কিশোরের গ্রামে এসে পৌঁছাল, তখন একটা পাগলকে (সে-ই কিশোর) এক বুড়াবুড়ি গোসল করাতে ঘাটে নিয়ে এসেছিল। অনন্ত আর তার মায়ের আগমনে অর্থাৎ গ্রামে নতুন মানুষের আগমনে সবাই খুশি হলো। তাদের জন্য বসতি স্থাপন করা হলো। একদিন বৃদ্ধ দুই ভাই (গৌরাঙ্গ ও নিত্যানন্দ) তাদের রেখে বিদায় নিল। সুবলের বউ বাসন্তীর সঙ্গে অনন্তর মায়ের ভালো মিতালি গড়ে ওঠে। অনন্তকে খুব আদর করত বাসন্তী। একদিন পাগল কিশোরকে যখন অনন্তর মা চিনতে পারল, তখন সে আশায় বুক বাঁধল। অনন্তর মা ভাবতে লাগল, কিশোর হয়তো সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। কিন্তু সেটি আর আলোর মুখ দেখল না। কিশোর আর ভালো হয় না। কিশোর মারা যায়। কিশোরের মৃতু্যর পর অনন্তর মায়েরও মৃতু্য হয়। তার মৃতু্যর পর অনন্তর জায়গা হয় বাসন্তীর কাছে। বাসন্তী অনন্তকে মাসীর আদরে আগলে রাখত। এ বিষয়টি বাসন্তীর মায়ের সহ্য হতো না। অনন্ত ছিল বাসন্তীর মায়ের চোখের কাঁটা। একদিন অনন্ত বাসন্তীদের বাসা থেকে বেড়িয়ে যায়। পরে তার আশ্রয় হয় বনমালী ও উদয়তারাদের কাছে।
অনন্তর সঙ্গে একটি মেয়ের পরিচয় হয়। নাম অনন্তবালা। অনন্তবালার সঙ্গে ভাব গড়ে ওঠে তার। ওদিকে অনন্ত পড়ালেখায় মনোযোগ দিয়েছে। একে একে শিশুশিক্ষা, বাল্যশিক্ষা, ধারাপাত, যুক্তাক্ষর শেষ করে সে। একদিন এক নাপিতানীর পরামর্শে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে কুমিলস্না শহরে পাড়ি জমায় অনন্ত। বহুদিন কেটে যায় কিন্তু সে আর ফিরছিল না মালোপাড়ায়। ওদিকে অনন্তবালা অনন্তর আশায় বসে থাকে। অনন্তবালার সঙ্গের অনেকের বিয়ে হয়ে যায় কিন্তু সে অনন্তর অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকে। একদিন অনন্ত আসবে, সে তার বর হবে- এটা ছিল অনন্তবালার আশা।
মালোদের মধ্য সামাজিক সাংস্কৃতিক ঐক্যে ফাটল দেখা দিল। শুরু হয়ে গেল মালোদের পুরনো সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ওপর আগ্রাসন। এ আগ্রাসন ঠেকাতে লেগে পড়ে দুজন। তারা হলো- সুবলের বউ বাসন্তী ও মোহন। মালোরা আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে যেতে লাগল। অন্যদিকে তিতাস নদী শুকিয়ে চর জেগে উঠল। মৎস্য শিকার না করতে পেরে মালোরা অন্য পেশা গ্রহণ করতে লাগল। নতুন জেগে ওঠা চর দখল করতে লাগল চাষারা। সব কুল-কিনারা হারিয়ে মালোরা ভিটামাটি ছেড়ে চলে যেতে লাগল। খেয়ে-না খেয়ে দিন যেতে লাগল মালোপাড়ার জেলেদের। মালোদের সংসারে অভাবের শেষ রইল না। মৃতু্যর সময় মুখে কেউ একটু পানি তুলে দিতে পারবে কিনা, সেটি নিয়েও ছিল অনেকের সংশয়। মালোপাড়ার এমন দুর্ভিক্ষে তাদের পাশে দাঁড়াতে ছুটে এল অনন্ত, এগিয়ে এলেন কাদির মিয়া। কাদির মিয়া তার ধানের গোলা খুলে দিল। অনন্ত নৌকায় ধান চাল নিয়ে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ছুটে চলল। উপন্যাসের একবারে শেষে অনন্তর সঙ্গে বাসন্তীর (তার মাসী) দেখা হয়। অনন্ত তার হাতে খাবার তুলে দেবে এমন সময় বাসন্তী অনন্তকে চিনতে পেরে নিজেকে আড়াল করে।
মালোপাড়ায় শুধু মালোদের ফেলে যাওয়া ভিটামাটিই পড়ে থাকে কিন্তু তাদের (মালোদের) কেউ আর নেই সেখানে। লেখকের ভাষায়: 'দক্ষিণের সেই সুদূর হইতে ঢেউ উঠিয়া সে ঢেউ এখন মালোপাড়ার মাটিতে আসিয়া লুটাইয়া পড়ে, কিন্তু এখন সে মালোপাড়ার কেবল মাটিই আছে। সে মালোপাড়া আর নেই। শূন্য ভিটাগুলোতে গাছ-গাছড়া হইয়াছে। তাতে বাতাস লাগিয়া সোঁ সোঁ শব্দ হয়। এখানে পড়িয়া যারা মরিয়াছে, সেই শব্দে তারাই বুঝি বা নিঃশ্বাস ফেলে।'