আদর আলীর জ্বর
প্রকাশ | ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
জসীম উদ্দীন মুহম্মদ
সবার ছোট বলে মা-বাবা অনেক আদর করে নাম রেখেছিলেন আদর আলী। অবশ্য সেই আদর আলীও একেবারে কম যাননি; গুণে-মানে, বিদ্যায়-বুদ্ধিতে, সামাজিক কার্যক্রমে তিনি সবার শীর্ষ দেশে না থাকলেও একদম পেছনেও নন। শিশুরা যেমন হাঁটি হাঁটি পা পা করতে করতে হাঁটা শিখে; আদর আলীও তেমনি পাড়া-গাঁ থেকে পা পিছলাইতে পিছলাইতে জেলা শহরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে অবাক চোখে শহরের জৌলুস দেখতে থাকেন। অবশ্য এর আগেও অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পরীক্ষা দিতে আদর আলী একবার শহরে এসেছিলেন। তখন তার বড় ভাই জালাল উদ্দিন কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল সরকারি কলেজের ওয়াসিমুদ্দীন মুসলিম ছাত্রাবাসের তিনতলায় থাকেন। পরদিন আদর আলীর বৃত্তি পরীক্ষা; কিন্তু সেই চিন্তা ছাপিয়ে তার কাছে বড় হয়ে উঠলো বিল্ডিংয়ের ছাদ ভেঙে যদি নিচে পড়ে যান! সারারাত ভয়ে তার দুই চোখে ঘুম এলো না। সকালবেলা লাল লাল দুই চোখে ঢুলুঢুলু ভাব নিয়েও তাকে পরীক্ষার সিটে বসতেই হলো। পরীক্ষা শেষে প্রশ্ন নিয়ে বড়ভাই জালাল উদ্দিনের জেরা তো আছেই! কেবল আদর আলী যে ছাদ ভেঙে পড়ে যাওয়ার ভয়ে সারারাত না ঘুমিয়ে ছিল; সে খবর কেউ রাখেনি।
সেই আদর আলী একদিন নিজেই ওয়ামুদ্দীন মুসলিম ছাত্রাবাসের বাসিন্দা হলেন। তখন তিনি একাদশ শ্রেণির গর্বিত ছাত্র। অবশ্য আদর আলী অন্যদের মতো ছিলেন না। ছাত্রজীবনের এই সময়টা সাধারণত কালবৈশাখী ঝড়ের মতো হয়ে থাকে। তখন নিয়মনীতি ভাঙতেই যেন ভালো লাগে। ভাঙাচোরার আওয়াজে হৃদয়ের মাঝখানে পুলক অনুভূত হয়। এরকম অস্থির সময়ে পুরো হোস্টেলের ওপর দিয়ে একটা ক্যাটাগরি ১০ মাত্রার টর্নেডো বয়ে গেল। মিঠু, আতাউর, ফরহাদসহ আরও কয়েকজনের নেতৃত্বে হঠাৎ একদিন হোস্টলে গোঁফ কামানো অভিযান শুরু হয়ে গেল। বলাকা বেস্নড, সাবান এবং একমগ পানি নিয়ে গোঁফ কামানো টিম প্রত্যেক রুমে রুমে হানা দেয় এবং একজন একজন করে ধরে সবার গোঁফ কামিয়ে দেয়। এ যেন রীতিমতো এক তান্ডব! কেউ রেহাই পাচ্ছিল না। বলা বাহুল্য, হোস্টেলের শ'দুয়েক ছাত্রের মধ্যে একটি মাত্র গোঁফ অক্ষত ছিল... আর সেই গোঁফটি হলো আমাদের সবার প্রিয় আদর আলীর? কীভাবে সেই অসাধ্য সাধন হলো তা আজও সহপাঠীদের কাছে বারমুডা ট্রায়াংগেলের মতোই এক অজানা রহস্য।
যদিও আদর আলী বরাবরই একেবারে নিরাকপরা আকাশ অথবা দোআঁশ মাটির মতো নিরীহ প্রকৃতির। তবুও ভোঁতা দায়ে ধার উঠার মতন আদর আলীরও একদিন রাগ চরমে উঠেছিল। ঘটনাটি খুব বেশি লোমহর্ষক নয়; তবুও সেদিন কেন জানি তিনি নিজেকে সংযত করতে পারেননি। এইচএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ করার জন্য ছবি সত্যায়িত করা লাগে। এই সত্যায়ন করানোর অভিজ্ঞতা আদর আলীর মোটেও ভালো না। যে কোনো স্যারের কাছেই যান কেন... কেউই সহজে সত্যায়িত করে দেন না। দিতে চান না। নানান কিসিমের প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেন। কেউ কেউ আবার ধমক দিতেও ছাড়েন না। এ সবকিছু জেনেও আদর আলী রাষ্ট্রবিজ্ঞান ক্লাসের শেষে বাবর আলী স্যারের পেছনে পেছনে যেতে লাগলেন। যদিও জানেন, এই বাবর আলী স্যার কলেজের সবচেয়ে কড়া। ক্লাসে ঢুকেই সোজা বলতেন, পেছনের দরজা বন্ধ কর। মানে দাঁড়ায়, হাজিরার ইয়েস স্যার বলে পালানোর দরজা বন্ধ! যাক, স্যার যখন শিক্ষক লাউঞ্জের সিঁড়ি ভাঙতে লাগতে লাগলেন, তখন আদর আলী পৃথিবীর সমস্ত বিনয় একসঙ্গে গলিয়ে বলল, স্যার আমার কয়েকটা ছবি সত্যায়ন করা দরকার। বাবর আলী স্যার এই প্রথম কোনোরকম মেজাজ না হারিয়ে বললেন, এই ছেলে তোমার সাহস তো কম নয়; সিঁড়ির মধ্যে সত্যায়িত করার কথা বলছ! দূর হও এখান থেকে! চট করে আদর আলীর মাথায় রক্ত উঠে গেল। কিন্তু মা-বাবার অতিশয় প্রিয় আদর আলী কিছুমাত্র মাথাগরম না করে বললেন, যাচ্ছি স্যার। কিন্তু মনে রাখবেন আমিও একদিন আপনার মতো সত্যায়িত করার ক্ষমতা অর্জন করব। কিন্তু সেদিন আমি কারো সঙ্গে আপনার মতো খারাপ ব্যবহার করব না। বাবর আলী স্যার আদর আলীর মুখের দিকে একটি মাত্র মুহূর্ত নিবিষ্ট মনে তাকালেন। অতঃপর কী মনে করে আদর আলীর হাত ধরে টানতে টানতে বললেন, এসো আমার সঙ্গে। আদর আলীও আর কথা বাড়ালো না। মাথা নিচু করে স্যারের পিছু পিছু হাঁটতে লাগলেন।
এর কয়েকদিন পরের ঘটনাটি আরও অনেক বেশি আকাশ ভাঙা। কিন্তু সেই রাগও তিনি সর্বভুকের মতো হজম করেছিলেন। মুখ ফুটে টু শব্দটি পর্যন্ত করেননি। তখন নিয়ম অনুযায়ী এইসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণের আবেদন পত্রটি পরীক্ষা কমিটির একজন শিক্ষককে দিয়ে চেক করিয়ে উনার স্বাক্ষর নিয়ে তারপর অফিসে জমা দিতে হতো। তিনজন বন্ধুসহ আদর আলী তার নিজ গ্রামেরই একজন শিক্ষক মতিউর রহমানের কাছে গেলেন। অবশ্য তিনি পুরাপুরি শিক্ষকও নন; প্রদর্শক। অবশ্য আদর আলীর মতন সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কাছে শিক্ষকও যা; প্রদর্শকও তা। সেই মতিউর রহমান স্যার সেদিন তার গ্রামের ছেলেরা এসেছে জেনেও স্বাক্ষর করে দেননি। বিশাল একটা ভাব নিয়ে গজগজ করতে করতে কী জানি কিছু একটা বলতে বলতে চলে গেলেন। সেদিন আদর আলীর ইগোতে বেশ বড় একটা ধাক্কা লেগেছিল। কিন্তু সামাজিক সৌজন্যতার দালান বোধের কথা ভেবে মুখে তালা মেরে মাটির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সেদিন প্রস্থান নিয়ে ছিলেন।
আমাদের সেই আদর আলী এখন একটি সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক। তার মানে দাঁড়ায় বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার অফিসার। এক ছেলে এবং দুই মেয়ে। ছেলে বড়। এইবার এইচএসসি পাস করেছে। বড় মেয়ে একাদশ এবং ছোট মেয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। স্ত্রীও বেকার নন, বেশ পদস্থ সরকারি চাকরিজীবী। বলা চলে এক প্রকার সুখী সংসার। তবুও সুখ এবং অসুখ পাশাপাশি থাকে। হাত ধরাধরি করে হাঁটে। ওরা যেন ভাঙা কাঁচ! পার্থক্য কেবল ভাঙা কাঁচ জোড়া লাগে না। কিন্তু সংসারের শান্তি-অশান্তি, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, হিসাবের কড়িকাঠ এ সবকিছু বিজলিবাতির মতন। আসে আর যায়। যায় আর আসে!
গায়ে জ্বর নিয়ে আদর আলী কিছুক্ষণ আগে অফিস থেকে বাসায় ফিরেছেন।! সারা শরীর এক প্রকার পুড়ে যাচ্ছে। তবুও এখন তার রান্না করা লাগবে। অন্যথায় প্রায় শতবর্ষী মা'সহ অবুঝ সন্তানরা না খেয়ে থাকবে। কিন্তু শরীরের এহেন অবস্থায় রান্না করাও কঠিন। উপায়ান্তর না দেখে আদর আলী বউ'কে রিং দিলেন, হ্যালো....
বল শুনতেছি...
আমার শরীরের অবস্থা খুব খারাপ। তুমি বাসায় চলে এলে খুব ভালো হতো।
আদর আলীর কী হয়েছে, কী হয়নি এসব তবিয়তের কিছুমাত্র জিজ্ঞেসাবাদ না করে তার স্ত্রী সোজাসাপ্টা জবাব দিল, আমি এখন মিটিং এ আছি। বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করেই ঘঁ্যাচ করে লাইন কেটে দিল।
আদর আলী বরাবরের মতোই কিছুমাত্র অবাক হলো না। টলতে টলতে রান্নাঘরের দিকে চলল। আজ মনে হচ্ছে আদর আলীর বেডরুম থেকে রান্নাঘর মেলা...দূর। রান্নাঘরে যাওয়ার পথে তার শতবর্ষী মা তাকে ডেকে বললেন, বাবা আদর, তোমার কণ্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন? তোমার শরীরে তো জ্বর মনে হচ্ছে।
মায়ের কথা শোনে আদর আলীর দুই চোখ জলে ভিজে গেল। মনে মনে বললেন, এই না হলো মা! আর মুখে বললেন, না... না... মা আমার তেমন কিছুই হয়নি। একটু ঠান্ডা লেগেছে এই যা!
জোহর গড়িয়ে আসর ছুঁই ছুঁই অবস্থা! রান্না মোটামুটি শেষ হলেও জোহরের নামাজ এখনো বাকি। কোনোরকমে খাবারগুলো ডাইনিং টেবিলে রেখে আদর আলী অজু শুরু করলেন। উহ! কী সাংঘাতিক ঠান্ডা পানি! তবুও কোনোরকমে অজু সেরে নামাজ আদায় করলেন। আহা! কী প্রশান্তি। তবুও শরীরের সমস্ত ক্লান্তি যেন হঠাৎ আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠল। আদর আলী বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে যতটা সম্ভব অনুচ্চস্বরে গোঙাতে লাগলেন। ছেলেটা একবার কী মনে করে তার রুমের সামনে উঁকি দিয়ে গেছে। ভালো-মন্দ কিছুই বলেনি। বড় মেয়ে কলেজ থেকে ফিরে সেই যে তার রুমে ঢুকেছে; আর বের হয়নি। মেয়ে বাসায় ঢুকার সময় তিনি তাকে উদ্দেশ্য করে বারকয়েক লেবুর শরবত চাইলেন। কিন্তু মেয়ে শুনলো কি শুনলো না কিছুই বুঝা গেল না। তবে শরবত এখনো আসেনি। আর ছোট মেয়েটা স্কুল থেকে ফিরে একমনে টিভিতে কার্টুন দেখছে। নিনজা হাতুড়ি। এই যখন অবস্থা তখন আদর আলী একবার চোখ বন্ধ করেন আরেকবার চোখ খুলেন। বারবার অতীতের স্মৃতি পাঠ করতে থাকেন। আলো-আঁধারির এক অদ্ভুত খেলা! তীব্র জ্বরের সঙ্গে পালস্না দিয়ে স্মৃতিরাও ডালপালা মেলতে থাকে এ যেন আরেক জীবন! যেখানে আদর আলী সাগরে ভাসতে থাকা খড়কুটোর মতন; কখনো উচ্ছ্বল; আবার কখনো নোঙর করা জাহাজের মতন বিত্তহীন।
চাকরিতে জয়েন করার পর একবার মতিউর রহমান স্যারের সঙ্গে আদর আলীর দেখা হয়েছিল। তিনি আদর আলীর পিঠ চাপড়িয়ে বলেছিলেন, সাবাস বেটা! খুব খুশি হয়েছি। অবশ্য আদর আলী কিছু বলেননি। কেবল এইচএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণের আবেদন পত্রটির অসহায়ত্বের সেই দৃশ্যটি মনে পড়তে লাগল! বাবর আলী স্যারের সঙ্গে আর তার দেখা হয়নি। আদর আলীর খুব ইচ্ছে হচ্ছে বাবর আলী স্যারের পা ছুঁয়ে একটিবার কদমবুসি করবেন!