শুক্রবার, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১

ভুলু বোষ্টমী

তপন কুমার দাশ
  ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
ভুলু বোষ্টমী

বৈশাখ মাসের প্রখর রোদে পুড়ে যায় চারদিক। সূর্যের তাপে যেন সিদ্ধ হয় চারপাশের মানুষজন, গাছপালা-পশুপাখি। পড়ন্ত বিকালেও কমে না রোদের তাপ। এ দুঃসহ গরমে ঘরে থাকা যায় না। ঘর ছেড়ে পাশের আমগাছটার ছায়ায় এসে বসে ভুলু বোষ্টমী। সামনের মরা নদীটির পানে উদাস চোখে চায়।

বোষ্টমীর দূর সম্পর্কের এক বোন-ঝি বিমলাকে নিয়েই এ বাড়িতে থাকে ভুলু বোষ্টমী। এ দুনিয়ায় তার সঙ্গে থাকার মতো আপনজন বা বান্ধব আর কেউ নেই। কখনো ভাঙা একতারাটা এগিয়ে দেয় বিমলা। সেও পাশে এসে বসে। কখনো সে দাওয়ায় বসেই ভাঙা গলায় গান ধরে বোষ্টমী, দিন যে গেল, সন্ধ্যা হলো, হরি পার কর আমারে..।

বার বার চোখ চলে যায় বাড়ির দক্ষিণ পাশে মরে যাওয়া নদীটির দিকে। কত কথা মনে পড়ে বোষ্টমীর। এ নদীতে তখন জোয়ার-ভাটা হতো, টলমল করত জল। একদিন কানাই বোষ্টমের হাত ধরে এ নদী পথেই পানসিতে চড়ে উঠে এসেছিল এই গাঁয়ে। এসে উঠল কানাইয়ের নিজবাড়িতে, বৈষ্ণব আখড়ায়। সেও তো প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা।

দূরে, বহুদূরে যশোরের এক ধনী গৃহস্থ পরিবারে জন্মেছিল ভুলু রাণী। বিখ্যাত ঠাকুর বাড়ির গয়েশ ঠাকুরের একমাত্র মেয়ে ভুলু। ওর বাবা ছিলেন একজন সাধু ব্যক্তি। সাধু বৈষ্ণবদের প্রতি ছিল তার অনেক অনুরাগ। প্রতি বছর চৈত্র শেষে কিংবা বৈশাখের তপ্ত দিনগুলোয় ওদের বাড়িতে বসত গানের আসর। সে আসরে যোগ দিতে আসত কত বাউল, কত সন্ন্যাসী, আর কত সৌখিন গায়ক। সন্ধ্যা হতেই বাড়ির উঠানে শুরু হতো গান। সুরের দোলায় দুলত সারাবাড়ি, সারাগ্রাম।

এ বাউল সন্যাসীদের সঙ্গেই এক বৈশাখে ওদের বাড়ি এল কানাইয়া নামে এক ছোঁকড়া বাউল। বাবরী চুলের প্রান্তভাগে নাচন তুলে, বড় বড় চোখ মেলে সেও গাইত, সখি- পিরিতে অমিয় ধারা...।

সে সুর শুনে আকুল হয় কতজন। আকুল হয় ১৬ বছর বয়সি ভুলু রানীও। কানাইয়ার বাবরী চুলের বাহার আর মনোলোভা সুরের মোহে পড়ে একদিন গভীর রাতে ঘর ছাড়ল ভুলু রানী। গড়াই, পদ্মা আর মেঘনা পাড়ি দিয়ে ওরা উঠে এল কৃষ্ণতলীর এই বৈষ্ণব কুটিরে।

মা-বাবার আদর-সোহাগ ত্যাগ করে, সবাইকে ভুলে গিয়ে ভুলু রানী নাম নেয় ভুলু বোষ্টমীর। কপালে গলায় সাদা তীলকের নকশা এঁকে কানাইয়ের বাহু পাশে দাঁড়িয়ে হাতে তুলে নেয় খঞ্জনী আর একতারা। ভরা পূর্ণিমায় জবা, গন্ধরাজ কিংবা রজনীগন্ধার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ভুলু বোষ্টমী রচনা করে মানবপ্রেমের এক অনুপম গাঁথা। এক কানাইয়ার উদ্দেশ্যে নিবেদিত প্রেম ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র মানবজাতির প্রতি। কানাইয়া আর ভুলু বোষ্টমীর মিলিত সুরের জাদুতে আচ্ছন্ন হয় কত লোক, কত সওদাগর কত মহাজন।

মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। সারাদেশে কলেরা দেখা দিল। মাত্র তিনদিন ভুগে ছটফট করতে করতে দু'চোখ বন্ধ হলো কানাইয়ার। বাড়ির সামনেই তুলশিতলায় তৈরি সমাধিতে আসীন হলো সে, চিরতরে। সঙ্গে সঙ্গে মাটির অতল গহ্বরে চাপা পড়ে গেল মাত্র আঠার বছর বয়সি ভুলু বোষ্টমীর উদ্যাম যৌবনের সব চাওয়া-পাওয়া। রাধা কৃষ্ণের প্রেমলীলার বদলে ভুলু বোষ্টমীর কণ্ঠে উঠে এল বিরহের অমর গাঁথা, সখি রে, আমি কাঁদতে বড় ভালোবাসি...।

শনের ছাউনি দেওয়া ছোট্ট আটচালা পশ্চিমমুখো কুঁড়ে ঘরটার সামনে ওদের এক চিলতে উঠান। তার পাশ দিয়েই সামনের দিকে চলে গেছে বাড়ি থেকে বের হওয়ার পথ। পথের দু'ধারে চমৎকার করে লাগানো লটকন জবা আর মাধবী লতার সারি, কানাইয়ের নিজ হাতে গড়া। দুদিক থেকে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে মাথার ওপর দিয়ে তৈরি মাচানের ওপর তুলে দেওয়া লতা থেকে নিচের দিকে ঝুলে পড়ে থাকে টকটকে লাল জবা আর মাধবীর লাল নীল সাদা রঙের বাহারি ফুল। সেদিকে চেয়েই মাঝেমধ্যে কান্নাভেজা গলায় গান ধরত বোষ্টমী, আমি বুঝিতে নারি সখে, তোমার পিরিতে, আমার পিরিতে জনম গেল।

কানাইয়ের বাবা গত হয়েছে অনেক আগে। তার মায়েরও বয়স হয়েছে অনেক। একদিন ভক্তের বাড়ি থেকে ভিক্ষে করে ফিরছিলেন তিনি। বাড়ির কাছাকাছি আসতে পথের ওপরই হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। তার মিনমিনে কণ্ঠের 'ভুলু' ডাক পৌঁছাল না বাড়ি পর্যন্ত। লোকমুখে খবর পেয়ে ভুলু যখন সেখানে এসে পৌঁছাল তখন অনেক লোক এসে জড়ো হয়েছে। তারপর নানা স্থান থেকে ছুটে এসেছে তার অগনিত ভক্ত শিষ্য। সবাইকে কাঁদিয়ে আর ভুলু বোষ্টমীকে একেবারেই নিঃস্ব করে দিয়ে সে রাতেই তিনি দু'চোখ বন্ধ করলেন।

তারপর আর বেশিদিন লাগল না। নানাজন নানাছলে আসতে চাইল ভুলু বোষ্টমীর কাছাকাছি। নারীসঙ্গ কাতরলোভী মানুষও হাত বাড়ায় ভুলু বোষ্টমীর দিকে। ভুলুও ফিরিয়ে দেয় না কাউকে, আবার কাছেও টেনে নেয় না। গঞ্জের হাট থেকে ফেরার পথে সময় পেলেই কানু সওদাগর বোষ্টমীর কুঞ্জে আসে। কোমরের খোঁট থেকে টাকার থলেটি বের করে নাড়াচাড়া করে। শেষমেষ বোষ্টমীর হাতের দুখিলি পান খেয়ে ফিরে যায়। হরেন মাঝিও আসে মাসে দু-একবার। একটা পদাবলি গান শুনে যায়। ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে আসে জমিদার নন্দন হরিপদ শীল। এ তলস্নাটে হরিপদ শীলের পিতার নামে বাঘে-মহিষে এক ঘাটে জল খেত একসময়। লাখ লাখ টাকার মালিক এখন তারই ছেলে হরিপদ শীল। কোনো কোনো মধ্যরাতে সঙ্গোপনে হরিপদ শীলও আসে বোষ্টমীর আঙিনায়। লম্বা করে বোষ্টমীকে একটি নমস্কার দেয়। তারপর চেয়ে থাকে বোষ্টমীর সুন্দর দুটি চোখের দিকে। কিন্তু বোষ্ঠমীর চোখের আগুন দেখেই তাকে ফিরতে হয়।

এই একটি লোককে দেখলেই বোষ্টমীর গায়ে যেন আগুন ধরে। কেমন যেন ভোঁটকা গন্ধ লোকটার মুখে, গায়ে। বমি আসে বোষ্টমীর, আঁচলে ঢাকে নাক-মুখ। কখনো রক্তচক্ষু দেখিয়ে আবার কখনো দু'হাত জোড় করে বোষ্টমীর চরণপানে চেয়ে মিনতি করে হরিপদ। কিন্তু এ বখাটে জমিদার নন্দনের প্রতি মন গলে না বোষ্টমীর। তর্জনী উঁচিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার পথ দেখায় সে। টলতে টলতে এলোমেলো পদক্ষেপে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় হরিপদ শীল।

বোষ্টমীর আঙিনায় ফুটে থাকা ফুলের রূপ দেখতে, একটু ছোঁয়া নিতে দিনভর কত মানুষ আসে। রাত-বিরাতেও আসে আরও কতজন। কেউ আসে গান শুনতে, কেউ আসে পান খেতে, আর কেউ আসে বোষ্টমীর গায়ের গন্ধে মাতাল হতে।

তবে, সময় তো আর বসে থাকে না, চলে যায় হু-হু করে। এক সময়ের ভরা নদী শুকিয়ে মরা গাঙে পরিণত হয়। সে গাঙে এখন আর জোয়ার আসে না। এখন পানসী ভাসায় না সৌখিন সওদাগর। ঘাষি নৌকার চলাচলও কমে গেছে সেই কবে। আশপাশেই এখন বিজলী বাতি এসেছে। সবকিছুই যেন বদলে গেছে একেবারেই।

ভুলু বোষ্টমীর শরীরেও এখন ভাটা পড়েছে। সাদা হয়ে গিয়েছে মাথার কেশ। চক্ষের পলকেই যেন বয়স পার হয়েছে সত্তরের কোঠা। দু'চোখে ছানি পড়েছে, সবকিছু কেমন যেন ঝাপসা লাগে। এলোমেলো হয়ে গেছে মনের মধ্যে গেঁথে রাখা পদাবলির চরণ, আর সুরের কারুকাজও।

ভুলু বোষ্টমীর নিজ হাতে লাগানো রক্তজবা, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া আর গন্ধরাজের চারাগুলো এখন বুড়ো হয়েছে। মধুলোভী ভ্রমরেরাও আজকাল এ পথ মাড়ায় না। সবাই ভুলে গিয়েছে বোষ্টমীকে। একা, বড় একা আজ ভুলু বোষ্টমী। কানাই বোষ্টম আজ কেবলই স্মৃতি!

শুধু একজন, একজনই ভুলে যায়নি বোষ্টমীকে। সে আজও আসে পড়ন্ত বিকালে বা সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে ঠকঠক করে লাঠি ভর দিয়ে। সে হলো হরিপদ শীল। আজও সে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে হরি বোষ্টমীর পায়ের কাছে। নমস্কার দেয় বোষ্টমীর সুন্দর দুটি পায়ের সামনে, মাটিতে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে