কাশফুল ও কষ্ট দেওয়া মানুষের গল্প
প্রকাশ | ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
আলমগীর খোরশেদ
গ্রামে সাদা শাড়িতে ছেয়ে থাকা কাশবন। দুষ্টু বাতাস ছেলেরা একটু পর পর এসে দোলা দেয় কাশবনে। আনত নয়না কাশফুল কন্যারা লাজুক হয়ে ঢলে পড়ে পাশাপাশি একে অন্যের উপর। বাতাস এসে কাশফুল মেয়েদের সাদা ঘোমটা যেন খুলে দিতে চায়। একটা কাশফুল টেনে এনে বুকের কাছে রেখে কাশবনের ছবি তুলতে যাব তখন পাশের বাড়ির লুৎফর বলে উঠল, 'ভাইছা, আমরা যেইডারে ছনখেত কই, হেইডারে টাউনের মাইনসে কাশফুল কয়, এইডা তো জানতাম না।
'কত কথাইতো শহরে গিয়া পাল্টে যায়রে লুৎফর। মানুষই রং বদলায় আগে, নিজের প্রয়োজনে। এক জায়গার বুলি অন্য জায়গায় হয়ে যায় গালি'।
'হ ভাইজান, শিক্ষিত মাইনসের কথাই আলাদা। এরা কারোর ক্ষতি করতে ডরায় না।
লুৎফরের ছনখেতের কথা শুনে ছেলেবেলার অনেক স্মৃতি এসে ভিড় জমালো মস্তিষ্কের সেরিব্রাল কর্টেক্সে। আমাদের বাড়ির উত্তর দিকে পাগার বা জলাশয়ের পাড়ে লাইন ধরে ছনগাছ ছিল, বাড়ির দক্ষিণ দিকে নাসিরদের বাড়ির আগে রজবদের বাড়ির সঙ্গেই পাগার পাড়েও ছিল ছনখেত। ছোট একটা পাগার। একটু দূরে ছিল অশ্বত্থ গাছ। ভর দুপুরে অশ্বত্থ গাছের নিচে যেতে ভয় পেতাম। ভূতেরা নাকি তখন বিশ্রাম নেয়। স্কুল থেকে এসে নাসির ও পাড়ার অন্য ছেলেদের নিয়ে ছনখেতে যেতাম। কাশফুল ফোটার আগে এটা ধান গাছের কচি শীষের মতো থাকে। যার ভেতর কালো রঙের নরম ডাঁটার মতো থাকে। এটাকে গ্রামের ভাষায় 'বাতাকালি' বলে। ছনগাছের আগা থেকে এই নরম বাতা ভেঙে এনে কলাপাতায় জমা করতাম। নাসিরের বাড়ি কাছে থাকায় সে এক দৌড়ে ঘর থেকে পেঁয়াজ, লবণ, আর আমাদের ফসলি জমিতে আব্বার করা মরিচখেত থেকে কাঁচা মরিচ নিয়ে আসতো। সব বাতা, লবণ, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ দিয়ে একসফঙ্গ মাখিয়ে সেটাকে কলাপাতায় জড়িয়ে পোটলার মতো বানিয়ে মাটিতে গর্ত করে কলাপাতার পোটলাটা তাতে রেখে মাটি চাপা দেওয়া হতো। তারপর আমরা এক এক করে সবাই মাটিচাপা দেওয়া জায়গায় পায়ের মোড়া দিয়ে মোড়াইতাম। কিছুক্ষণ পর মাটি খুঁড়ে কলাপাতার পোটলা বের করে আনতাম। খোলে দেখা যেত পেঁয়াজ, লবণ, মরিচ থেকে পানি বের হয়ে বাতাকালির সফঙ্গ একাকার হয়ে গেছে। সবাই ভাগ করে বাতাকালি খেতাম, যেন অমৃত স্বাদ মিলত। মুখে কালি লেগে থাকত। বাড়িতে ঢোকার আগেই পুকুরে মুখ হাত ধুয়ে নিতাম। 'ভাইছা, ফডো তো আট দশটা তুলেস্নয়াইলছি। আরো তুলতাম'?
লুৎফরের প্রশ্নে আমার ভাবনায় ছেদ পড়ে। প্রায় পঁয়তালিস্নশ বছর আগের ঝাপসা স্মৃতি থেকে বেরিয়ে এসে বলস্নাম,
' থাক লুৎফর, আইজ থাক, আর না'।
'আফনেরার বৈঠক বইবো আজ্জোয়া, ভাইছা'?
'বওনের তো কথারে লুৎফর। জানি না কি করে এরা'।
'শেষ কইররালাইন ভাইছা, আর কতো, চাহাজি মইরেয়া গেছে চব্বিশ বছর, মানুস বাঁচে আর কয়দিন, আজ্জোয়া মরলে কাইল তিনদিন। খেত কুতের ঝামেলা- অহনো বৈঠক করবাইন? মনের বিত্তে মিলের চিন্তা না থাকলে আসমানতে ফেরেস্তা আইয়াও কিছু কত্তাততোনা।
লুৎফরের কথাটা আমার কাছে খুব জ্ঞানী কথা মনে হলো, 'মনের বিত্তে মিলের চিন্তা না থাকলে আসমানতে ফেরেস্তা আইয়াও কিছু কত্তাততোনা'। মানুষ তিল থেকে তাল হয়। শূন্য থেকে সর্ব হয়। আর আমরা দিন দিন শূন্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
আমরা শিক্ষিত হয়ে কিছুই করতে পারলাম না। একজন আরেকজনের পিছু লেগে থেকে নিজেদের সম্পর্কের পারদ জিরোতেই ঠেকে আছে। তার মানোন্নয়ন হয়তো জীবিতকালে আর হবে না। আসলে মানুষের সুখ বিষয়টা কোথায়, কীভাবে পাওয়া যায়, সেটা কেউ জানে না। অন্যকে উঠতে না দিয়ে পা ধরে টেনে ধরা, কাউকে ঠকানো, অপেক্ষাকৃত বেশি নেওয়া, বেশি খাওয়া যাদের সার্বক্ষণিক চিন্তায় পড়ে, তারা নিজেরাও কিছু করতে পারে না আবার অন্যদেরও কিছু করতে দেয় না। সবাই নিজেদের সংসার সুন্দর করে গুছিয়ে নিয়েছে। বাড়ি, জমি, পুকুর, চলার ব্যবস্থা সব। শহরে থাকা ছেলেটিকে সবচেয়ে বেশি ঠকিয়ে ওরা দেবার ভয়ে আর বসতে চায় না। অফিসে ছুটি পাওয়া, ট্রেনের টিকেট ম্যানেজ করা, সবকিছুর সঙ্গে সামঞ্জস্য করে গ্রামে আসা খুবই কষ্টের। ওরা তা বুঝতে পারে না। সাজানো নাটকগুলো মঞ্চস্থ হয়ে যায় রক্ত সম্পর্কের মানুষের সঙ্গে। কিছুই করার থাকে না।
প্রাত্যাহিক জীবন চলায় অবলম্বন ভাবা মানুষ যখন বুঝতে পারে তাকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে, প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে, যদি সে বুঝতে পারে তার দিকে মমতা সহমর্মিতার কমতি নেই, তখনি সে মানুষটি বদলে যেতে থাকে। ডেম কেয়ার বা পাত্তা না দেওয়ার একটা প্রবণতা গ্রাস করে সাপের ব্যাঙ গিলার মতো। ছোটবেলায় বাবাকে অসম্ভব ভয় পেয়ে বড় হওয়া ছেলেটির মনে সেই 'ভয়'টা স্থায়ীভাবে প্রলেপের মতো জড়িয়ে থাকে। একটার পর একটা অর্থনৈতিক ধ্বস, রক্ত সম্পর্ক থেকে পাওয়া ঠকানো, প্রতারণা, বঞ্চিত করা, হেয় করা, তাকে দমিয়ে দেয় মন থেকে। আস্তে আস্তে সাহস কর্মস্পৃহা উচ্ছ্বাস হারিয়ে ফেলে ছেলেটি। একটা অনাবশ্যক ফোবিয়া পেয়ে বসে। সামাজিক, দাপ্তরিক, ব্যক্তিগত যেখানেই হোক, মেনে নেওয়া, সমঝোতা, সন্ধির পতাকা যেন ছেলেটির জন্যই। কাউকে একপেশে করে রাখার সব কালা কানুন তাদের অভিধানেই রক্ষিত যেন। ছেলেটি সেখানে অপাংক্তেয়।
কাশফুলের গল্প হয়তো থেমে যায়। অপেক্ষায় থাকে আরেকটি শরতের। কিন্তু মানুষের মনের ভেতর গেঁথে থাকা কষ্টগুলোর শেষ হয় না। যা শেওলার মতো জমে থাকে পুকুর ঘাটের অস্তিত্বের মতো। যাতনাবোধের গল্পগুলো রাসায়নিক চেইন বিক্রিয়ার মতো চলতে থাকে কাল থেকে মহাকাল কিংবা শতাব্দীর প্রান্ত ছুঁয়ে। গোবেচারা মানুষের মনোবেদনার কারণ হয়ে।