বাংলা কবিতার পালা বদলে তার স্বতন্ত্র উজ্জ্বল কণ্ঠস্বর অনায়াসে চিহ্নিত করা যায়। তার নামের সঙ্গে 'প্রধান কবি' অভিধা সংযুক্ত হওয়ার অনিবার্যতা তার সৃষ্টি কুশলতায়। শামসুর রাহমান পঞ্চাশ দশকে বাংলা কবিতায় আবির্ভূত হয়ে কবিতার বিষয়-বৈচিত্র্য, বর্ণনারীতি ও রূপব্যঞ্জনা নির্মাণে আধুনিক রূপায়ন ঘটিয়েছেন। তিরিশের পাঁচ কবির আধুনিক কাব্যভূমি নির্মাণ ও নিরীক্ষার যাত্রা চলিস্নশের ফররুখ আহমদ, আবুল হোসেন ও আহসান হাবীবের ভিন্নতর সীমা চিহ্নিত করায় পাঠক পাশ্চাত্যের কবিতার নতুন সুর অনুরণিত হতে দেখে। সাতচলিস্নশের দেশভাগের পর রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজজীবনে যে পরিবর্তন ঘটে তা এ অঞ্চলের কবিচিত্তে আলোড়ন তোলে। ঐতিহ্য চেতনা, মুসলিম মানসের প্রতিক্রিয়া নিয়ে কয়েকজন কবি কবিতা চর্চায় মনোযোগী হন। এক্ষেত্রে পঞ্চাশে ব্যতিক্রম শামসুর রাহমান ও হাসান হাফিজুর রহমান। স্বদেশ, সমকাল ও স্বাজাত্যবোধ এদের কবিতার আরাধ্য। 'পাকিস্তান' রাষ্ট্রের উদ্ভব কবি চেতনায় যে আলোড়ন তোলে তা পরবর্তীকালে ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্য চর্চায় নতুন গতিবেগ সঞ্চার করে। বিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক পরিবেশ, বাঙালির অধিকার বঞ্চনা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ কবিরা ১৯৫০-এ আশরাফ সিদ্দিকী ও আবদুর রশীদ খান সম্পাদিত 'নতুন কবিতা' গ্রন্থে তেরোজন কবি নতুন একটি পথ আবিষ্কারে প্রয়াসী ছিলেন। অনেকেই কালের স্রোতে হারিয়ে যান। কাব্যপ্রতিভার ব্যতিক্রমদীপ্তি ও মেধার স্ফুরণ ঘটে কবি শামসুর রাহমানের কবিতায়। শামসুর রাহমান দিন দিন কবিতা সৃষ্টিতে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছেন। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত 'একুশে ফেব্রম্নয়ারি' সংকলনে একদল কবি স্বদেশ প্রেরণাজাত কবিতায় পাঠককে আকৃষ্ট করেন। কবিতা ভুবনের ভূগোল বদলে দেন গ্রন্থবদ্ধ কবিরা। শামসুর রাহমান এদের মধ্যে অগ্রসর ছিলেন। তার পর্যবেক্ষণ অন্য কবিদের কবিতা রচনায় উদ্বুদ্ধ করে কবিতার ভাষা নির্মাণ, উপমা প্রয়োগ ও বর্ণনা রীতির পরিবর্তনে। শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'প্রথম গান দ্বিতীয় মৃতু্যর আগে' প্রকাশিত হয় ১৯৬০-এ। তার কবিতায় আধুনিক জীবনের কলেস্নাল ও নতুন চিন্তা-চেতনার অনুপ্রবেশ ঘটে। শামসুর রাহমান সমাজমনস্ক, প্রকৃতিপ্রেমিক ও আত্মজৈবনিক বিষয় কবিতায় ধারণ করেন।
শামসুর রাহমান প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'প্রথম গান দ্বিতীয় মৃতু্যর আগে'-তে সৌন্দর্যপ্রিয়তা, স্মৃতি ও অন্ধকার থেকে আলোতে প্রত্যাবর্তনের তৃষ্ণাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। বিষণ্নতা, নিঃসঙ্গ চেতনা, প্রেম ও নতুন পৃথিবীতে প্রবেশের প্রবল স্পৃহা গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলোয় নতুন জগৎ উন্মোচিত করেছে। আত্মমগ্ন সৌন্দর্য পিয়াসী কবি নিজের চারপাশের সবকিছু একবার পরখ করেন। অবিরত উলস্নাস ও আনন্দধ্বনি উচ্চারণে নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন। মনোজগৎ ও স্বপ্নময় পৃথিবীতে বিচরণ করে শামসুর রাহমান রচনা করেছেন, 'প্রথম গান দ্বিতীয় মৃতু্যর আগে', 'জর্নাল', 'এ্যাপোলোর জন্য', 'রূপালী স্নান', 'কবর খোঁড়ার গান', 'একান্ত গোলাপ', 'সেই ঘোড়াটা', 'তিনশ' টাকার আমি'। পৃথিবী, সৌন্দর্য, স্বপ্ন ও চারপাশের ঘটনাপ্রবাহে শামসুর রাহমান পাঠককে পরিচিত করে তোলেন।
তার কণ্ঠ আর্দ্র
ভাস্করের অসম্পূর্ণ মূর্তির ঘরে ফিরি/উলেস্নাল নগরে কত বিলোল উৎসবে, কিন্তু তবু/পারি না মেলাতে আপনাকে প্রমোদের মোহময়/বিচিত্র বিকট স্বর্গে;
(প্রথম গান দ্বিতীয় মৃতু্যর আগে)
শামসুর রাহমান আত্মমগ্নতা থেকে বেরিয়ে এসে স্বদেশ, মানুষ, রাজনীতির ঘূর্ণি, ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখে লীন হয়েছেন, রৌদ্র করোটিতে, বিধ্বস্ত নীলিমা, নিরালোকে দিব্যরথ, নিজ বাসভূমে, বন্দিশিবির থেকে, দুঃসময়ে মুখোমুখি, ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা, আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি, এক ধরনের অহঙ্কার, আমি অনাহারী, বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে, প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে, মাতাল ঋত্বিক, ইকারুশের আকাশ, কবিতার সঙ্গে গেরস্তালি, উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ, নায়কের ছায়া, একফোঁটা কেমন অনল কাব্যগ্রন্থের বিপুল ঐশ্বর্যমন্ডিত কবিতায়। ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভু্যত্থান, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জাতীয় জীবনের স্মরণীয় মুহূর্তে শামসুর রাহমান কবিতার ভূমিকে শস্যশ্যামল ও গতিময় করে তুলেছেন। দুঃখিনী বর্ণমালা, আসাদের শার্ট, স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব ও স্বাধীনতা ঘিরে তার আবেগ প্রকাশ, বর্ণনা উত্তরোত্তর আমাদের চেতনাকে শাণিত করেছে। একীভূত পাঠ যে কবিকে চেনে সে প্রথম কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গপত্র থেকে পৃথক ও দৃঢ়চেতা। শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'প্রথম গান দ্বিতীয় মৃতু্যর আগে'র উৎসর্গ অংশে উলেস্নখ করেছিলেন : আমার খামার নেই নেই কোন শস্যকণা/আছে ধুধু একটি আকাশ/তার কিছু আলো আজো সুদূরতমা/ভালোবেসে তোমাকে দিলাম।
শামসুর রাহমান জীবনানন্দের পৃথিবীকে প্রত্যক্ষ করেন। তার কবিতায় প্রকৃতি ও মানুষ একাকার। 'ধূসর সন্ধ্যা', 'ইঁদুরের মতো মৃতু্য'-এ্যাপোলোর জন্যে কবিতায় যে রূপক ব্যঞ্জনা তৈরি করেন তা বিস্ময়সূচক। শিশিরের জলে কবি অজস্র তারাকে দেখতে পান 'জর্নাল শ্রাবণ'-এ। শামসুর রাহমান কবিতার পথ ধরে দীর্ঘসময় পরিভ্রমণ করেছেন। তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ রৌদ্র করোটিতে (১৯৬৩) সৌন্দর্য রহিত এক পৃথিবী উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে চোখের সামনে। ঢাকা নগরের রুগ্ণতার প্রতিভাস তার কবিতায় লক্ষ করা যায়। ভিখেরি, মাতাল, কোলাহল, বস্তির ব্যথিত প্রতিবেশ ও মানুষের আহাজারি কবিতার ভাষাকে বিষণ্ন করে। 'সর্বনাম'-এর বিপুল ব্যবহার বারবার উঠে আসে।
দুঃখ ভারাক্রান্ত এক কবি উচ্চারণ করেন:
আমাদের বারান্দায় ঘরে চৌকাঠে/কড়িকাঠে চেয়ারে টেবিলে আর ঘাটে
দুঃখ তার লেখে নাম। ছাদের কার্নিশ, খড়খড়ি/ফ্রেমের বার্নিশ আর মেঝের ধুলোয়/দুঃখ তার আঁকে চকখড়ি
এবং বুলোয়
তুলি বাঁশি-বাজা আমাদের এই নাটে।/আমাদের এক রত্তি উঠোনের কোণে
উড়ে আসা চৈত্রের পাতায়/পান্ডুলিপি বই ছেঁড়া মলিন খাতায়
গ্রীষ্মের দুপুরে ঢকঢক/জল খাওয়া কুঁজোয় গেলাশে, শীত ঠকঠক
রাত্রির নরম লেগে দুঃখ তার বোনে/নাম
অবিরাম।...
কখনো না দেখা নীল দূর আকাশের/মিহি বাতাসের
সুন্দর পাখির মতো আমার আশায়/হৃদয়ের নিভৃত ভাষায়
দুঃখ তার লেখে নাম।
(দুঃখ : রৌদ্র করোটিতে)
'দুঃখ' শামসুর রাহমানের চোখে সর্বব্যাপী। একজন দুঃখী মানুষ চারপাশের সব স্থানে তার বেদনাকে পস্নাবিত রাখে। যাপিত জীবনে সে বারবার সুন্দরকে স্পর্শ করার আকাঙ্ক্ষায় যেমন ব্যাকুল থাকে, আনন্দকে ভাগ করে নেওয়ার শক্তি তার মধ্যে ক্রিয়াশীল সেভাবেই। বেদনা ও দুঃখ সমার্থক অর্থ বহন করে তার জীবনে। দুঃখের মধ্যেও এক ধরনের ব্যাপকতা, স্পর্শ চেতনা শামসুর রাহমান জাগরিত রাখেন।
শামসুর রাহমান আত্মপ্রত্যয়ী। তার সৌন্দর্যপিয়াসু কবিসত্তা স্বদেশ ও সমকালের চিত্রগুলো একত্রিত করে যে ক্রমবহমান সেলুলয়েডের ফিতার আটকে দেয়, সমাজজীবনে তা আমাদের প্রেরণার উৎস হিসেবে বিবেচিত। রৌদ্র করোটিতে বস্তুবাদী বিশ্বের যে পরিচিত ব্যাপ্ত হয় তা তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ 'বিধ্বস্ত নীলিমা'তে প্রসারমান হয়ে ঢাকার নগর জীবনে ঢুকে পড়ে।
শামসুর রাহমান কঙ্কাল সঙ্গে নিয়ে হাঁটেন। নিজেকে আবিষ্কার, শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিবাহী ঘটনার সঙ্গে বর্তমানের মেলবন্ধ তৈরি করে কবি সময়কে চিত্রিত করে। সমকাল প্রবাহিত জীবন অতীত-ভবিষ্যতের দিকে হাত তুলে ধরে। কবির নিবিড় সমাজলগ্নতা অন্তরঙ্গময় :
আমি এক কঙ্কালকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটি, প্রাণ খুলে/কথা বলি পরস্পর। বুরুশ চালাই তার চুলে,/বুলোই সযত্নে মুখে পাউডার, দর্জির দোকানে নিয়ে তাকে
ট্রাউজার শার্ট, কোর্ট ইত্যাদি বানিয়ে ভদ্রতাকে/সঙ্গীর ধাতস্থ করি। দু'বেলা এগিয়ে দিই নিজে/প্রত্যহ যা খাই তাই। কখনো বৃষ্টিতে বেশি ভিজে।...
আমি এক কঙ্কালকে সঙ্গে নিয়ে চলি দিন-রাত/অসঙ্কোচে, আতঙ্কের মুখোমুখি কখনো হঠাৎ/তাকে কবি আলিঙ্গন, প্রাণপণ ডাক নামে ডাকি
দাঁড়িয়ে সত্তার দ্বীপে নি-শিকড় একা আর ঢাকি.../দুজনের অস্তিত্বের গ্রন্থিল জগতে, বুঝি তাই/ঘৃণায় পোড়ায় তাকে, কখনো হৃদয়ে দিই ঠাঁই।
(যে আমার সহচর : বিধ্বস্ত নীলিমা)
শামসুর রাহমান অসংখ্য কবিতা রচনা করেছেন। প্রত্যেক কবিতায় তার নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি তাকে পাঠকের কাছে নিয়ে গেছে। তবু বলতে হবে বাংলাদেশের অভু্যদয় ও পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনাবর্তে তিনি যা কিছু কবিতার উপাদান সংগ্রহ করেন তা ভিন্ন ব্যঞ্জনাময়। দুঃসময় যখন আসে নীলিমা ধূসর হয়, মানুষ বদলে যায়। যে বিশ্বাস ও ঐক্যবদ্ধতা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত করেছিল তা পরবর্তী সময়ে ম্নান হয়ে যায় স্বার্থ চিন্তায়। কবিমাত্রই দুঃসময়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়। শামসুর রাহমান সচেতনভাবে দুঃসময়কে মোকাবিলা করার জন্য নিজেকে তৈরি করে এগিয়ে গেছেন সামনে। তার দুঃখ জীবনযাপন ও প্রতিবেশ স্পর্শকাতর করে তোলে কবিতা। স্বপ্ন, প্রেম ও জাগতিক তৃষ্ণায় ব্যাকুল কবি সংবাদ পৌঁছে দেন সংবাদকর্মীর মতো। তার স্বীকারোক্তি : যখন তোমার সঙ্গে আমার হলো দেখা/লেকের ধারে সঙ্গোপনে, বিশ্বে তখন মন্দা ভীষণ, রাজায় রাজায়/চলছে লড়াই উলুর বনে।
(প্রেমের কবিতা)
শামসুর রাহমানের কবিতায় পিতা, পুত্র ও স্বজনের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। তিনি ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক সম্পর্ক ও সমাজের উত্থান-পতনকে কবিতায় বন্দি করেন। একজন সচেতন কবি তার সময় থেকে দূরে থাকতে পারেন না। পিতার মুখ উদ্ভাসিত হয় এভাবে সেদিন দেখেছি স্বপ্নে এলেন তিন ম্স্নান/জটিল পাঁচিল ঘেঁষে এলেন আমার পিতা/মৃত/ক্রুদ্ধ/অনুযোগে কম্পমান/তবে কি বেয়াড়া কিছু ঘটেছে শহরে; (অধমর্ণের গান)
শামসুর রাহমান 'হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো' ও 'শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা' গ্রন্থে রূপময় স্বদেশ, শস্যশ্যামল ভূমি ও কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের উদ্দেশ্যে তার অভিসারের দিকনির্দেশ করেছেন। তিমির বিনাশী কবি বারবার ফিরে আসতে চেয়েছেন জীবনানন্দের বাংলায়। শামসুর রাহমান চোখের সামনে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করেছেন। আশা প্রবলভাবে তাড়িত। মাঝেমধ্যে নিরাশা-দুর্ভাবনা তাকে আলোড়িত করেছে। তিনি দুঃসময় ও অন্ধকার থেকে আলোর মোহনায় পৌঁছে গেছেন। শামসুর রাহমানের কবিতায় স্বদেশ উর্বরা, শত্রম্নমুক্ত ও নিরাপদ। তিনি কবি হিসেবে বিশ্বাস করেন স্বপ্ন জ্বালিয়ে রাখতে হয়। ভবিষ্যৎ আশা ও আলোময় হয়ে উঠবে এ বিশ্বাস থেকে কবির কবিতা হয়ে ওঠে মানুষের পথচলার আলোকবর্তিকা। কবি তো ভবিষ্যৎদ্রষ্টা।