শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১

নিখুঁত গদ্যের ভেতর সাবলীল পদ্যের উজ্জ্বলতা

আতাতুর্ক কামাল পাশা
  ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
নিখুঁত গদ্যের ভেতর সাবলীল পদ্যের উজ্জ্বলতা

২০২৪-এর সাহিত্যে বিশ্বনন্দিত নোবেল পুরস্কার পান দক্ষিণ কোরীয় লেখক তেপ্পান্নবর্ষী হান কাং। (এখানে তার নামের উচ্চারণ নিয়ে অনেকে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। তবে পুরস্কার ঘোষক ম্যাট স্মল, সুইডিশ নোবেল কমিটির স্থায়ী সেক্রেটারি তার নাম হান কাং উচ্চারণ করছিলেন। তবু আমাদের প্রাচ্যের ধারায় এখানে নামটি হান ক্যং উচ্চারণ করা হলো ও সেভাবে লেখা হলো। প্রাচীন মাঞ্চুরিয়ার রীতি অনুসারে আমরা ক্যং উচ্চারণে অভ্যস্ত।) তার লেখা ফিকশনগুলো নোবেল কমিটির কর্তা ব্যক্তিদের কাছে একদিকে ভাষায় সমৃদ্ধ লেগেছে। একইসঙ্গে এগুলো জীবনের জটিল বিষয়গুলোকে তীব্রতার সঙ্গে আলোকোজ্জ্বল করেছে। অথচ এসব প্রকাশে পাঠকদের কাছে অত্যন্ত কোমল আখ্যানে তুলে ধরেছেন হান ক্যং। নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান অন্ডার্স ওলসন তাকে পুরস্কার দেয়ার সময় বলেন, শরীর এবং আত্মা আর জীবিত ও মৃতের মধ্যে সংযোগ সম্পর্কে তার একটি অনন্য সচেতনতা রয়েছে। ফিকশনগুলোতে ভাষা প্রয়োগে তার এমন এক ধরনের কাব্যিক শৈলী রয়েছে- যা পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করেও তিনি এক সফল উদ্ভাবনার কাজ করেছেন।

বলা চলে ইয়াসুনারী কাওয়াবাতা, রবীন্দ্রনাথ, কেনজাবুরো ওয়ে ও মো ইয়ানের পর সাহিত্যে তিনিই প্রকৃত এশীয় হিসেবে নোবেল পেলেন। এশিয়ায় থাকা এবং এশিয়ার (চীনের) পটভূমিতে লেখা দি গুড আর্থ লিখেও পার্ল এস বাক নোবেল পান। তবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের লেখক বলে পরিচয় দেন। অন্য এক জাপানি বংশোদ্ভূত কাজুও ইশিগুরি নোবেল পেলেও তিনি বিলেতি নাগরিকতা গ্রহণ করেছেন। কাওয়ো শিংচিয়েন চৈনিক বংশোদ্ভূত হলেও পরবর্তী সময়ে ফরাসি নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। সে হিসেবে এশিয়ায় হান ক্যং সাহিত্যে নোবেল পাওয়া চতুর্থ এশীয়।

তবে ২০২৪-এর নোবেলই যে তার প্রথম স্বীকৃতি এমনটি নয়। এর আগেও তিনি ১৯৯৯ সালে কোরীয় উপন্যাস পুরস্কার, ২০০০ সালে কোরীয় সংস্কৃতি মন্ত্রক পুরস্কার, ২০০৫ সালে ই স্যাং সাহিত্য গোষ্ঠীর মঙ্গোলিয়ান মার্ক, ২০১০ সালে ডাংরী সাহিত্য পুরস্কার, ২০১৪ সালে ম্যানহো সাহিত্য পুরস্কার, ২০১৫ সালে হুয়াং সুন সাহিত্য পুরস্কার, ২০১৬ সালে ম্যান বুকার পুরস্কারসহ আরো বেশ কিছু পুরস্কার অর্জন করেন।

সম্ভবত, কম বয়েসে যারা সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন তাদের মধ্যে হান ক্যংও একজন। ১৯৭০ সালের ২৭ নভেম্বর তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়াংজুতে জন্মগ্রহণ করেন। তবে ৯ বছর বয়সে তাদের পরিবার রাজধানী সিউলে চলে আসেন। তারা চার ভাইবোন। এর মধ্যে বড় ভাই, হান ডং-রিম একজন ঔপন্যাসিক ছিলেন। তার অন্য ভাইটি হান গাং-ইন, সে-ও একজন ঔপন্যাসিক এবং কার্টুনিস্ট ছিলেন। তার বাবা হান সিওয়েং ওন প্রথমে শিক্ষকতা করেন। পরে ঔপন্যাসিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন যদিও তা থেকে সংসার চালানোর মতো যথেষ্ট অর্থ আসেনি। বলা চলে হান ক্যং পুরো একটি সাহিত্য পরিবারেই বড় হয়েছিলেন। তার বিয়ে হয় হং ইয়ং-হি-এর সঙ্গে এবং তাদের একটি সন্তান রয়েছে। স্বামী একজন সাহিত্য ও শিল্প সমালোচক এবং কাইয়ুং হি সাইবার ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক। বর্তমানে ছেলেকে নিয়ে হান ক্যং সিউলে একটি বইয়ের দোকান চালান এবং এর পাশাপাশি লেখালেখিও করছেন। যা হোক, ১৯৯৩ সালে সিউলের ইয়েনসেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোরীয় ভাষা ও সাহিত্যে গ্র্যাজুয়েশন করেন। পরের বছরই কোরীয় সাহিত্য পত্রিকায় এক গুচ্ছ কবিতা লেখেন এবং তাতেই তিনি তার পরের বছর সিউল শিনমান সংবাদপত্রের পুরস্কার অর্জন করেন। তিনি ১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক লেখার প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। সে বছরই শেষের দিকে তার প্রথম উপন্যাস রহস্য কালো হরিণ প্রকাশিত হয়।

ক্যং ও তাদের পরিবার গোয়াংজু শহরের বিদ্রোহের চার মাস আগে সে শহর ছেড়ে সিউলে চলে এসে সেখানে বসবাস শুরু করেন। এ সময়ে তার জন্মের শহরে দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে একটি বিশাল গণবিদ্রোহ সংঘটিত হয়। এ বিদ্রোহ তার শৈশব মনে বিশাল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। পরবর্তী সময়ে তিনি বলেছেন, এ বিদ্রোহ তাকে বেঁচে থাকার এক ধরনের অপরাধবোধে আচ্ছন্ন করে রাখত। শৈশবে তার বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা বেশি ছিল না বলেই বইভর্তি ঘরে তিনি একাকী সময় কাটাতেন। পরবর্তী সময়ে এই বইগুলোই তার সাথী হয়ে ওঠে। ছোটবেলায় হানের প্রিয় লেখকদের মধ্যে ছিল কোরীয় লেখক ক্যং সো-চেওন এবং মা হে-গান। তিনি সুইডিশ শিশু লেখক অ্যাস্ট্রিড লিন্ডগ্রেনের দ্য ব্রাদার্স লায়নহার্ট (১৯৭৩) পড়েছেন। কিশোর বয়সে, তিনি ফিওদর দস্তয়ভস্কি এবং বরিস পাস্তেরনাকের মতো লেখকদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন এবং লিম চুল-উয়ের ছোট গল্প 'সাপিয়ং স্টেশন' (২০০২) দ্বারা সাহিত্যে হান ক্যংয়ের লেখামালায় আকৃষ্ট হয়েছিলেন।

ক্যংয়ের শৈশবকালে গুয়াংজুতে যে সামরিক শাসনের বীভৎসতা তার মনে রেখাপাত করে তাতে তার ফিকশন লেখার মনন তৈরি হয়। তার গদ্যের ধারাটি প্রায়শই পরীক্ষামূলক হিসেবে পাঠকদের কাছে মনে হতে থাকে এবং এক ধরনের রূপক (সিম্বলিক নয়) পরিবেশ দ্বারা আচ্ছন্ন বিবেচিত হয়। সেখানে সহিংসতা ও শোক সংমিশ্রণের আবহ থাকে। এগুলো পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা হিসেবে পাঠকরা বিবেচনা করতে থাকে।

২০১৬ সালে দ্য হোয়াইট রিভিউ-এর সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন, 'মানবতার বিস্তৃত বর্ণালি যা সর্বশ্রেষ্ঠ থেকে নৃশংস গতির দিকে চলে, এমন ধরনের একটি কঠিন হোমওয়ার্কের ভেতর দিয়ে তার ছোটবেলার দিনগুলো অতিবাহিত হয়। তিনি তার বইগুলোকে মানব সহিংসতার বিভিন্ন সমস্যার বর্ণনা বলে মতপ্রকাশ করেন।

হান ক্যং-এর ইওর কোল্ড হ্যান্ডস ২০০২ সালে প্রকাশিত হলেই তার লেখার যে শৈল্পিক জ্ঞান ও দক্ষতা তা খুব সহজেই দক্ষিণ কোরিয়ার পাঠকদের আকৃষ্ট করে। এখানে তিনি একটি নিখোঁজ ভাস্কর্যের রেখে যাওয়া একটি পান্ডুলিপি রূপান্তর করেন- যেখানে নারীদেহের একটি পস্নাস্টার প্রতিস্থাপনে মগ্ন একটি শিল্পীকে দেখা যায়।

তার লেখা দ্য ভিজিটারিয়ান (রচনা-২০০৭) ২০১৫ সালে ইংরেজিতে অনুবাদ হলে সেখানে দেখা যায়, এক কর্তব্যপরায়ণ স্ত্রীর সামাজিক নিয়মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। তাকে মাংস খেতে বারণ করা হয়। পরিবারে তাকে নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। তার পরিবার তার অপছন্দেও জিনিসগুলো খেতে দেয় এবং তার পরিণতিতে সে খাওয়া বন্ধ করে দেয়। কারণ, তারা মনে করে, সে মানসিকভাবে অসুস্থ। এ বইটির জন্য তাকে ম্যানবুকার পুরস্কার দেয়া হয় ২০১৬ সালে। কিছু সমালোচক এ বইতে নায়কের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং তার পরিবারের প্রতিক্রিয়াকে ঔপনিবেশিক এবং সাম্রাজ্যবাদের সহিংসতার রূপক হিসেবে ব্যাখ্যা করে।

২০১১ সালে তিনি গ্রিক পাঠ (এৎববশ খবংংড়হং) লেখেন যেটি ২০২৩ সালে ইংবেজিতে অনুবাদ হয়। এ বইতে দুঃখের অন্বেষণ এবং ভাষার ওপর তার নিরীক্ষীত প্রভাব পাঠকদের আকৃষ্ট করে। এখানে দেখা যায়, একজন পুরুষ তার দেখার ক্ষমতা হারাচ্ছে আর একজন নারী তার কথা বলার ক্ষমতা হারাচ্ছে। এ উপন্যাসটিতে সমাজ ও ব্যক্তি জীবনকে দেখার তীক্ষ্ন দৃষ্টি এবং (উপন্যাসের) গল্পের যে নিখুঁত গতিপ্রবাহ যা অত্যন্ত স্বাভাবিক করে গ্রন্থন করা হয়েছে তা সব পাঠককে আচ্ছন্ন করে। হান ক্যং এ বইতে তার নিজস্ব উপলব্ধি পাঠকদের মাঝে সুন্দরভাবে প্রবাহিত করতে পেরেছেন সেটিই লেখকের স্বীকৃতি এনে দেয়।

দ্য হোয়াইট বুক ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক বুকারের জন্য চূড়ান্ত ছিল। এ বইটিতে একজন নামহীন মহিলার বোনের প্রশংসা করার জন্য একটি খন্ডিত প্রথম-ব্যক্তির আখ্যান ব্যবহার করা হয় যেখানে সে জন্মের দুই ঘণ্টা পর মারা গিয়েছিল। এর ভূতুড়ে কাহিনীর বলিষ্ঠতা খুবই উচ্ছসিত প্রশংসা অর্জন করে।

হিউম্যান অ্যাক্টস্‌ (ঐঁসধহ অপঃং) ২০১৪ সালে লেখেন এবং ২০১৬ সালে ইংরেজিতে অনুবাদ হয়। এখানে তিনি শৈশবের গোয়াংজু বিদ্রোহের স্মৃতিচারণ করেছেন। উই ডু নট পার্ট (ডব ফড় হড়ঃ ঢ়ধৎঃ) বইটি ২০২১ সালে হান লেখেন। এ বইটি একটি উন্নত কথাসাহিত্যের কাজ করে। এ উপন্যাসে ১৯৪০ সালের মাঞ্চুরিয়ার জেজু দ্বীপে সাধারণ মানুষের দ্বারা সৃষ্ট একটি বিদ্রোহ কেমন করে কোরিয়ার সরকার কঠোরভাবে দমন করে সেটি তুলে ধরা হয়েছে।

হান ক্যংয়ের দুটি উপন্যাসের কাহিনী অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়। এর একটি দ্য ভিজিটারিয়ান এবং অন্যটি স্কারস্‌-এর কাহিনী অবলম্বনে। দুটোরই পরিচালক ছিলেন লিম উ-সিওং।

হান ক্যংয়ের লেখামালায় প্রধান যে বিষয়টি মানুষকে আপস্নুত করে তা হচ্ছে একজন জীবিত মানুষের সঙ্গে একটি মৃত মানুষের মধ্যে কথা আদান-প্রদান। আর এ কাজটি তিনি এমনভাবে সজ্জিত করেছেন যে তা কোনোভাবেই অসংলগ্নতায় আচ্ছন্ন হয় না। একইসঙ্গে তিনি যুদ্ধ-বিদ্রোহকে খুব কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন- যা কথাসাহিত্যে হলেও সুন্দর মোলায়েম কাব্যিক ভাষায় প্রকাশ করতে পেরেছেন। এই বিশেষত্বগুলোই বর্তমান পাঠক সমাজকে আলোড়িত করবে।

উপসংহার : প্রতিদিন প্রতি বছর গবেষকরা যেমন শানিত অস্ত্রের আরো আধুনিক ভার্সান বানিয়েই চলছেন ঠিক সেরকম সাহিত্যেও বিভিন্ন ধরনের পালাবদল ঘটছে নিরন্তর, পরীক্ষণ-বীক্ষণ চলছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৪৫৩ সালে যখন কন্সতান্তিনোপল অটোম্যান শাসকরা দখল করে তখন ইউরোপীয় পন্ডিতরা তাদের রেনেসাঁর বাণী পৃথিবীময় ছড়িয়ে দিতে থাকে- যা ১৪ শতক থেকে ১৭ শতক পর্যন্ত স্থায়ীরূপ ধারণ করে। নানা ধরনের সিম্বলিজম, কিউবিজম, এক্সপ্রেসলিজম, স্যাররিয়ালিজম, ডাডাইজম, ইত্যাদি মতবাদের সৃষ্টি হয়। ১৯৮০ সালের দিকে সল বেলো এগজিসটেনশিয়ালিজম তত্ত্ব্ব সৃষ্টি করে তার উপন্যাস লিখতে থাকেন। এরপর সাহিত্য ও শিল্পাঙ্গনে আরো নতুন পরিসর তৈরি হয়। সাহিত্য মানচিত্র অতিক্রম করতে থাকে, সময় অতিক্রম করতে থাকে। যেমনটি করেছিলেন মো ইয়ান, কাজুও ইশিগুরি, ওলগা তোকারজুক ও সমকালীনরা। এবার বিশ্ব নতুন কিছু সৃষ্টি দেখতে পেল, মৃতের সঙ্গে জীবিতের সমকালে অবস্থান এবং চলাফেরা। এ কাজটিই করেছেন হান ক্যং। তবে তা খুব সুচারুরূপে করতে পেরেছেন যা বুদ্ধিদীপ্ত পাঠক স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারে। একই ধরনের কাজ ম্যান বুকারখ্যাত শ্রীলংকান শেহান করুণাতিলক করেছেন তবে তা সরাসরি মৃতদের বর্তমান কালে এনে। তবে হান ক্যং যে নিখুঁত গদ্যের ভেতর দিয়ে অত্যন্ত সাবলীল পদ্যের মতো মৃত ও জীবিতকে পাশাপাশি সমকালের জীবনে স্থাপন করেছেন, তা সত্যিই অতুলনীয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে