নোবেল জয়ী হান কাং ও তার উপন্যাস

হান কাং-এর জন্ম ১৯৭০ সালের ২৭ নভেম্বর গোয়াংজুতে। গোয়াংজু সিউলের পর দক্ষিণ কোরিয়ার একটি বড় শহর। তার পিতা হান সিয়ুং-ওনও একজন উপন্যাসিক

প্রকাশ | ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

আহমদ মতিউর রহমান
২০১৬ সালে ম্যান বুকার ইটারন্যাশনাল প্রাইজ লাভের মধ্য দিয়ে লাইম লাইটে আসেন তিনি। এর ৮ বছর পর নোবেল জয়ের মধ্য দিয়ে এ বছর তার ষোলোকলা পূর্ণ হলো। তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার ঔপন্যাসিক হান কাং। অনেক বছর পরে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার এলো এশিয়াতে। হান কাং সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করলেও প্রধান পরিচয় তার নভেলিস্ট। এই নভেলে আছে নতুন জীবনের কথা, উঠে এসেছে প্রত্যাশা ও অচরিতার্থতার বেদনা। তার উপন্যাসে রয়েছে জীবনার্থ। আধুনিক উপন্যাস মানেই আত্মজৈবনিক। উপন্যাসিকের জীবনার্থের মধ্য দিয়ে সমাজের আর ১০ জনের কথাও উঠে আসে। হান কাং এখন সারা বিশ্বে পঠিত হবেন। এশিয়ার জীবনাচার সম্পর্কে পশ্চিমরা জানতে পারবে। হান কাং কেন পেলেন এই পুরস্কার? নোবেল কমিটির সাইটেশনে বলা হয়, হান কাংয়ের লেখায় মানবজীবনের দুঃখ-কষ্টের নানা দিক ও ইতিহাসের সঙ্গে এর সম্পর্ক প্রকাশ পেয়েছে। ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে মানুষের জীবন ও অনুভূতিগুলোকে খুব তীক্ষ্ন ও কাব্যিকভাবে বর্ণনা করেছেন তিনি। নোবেল কমিটি তার প্রসঙ্গে বলেছেন, 'তিনি সংগীত ও শিল্পের জন্য তার জীবন উৎসর্গ করেছেন। ...'তার কাজ বিভিন্ন ধরনের শৈলীকে একত্র করে নতুন কিছু তৈরি করেছে। এই কাজগুলোয় সহিংসতা, শোক ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজের মতো জটিল বিষয়গুলোকেও তুলে ধরেছেন তিনি।' সাহিত্যে নোবেলজয়ী নির্ধারণ করে সুইডিশ একাডেমি। নোবেল পুরস্কারের উদ্যোক্তা আলফ্রেড নোবেল উইল করে বিষয়টি ঠিক করে গিয়েছিলেন। ১৯০১ সাল থেকে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে। হান কাং ১৮তম নারী, যিনি সাহিত্যে বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাবান এ পুরস্কারে জিতেছেন। বলা হচ্ছে- ঝযব ধিং ধধিৎফবফ :যব-২০২৪ ঘড়নবষ চৎরুব রহ খরঃবৎধঃঁৎব ভড়ৎ 'যবৎ রহঃবহংব ঢ়ড়বঃরপ ঢ়ৎড়ংব :যধঃ পড়হভৎড়হঃং যরংঃড়ৎরপধষ ঃৎধঁসধং ধহফ বীঢ়ড়ংবং :যব ভৎধমরষরঃু ড়ভ যঁসধহ ষরভব্থ, নবপড়সরহম :যব ভরৎংঃ অংরধহ ভবসধষব ঘড়নবষ চৎরুব ষধঁৎবধঃব রহ খরঃবৎধঃঁৎব ধহফ :যব ঝবপড়হফ কড়ৎবধহ ঘড়নবষ চৎরুব খধঁৎবধঃব. (উইকিপিডিয়া) নোবেল পুরস্কারে লেখকরা প্রাধান্য বিস্তার করে আছেন, এ পর্যন্ত মাত্র ১৭ জন লেখিকা এ পুরস্কার পেয়েছেন। ২০২২ সালে ফ্রান্সের অ্যানি এরনক্স পেয়েছিলেন আর এবার পেলেন হান কাং। তার পুরস্কার প্রাপ্তিকে লেখিকাদের উচ্চকিত করা হলো বলে মনে করা হচ্ছে। আর দক্ষিণ কোরীয় একজন লেখিকার এই পুরস্কার বিজয়ে এশিয়া জুড়ে আনন্দ হিলেস্নাল বইবে এটা স্পষ্ট। তবে কোরিয়া যে বিশ্ব সাহিত্য অঙ্গনে নতুন করে পাকা আসন করে নিতে চলেছে সে কথাও মনে রাখতে হবে। কোনো কোরীয় সাহিত্যিকের জন্য এটা যেমন বড় বিজয় তেমনি, এশিয়ার দিকে নতুন দৃষ্টি নিক্ষেপও অভিনিবেশসহকারে দেখা হবে সে কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু বইয়ের জগতে জীবন্ত কিংবদন্তি হিসেবে পরিচিত জাপানের হারুকি মুরাকামির এশিয়ান হিসেবে এই পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা কার্যত আর থাকলো না। বিগত কয়েক বছর ধরে মুরাকামির নাম সম্ভাব্য বিজয়ী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছিল। কিন্তু তিনি তা পাননি। ২. 'দ্য ভেজিটেরিয়ান' উপন্যাসের জন্য হান ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ পান ২০১৬ সালে। বইটি যদিও তারও প্রায় এক দশক আগে প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু ডেবোরা স্মিথের ইংরেজি অনুবাদ ২০১৫ সালে প্রকাশিত হওয়ার পরই এটি বিশ্বব্যাপী পাঠকদের কাছে পৌঁছে যায়। ২০১৮ সালে হান কাংয়ের তৃতীয় উপন্যাস 'দ্য হোয়াইট বুক'ও বুকার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজের শর্টলিস্টভুক্ত হয়েছিল। হান কাং-এর জন্ম ১৯৭০ সালের ২৭ নভেম্বর গোয়াংজুতে। গোয়াংজু সিউলের পর দক্ষিণ কোরিয়ার একটি বড় শহর। তার পিতা হান সিয়ুং-ওনও একজন উপন্যাসিক। বলতে গেলে তার লেখক হয়ে ওঠা তার পিতার পথ ধরেই। তিনি ইয়োনসি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোরীয় সাহিত্য নিয়ে লেখাপড়া করেছেন। তার ভাই হান ডং রিমও একজন লেখক। হান কাং লেখা শুরু করেছেন কবিতা দিয়ে। তার এর একটি লেখা লিটারেচার অ্যান্ড সোসাইটি পত্রিকার শীত সংখ্যায় বেশ গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হলে তিনি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ১৯৯৩ সালে পাঁচটি কবিতা প্রকাশ করে তিনি সাহিত্যজগতে পা রাখেন। এরপর একটি ছোটগল্পের মাধ্যমে কথাসাহিত্যে তার পথচলা শুরু। দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল ইনস্টিটিউট অব আর্টসের সৃজনশীল লেখার শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি তিনি সাহিত্যচর্চা করেন। পরের বছর তার একটি গল্প ডেইলি সিউল শিনমুন-এর স্প্রিং লিটারেরি কনটেস্টে বিজয়ী হওয়ার পর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর এ পর্যন্ত তার ৭টি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। এরপর পেয়েছেন একের পর এক সাহিত্য পুরস্কার। তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলের ইনস্টিটিউট অব আর্টস-এর ক্রিয়েটিভ রাইটিং বিষয়ের একজন শিক্ষক। তিনি এর আগে ই সাং লিটারেরি প্রাইজ, টুডেজ ইয়ং আর্টিস্টস অ্যাওয়ার্ড এবং কোরিয়ান লিটারেচার নোভেল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। হান ১৯৯৯ সালে তার নভেলা বেবি বুদ্ধের জন্য ২৫তম কোরীয় নোভেল অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। বেবি বুদ্ধ ও দ্য ভেজিটেরিয়ান নিয়ে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। ভেজিটেরিয়ান চলচ্চিত্র দেশে-বিদেশে কয়েকটি অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছে। দ্য ভেজিটেরিয়ান ইংরেজিতে অনূদিত তার প্রথম উপন্যাস। তার লেখা বই ৩০টির বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ৩. হানের প্রথম বই 'এ কনভিক্টস লাভ' প্রকাশিত হয় ১৯৯৫ সালে। এটি তার ভাষা বৈশিষ্ট্যের গুণে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। একই বছর প্রকাশিত হয় তার কবিতা সংকলন 'লাভ অব ইয়োস'। ১৯৯৮ সালে হান যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়াতে ইউনিভার্সিটি অব আইওয়া ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং প্রোগ্রামে অংশ নেন। ১৯৯৮ সালে কোরিয়া থেকে প্রকাশিত হয় তার উপন্যাস 'দ্য বস্নাক ডিয়ার'। ২০০০ সালে কোরিয়াতে প্রকাশিত হয় 'ফ্রুটস অব মাই ওম্যান'। এর পর প্রকাশিত হয় তার আরো চারটি উপন্যাস : ইয়োর কোল্ড হ্যান্ড (২০০২), দ্য ভেজিটেরিয়ান (২০০৭), ব্রিথ ফাইটিং (২০১০) এবং গ্রিক লেসন্স (২০১১) দ্য ভেজিটেরিয়ান তিন খন্ডে লেখা একটি উপন্যাস। বলা হয়ে থাকে পরাবাস্তববাদী উপন্যাস। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন দায়িত্ব সচেতন কোরীয় স্ত্রী ইয়ং হাই। যিনি স্বপ্নের দ্বারা কমবেশি তাড়িত, তিনি একদিন সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি ভেজিটেরিয়ান অর্থাৎ নিরামিশ ভোজি হবেন, গোশত খাবেন না। দক্ষিণ কোরিয়ার ফুড হ্যাবিট বা খাদ্যাভ্যাস অনুযায়ী যা তিনি খুবই আনকমন বা ব্যতিক্রমী ঘটনা। বলা যত সহজ সারা জীবন গোশত বর্জন করা তত সহজ নয়। তবে ভারতে এমনকি আমাদের দেশেও বিপুলসংখ্যক মানুষ পাওয়া যাবে যারা নিরামিষাশী। কিন্তু কোরিয়ায় তা ব্যতিক্রমী মাত্র। এই ব্যতিক্রমী চরিত্র সৃজনই এই উপন্যাসের মূল বৈশিষ্ট্য। ইয়ং হাই চরিত্রের এই আখ্যান, তার আত্মীয়স্বজনের বিশেষ করে তার বোন ও ভগ্নিপতির সঙ্গে এ নিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রাণ পেয়েছে এই উপন্যাসে। তিনটি ভিন্ন ভিন্ন কণ্ঠে তিনটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে একজন সাধারণ নারীর প্রচলিত রীতি ভাঙার চমৎকার আখ্যান দ্য ভেজিটেরিয়ান। একজন স্ত্রীর ধীরে ধীরে নিরামিষাশী হয়ে যাওয়ার কাহিনী চমৎকারভাবে এ উপন্যাসে উঠে এসেছে। এর ভাষা অনন্য সাধারণ হওয়ায় তা পাঠককে আপস্নুত করে। উত্তর কোরিয়া কমিউনিস্ট নিয়ন্ত্রিত আর দক্ষিণ গণতান্ত্রিক। এই সুবাদে সেখানে মার্কিনি প্রভাব বেড়েছে। লেখালেখির দুনিয়ায় নিয়ন্ত্রণ না থাকায় দক্ষিণ কোরীয় সাহিত্য বৈশ্বিক সাহিত্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়েছে। হাং-এর উত্থান সে কথাই বলছে। হান কাং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ও ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের বৈশ্বিক বিপর্যয়ের কারণ দেখিয়ে পুরস্কার প্রাপ্তির পর সংবাদ সম্মেলন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এখানে তার যুদ্ধবিরোধী মনোভাবেরই প্রকাশ ঘটেছে। এই যুদ্ধবিরোধী মনোভাব হান কাংকে অনেক দূর এগিয়ে নেবে বলে সাহিত্য বোদ্ধাদের অভিমত। হ্যানের উপন্যাস হিউম্যান অ্যাক্টস ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে পোর্টোবেলো বুকস কর্তৃক প্রকাশিত হয়। হান ১ অক্টোবর, ২০১৭ তারিখে ইতালিতে 'হিউম্যান অ্যাক্টস' উপন্যাসের ইতালীয় অনুবাদের জন্য প্রিমিও মালাপার্ট পুরস্কার পেয়েছেন। তার ২০১৭ সালে প্রকাশিত আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস 'দ্য হোয়াইট বুক'ও একটি ব্যতিক্রমী রচনা। এর কাহিনী গড়ে উঠেছে তার বড় বোনের জীবনে ঘটে যাওয়া বিশাল আঘাতের ওপর ভিত্তি করে। এখানে একটি শিশু তার জন্মের দুই ঘণ্টা পরে মারা যায়। সেই বেদনা ধারণ করে তার মা। সেই মায়ের আবেগ অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে এই উপন্যাসে। হ্যানের উপন্যাস 'উই ডো নট পার্ট' ২০২১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। এটি ১৯৪৮-৪৯ জেজু বিদ্রোহ এবং তার বন্ধুর পরিবারে এর প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী একজন লেখকের গল্প বলে। উপন্যাসটির ফরাসি অনুবাদ ২০২৩ সালে প্রিক্স মেডিসিস এট্রেঞ্জার জিতেছে। ২০২৩ সালে হ্যানের চতুর্থ পূর্ণ দৈর্ঘ্যের উপন্যাস গ্রিক লেসন ডেবোরা স্মিথ ও ই ইয়াওন দ্বারা ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছিল। দ্য আটলান্টিক সাময়িকী এটির ভূয়সী প্রশংসা করেছে। ঞযব অঃষধহঃরপ পধষষবফ রঃ ধ নড়ড়শ রহ যিরপয 'ড়িৎফং ধৎব নড়ঃয রহংঁভভরপরবহঃ ধহফ :ড়ড় ঢ়ড়বিৎভঁষ :ড় :ধসব'. - এটি এমন একটি বই যেখানে 'শব্দগুলো পরিস্থিতি বর্ণনা করার জন্য অপর্যাপ্ত ও খুব শক্তিশালী'। হানের নতুন উপন্যাস উই ডু নট পার্ট-এর ইংরেজি অনুবাদ ২০২৫ সালে প্রকাশিত হবে। এই উপন্যাসে ১৯৪৮-৪৯ এর জিজু গণ-অভু্যত্থানের কাহিনী সেট করা হয়েছে। আছে পরিবারগুলোতে এর ইমপ্যাক্ট নিয়ে চিত্র। ২০২৩ সালে এই বইটির ফরাসি অনুবাদ ফ্রান্সের প্রিঁ মেডিসিস সাহিত্য পুরস্কার লাভ করে। ৫. আগেই বলেছি, হান কাংয়ের রচনাশৈলী ও ভাষা বৈশিষ্ট্য অন্যদের থেকে আলাদা। সমালোচকদের ভাষায়, তার রচনাশৈলীর একটি উলেস্নখযোগ্য দিক হলো এর কাব্যিক গুণ। তার গদ্য প্রায়শই একটি গীতি ছন্দ বা লিরিক্যাল রিদমের সঙ্গে প্রবাহিত হয়, তার আখ্যানগুলোকে সৌন্দর্য এবং কমনীয়তার অনুভূতি দিয়ে আবদ্ধ করে। এই কাব্যিক ভাষাটি তার গল্পগুলোর আবেগময় অনুরণনকে উচ্চকিত করে, পাঠকদের তার চরিত্রগুলোর অভ্যন্তরীণ জগতের দিকে আকর্ষণ করে। -এর বাইরে তিনি বিষয়ের গভীরে যান, বিস্তারিত তুলে ধরেন।' পরাবাস্তববাদ ধরা দেয় তার উপন্যাসে নতুন আবহ হিসেবে। তার নতুন উপন্যাসে সেই ধারা আরো অগ্রসর হয় কিনা সেটা দেখা যাবে আগামী দিনগুলোতে।