আজকাল জ্যামে পড়লে বিরক্ত হয় না আসিফ। এই সময়ে সে ফেসবুকে মন দেয়। তাই এই শহরের জ্যামের প্রতি কোনো অভিযোগ নেই আসিফের। তবে আজকের জ্যামটি বেশ লম্বা। প্রায় আধাঘণ্টা ধরে নিজের প্রাইভেটকারে বসে আছে, যদিও আজ অফিসের তাড়া নেই। কিন্তু ফেসবুকেও আজ মন বসছে না। মোবাইলটা পাশে রেখে দিয়ে ড্রাইভারকে বলল পুরনো দিনের গান ছেড়ে দিতে। একে একে মান্না দে'র গান বাজছে। কিন্তু গানেও মন বসছে না আসিফের। এলোমেলো চুলগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে বাইরের দিকে তাকাতেই চমকে ওঠে। এ কাকে দেখছে! স্বয়ং তামান্না। বেশভুষা দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সে এখন এই শহরে ভিক্ষা করে। অবয়বের রূপ-লাবণ্য নষ্ট হয়ে গেছে তামান্নার। চেহারা বেশ বিদঘুটে আকৃতির দেখাচ্ছে। তামান্নার দিকে তাকিয়ে স্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে থাকে আসিফ।
পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছিল আসিফ ও তামান্নার। বিয়ের এক বছর পর তামান্না মা হয়। কন্যা আদিলাকে পেয়ে আসিফের জীবন যেন সার্থক হয়ে ওঠে। আদিলার যখন তিন বছর, তখনই আসিফ টের পায় তামান্না পরকীয়ায় আসক্ত। গোপনে নিরীক্ষা করতে থাকে স্ত্রীকে। খুবই অল্প সময়ের নিরীক্ষায় আসিফ জানতে পারে তামান্না পলাশ নামের একজনের সঙ্গে নতুন সম্পর্কে জড়িয়েছে। এই অপকর্মের একটা সুরাহা করার আগেই একদিন তামান্না নিখোঁজ হয়ে যায়। পরে জানা যায় সে স্বামী আসিফ ও কন্যা আদিলার কথা না ভেবে পলাশ নামের সেই পরকীয়ায় প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে যায়।
মানসিক মনোবল ছিল বলে ভেঙে পড়েনি আসিফ। শুধু আদিলার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি মুছে ফেলত। নতুন করে জীবনের মোড় ঘুরাতে বাবা-মা আবার আসিফের জন্য পাত্রীর সন্ধানে নামেন। শিউলির সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়ে ঠিক হয় আসিফের। বিয়ের দিন তারিখও নির্ধারিত হয়। কিন্তু বিয়ের চারদিন আগে শিউলি আসিফকে জানায় বিয়ের পর আদিলাকে কোনো এক এতিমখানায় রেখে আসতে হবে।
হবু স্ত্রীর এমন প্রস্তাবে আন্দোলিত হয়ে ওঠে আসিফ। তার পৃথিবী একদিকে তো আদিলা আরেকদিকে। সেই আদিলাকে এতিমখানায় রেখে আসার জন্য শিউলির এমন কুপ্রস্তাবে প্রতিবাদ করে প্রত্যাখ্যান করে দেয় আসিফ। ভেঙে যায় আসিফের দ্বিতীয় বিয়ে। আসিফ বুঝে গেল মেয়ে আদিলার মা ভাগ্যে নেই। তাই সংসার করার আর কোনো ইচ্ছেই জাগেনি তার। বাকি জীবন মেয়েকে নিয়ে থাকবে এবং মেয়েকে সে রাজকন্যার মতো বড় করবে।
দিন দিন বড় হতে থাকে আদিলা। মেয়ের কোনো শখই অপূর্ণ রাখেনি আসিফ। ঘর ভর্তি খেলনা আর আলমারি ভর্তি জামায় পরিপূর্ণ। আদিলা যাতে কখনো মায়ের অভাব বুঝতে না পারে, সেজন্য আসিফ খুব সচেতন। কিন্তু আদিলা ঠিকই মাঝে মাঝে মায়ের প্রসঙ্গ টানে। মা দেখতে কেমন, মায়ের নাক কেমন, চোখ কেমন, চুল কেমন ছিল, মায়ের কোনো ছবি আছে কিনা, এসব ব্যাপারে ভীষণ কৌতূহলী সে। কিন্তু তামান্না চলে যাওয়ার পর আসিফ তামান্নার সব ছবি আগুনে পুড়ে ফেলেছে বলে মেয়েকে তার মায়ের ছবি দেখাতে পারছে না। তবে তামান্নার পরকীয়ায় অন্যের সঙ্গে চলে যাওয়ার কলঙ্কিত ঘটনাকে মেয়ের কাছে গোপন রেখে তাকে জানানো হয়েছে যে, তার মা সাগর দেখতে গিয়ে ভয়ংকর কুমিরের খাবার হয়ে গিয়েছিল। ছোট্ট আদিলা মায়ের এমন মর্মান্তিক মৃতু্যর খবর শুনে ফুঁপিয়ে কাঁদল এবং পণ করেছে সে জীবনে কোনোদিন সাগর দেখতে যাবে না।
বিস্মৃতির অতল গহিন থেকে ফিরে আসে আসিফ। বাইরে তামান্না তখনো ভিক্ষাবৃত্তিতে জনে জনে হাত পাচ্ছে। ড্রাইভারকে বসিয়ে প্রাইভেটকার থেকে নেমে তামান্নার দিকে এগিয়ে আসে আসিফ। অগত্যা আসিফের আগমন দেখে ভড়কে যায় তামান্না। হা করে তাকিয়ে থাকে। আসিফ তার দিকে এগিয়ে আসছে দেখে ভয় পেতে থাকে তামান্না। তারপর দৌড়াতে থাকে ডান পাশের গলির ভেতরের দিকে। পিছে পিছে দৌড়ায় আসিফও। তামান্না পিছু ফিরে তাকিয়ে দেখে আসিফ তার দিকে ধেয়ে আসছে। ফলে সে দৌড়ের গতি বাড়িয়ে দেয়। 'তামান্না শোনো, আমার কথা শোনো, একটু থামো'- আসিফের কথা শুনেও তামান্না থামে না। বরং দৌড়াতে দৌড়াতে বলে, 'না থামব না। আমাকে মারধর করবে, না?' আসিফ পেছন থেকে উচ্চস্বরে বলল, 'মারধর করব কেন? আমার একটা কথা শোনো। আদিলার ব্যাপারে একটা কথা শোনো।'
মেয়ের কথা শুনে আর সামনের দিকে পা বাড়াতে পারল না তামান্না। দাঁড়িয়ে যায় হুট করে। আসিফ তার পাশে এসে দাঁড়ায়। ঘামে জবুথবু হয়ে গেছে তামান্না। ব্যাকুল গলায় মেয়ের কথা জানতে চায় আসিফের কাছে। 'তোমার কোনো দোষ ছিল না। আমি পাষাণের মতো তোমাদের সঙ্গে প্রতারণা করে চলে গেলাম আরেক জনের সঙ্গে। কিন্তু সুখী হতে পারিনি। সে আমাকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। বাবা মাও আমাকে ক্ষমা করেনি। কত বার ভেবেছি তোমার কাছে ফিরে যাব, কিন্তু এ মুখ তোমাকে আর দেখানোর সাহস হয়নি। আমার মেয়ে কেমন আছে? কত বড় হয়েছে?'
তামান্নার আবেগপ্রবণ কথাগুলোকে গুরুত্ব না দিয়ে আসিফ বরং তার মোবাইল বের করে তামান্নার কয়েকটা ছবি তুলে ফেলল। 'আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ছবি তুললে কেন?' আসিফ বলল, 'আদিলাকে দেখানোর জন্য। মাঝে মাঝে সে তোমার ছবি দেখতে চায়। কিন্তু অনেক আগেই তোমার সবগুলো ছবি আমি পুড়ে ফেলেছি। ছোট্ট আদিলা জানে সাগর দেখতে গিয়ে তোমাকে কুমির খেয়ে ফেলেছে। কিন্তু বড় হয়ে সে যখন তোমার কুকীর্তির খবর জানবে আর তখন তোমাকে ঘৃণা করবে, তখন তোমার এই ছবি তাকে দেখাব। তোমাকে শুধু একবার দেখার শখ আমার মেয়েটার। তাই আজ এত বছর পর তোমাকে এখানে দেখে ছুটে এসেছি আমার মেয়ের জন্য তোমার ছবি তুলতে। জীবন দিয়ে হলেও আমি ওর সব পূরণ করার চেষ্টা করি।'
তামান্না চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। 'কি বলছ এসব! আমি আমার মেয়ের কাছে যাব।' তামান্নার এসব আহাজারি শুনে মন গললো না আসিফের। সে ফিরে আসছে গলির ভেতর থেকে। তামান্না গলা ফাটিয়ে পিছু পিছু আসছে আসিফের। কিন্তু সেদিকে আসিফের ভ্রূক্ষেপ নেই। সে প্রাইভেটকারের কাছে চলে এলো। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে ড্রাইভারকে আদেশ করল গাড়ি চালাতে। বাইরে থেকে তামান্না চেঁচিয়ে বলছে, 'ওগো, তোমার পায়ে পড়ি। আমি আদিলাকে একটিবার দেখব। আমাকে সেই সুযোগ দাও।' আসিফ যেন তামান্নার কথা শুনতেই পায়নি, এমন ভঙ্গিতে গাড়ির জানালার কাঁচ উঠিয়ে দিল।
হন হন করে প্রাইভেটকার ছুটে চলছে অফিসের দিকে। লুকিং গস্নাস দিয়ে আসিফ দেখল বাইরে ভিখারি বেশের তামান্না প্রাইভেটকারের পিছু পিছু ছুটে আসছে আর গলা ফাটিয়ে কাঁদছে। কিন্তু আসিফের হৃদয়ে তামান্নার জন্য একটুও করুণা জাগেনি। কেন জাগবে! এই তামান্না একদিন তাদের বাপ-বেটির কথা ভাবেনি। পর পুরুষের সঙ্গে চলে গেছে অসভ্যের মতো। তাকে কখনোই ক্ষমা করবে না আসিফ।