বুধবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১

ভাতের কাঙাল

নূরনাহার নিপা
  ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
.

ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন নিয়ে গ্রাম থেকে শহরে আসে ইমন। চোখে-মুখে সবসময় নতুন কিছু দেখার নতুন কিছু জানার কৌতূহলী আবেগ। সুমনকে প্রশ্ন করে, এটা কোথায়? সুমন- সদরঘাট। ঢাকা আর বেশিদূরে নয় চলে এসেছি প্রায়। ইমন চোখ দিয়ে চারপাশ শুধু দেখছে জ্যাম আর জ্যাম। শহরের বাস-ট্রাকগুলো খুব পাজি ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। ইমন গ্রামে থাকলেও পোশাকের দিক দিয়ে খুবই স্মার্ট, চোখ দুটো বড় দেখতে বেশ। কথাগুলো বেশ সুন্দর। মনটাও সহজ-সরল। গ্রামের কথা ভাবতেই তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। ছলছল জোড়া চোখ। বাবা-মা বড় ভাইয়া নেই, সবাই কষ্ট দিয়ে চলে গেল। বাবার সঙ্গে বন্ধুর মতো সম্পর্ক ছিল! হঠাৎ বাবা মারা যায়। ক্যানসারে মাকেও হারায়। ব্যাচেলর বাসায় আরও কয়েকজন থাকে। ইমনকে পেয়েই হইহই করে উঠল বন্ধুরা। হাত-মুখ ধুয়ে আসতে-না আসতেই খাওয়ার জন্য ডাক পড়ল। ইমন আমি শুধু পরোটা আর সবজি খাব। ভাত খাব না। সুমন জানতে চাইলেন, কেন খাবে না? ইমনের চোখে অনেক স্বপ্ন। ইমন ভর্তি হলো ইউনিভার্সিটিতে বাংলা বিভাগ থেকে অনার্স পাস করে। দেশের জন্য কিছু করতে পারলে তার কাছে ভালোই লাগত। কখন যে দুচোখের পাতা বুঁজে এসেছে টের পায়নি ইমন। আর দুচোখের পাতা বুঁজে আসতেই..এ কী! এ কী স্বপ্ন! কিন্তু এ স্বপ্ন ঘুমের মধ্যে কেন? ইমন এ স্বপ্ন জেগেই দেখতে চেয়েছিল। ধড়মড় করে উঠে পড়ল ইমন। রিয়া আমাকে ডাকছে। রিয়ার কোনো বিপদ। এসব ভাবছি কী? আসার সময় রিয়া খুব আবদার করছিল। ছোট বাচ্চার মতো কাঁদছিল। আমিও ভালোবাসি, তবে ওর মতো পারি না। রিয়া ছাড়া আমার আপন আছে বা কে? সামনেই রিয়ার পরীক্ষা। পরীক্ষার পড়া নিয়ে নিশ্চয় ব্যস্ত রিয়া। রিয়ার পরীক্ষা শেষ হলে তখন একবার গ্রামে যাব। আহা কতদিন মাঠে যাওয়া হয় না। কতদিন খোলা আকাশ দেখা হয় না। ভীষণ ইচ্ছে করছে পাখির মতো উড়তে। প্রিয় বাইক নিয়ে কত চড়ে বেড়াইছি গ্রামে। সে বাইক, পোষা কবুতর পাখি, বিড়াল, কুকুর, সবাইকে খুব মিস করছি। ওরা কেমন আছে? মায়া হলো ছায়ার মতো, কিছুতেই পিছু ছাড়ে না। সন্ধ্যা হতেই এক-এক করে সব বন্ধুরা আসতে থাকে। বন্ধুরা ভাবছে ইমনকে সারপ্রাইজ দেবে। ইমনের দুচোখ পরম বিস্ময়। শহরে এক বুক স্বপ্ন নিয়ে এসেছে। তাকে যে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। সে প্রতিষ্ঠিত হয়ে রিয়াকে বিয়ে করবে। সুমন-আমাদের ইমন দেশের জন্য অসাধারণ কাজ করছে বিভিন্ন সংগঠন নেতারা বলছে এমন ছেলেই তো আমাদের দরকার। শিফন তুমি যেখানে তাকে ধমক দেবে, বকবে উল্টো আশকারা দিচ্ছ। সুমন- এটা আশকারা নয়-প্রশংসা। দেশের জন্য ইমন আমরা সবাই কাজ করছি এর চেয়ে ভালো কাজ আর কী হতে পারে! ইমন একজন সাহসী যোদ্ধা। কয়েক মাস পর গ্রামের বাড়িতে গেল সে। বন্ধুদের কারও মুখে হাসি নেই। ইমন জানতে পারে রিয়ার বিয়ে হয়ে গেছে। ইমন হাউমাউ করে কাঁদে এক ঝাঁপি অভিযোগ কার বিরুদ্ধে ভালো-মন্দ জানার কারও কোনো গরজ নেই। কী করবে যেন ভেবেই উঠতে পারে না। সে শেষ পর্যন্ত রিয়াকেও হারাল। এই পৃথিবীতে তার আপন আর কেউ রইল না। বুকটা ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে পাথর ভাঙার শব্দ হলো যেন। কেউ নেই যে দু-চারটা কথা বলবে। রিয়াদের বাড়ির দিকে ছুটে গেল ইমন। রিয়ার বাবা গ্রামের চেয়ারম্যান। বল, কী বলতে চাও। এভাবে কথা কাটাকাটি হলে লোকজন ইমনকে মাথায় আঘাত করে। ইমন মাঝেমধ্যে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলে। রিয়াকে হারিয়ে তার মন ভালো নেই। আর থাকেই বা কী করে! ইমন কেমন যেন অন্য মানুষ...আহা জীবন। খাবারের ঠিক নেই। পরনের জামাগুলোয় ময়লা মাখামাখি। শাহিন-ইমন ঢাকা কবে এসেছিস। খালি পায়ে হাঁটবি কেন? ময়লা কাপড় পরনে লাগছে পাগলা মজনু। এতদিন ছিঁড়েপাটা স্যান্ডেল পরেছিস, এখন সুন্দর স্যান্ডেলগুলো পর। এ কী! তুই তো লুঙ্গিটাও ভালো করে পরিসনি। লুঙ্গির গিট্টু খুলে আবার লুঙ্গিটা পরিয়ে দিই। দুপুরের ভাতটা আমার সঙ্গে খেয়ে যাবি। ইমন- আমাকে সবাই পাগল ডাকে কেন? তুইও ডাকিস। বিশ্ববিদ্যালয়ে হইচই পড়ে গেল। ওকে ধর। ওকে ধর। বাইরে চলে যাবে। কিন্তু হঠাৎ কয়েকজন যুবক যেন পেছন থেকে ধরে ফেলল। অনেকক্ষণ পর। হাঁপিয়ে গেল। ইমন চিৎকার করে উঠল। বড় বড় চোখ, থমথমে মুখ, ওদের দেখলে ভয় লাগে। আদিল- এখানে চুরি করতে এসেছিস। ইমনের চোখে জল, না ভাই। আমি চোর না। বড্ড খিদে পেটে, আমার অনেক ক্ষুধা। একটু ভাত চাই। আদিল চোখ বড় করে তাকায়, মারব এক থাপ্পড়। রিয়াজ হেসে জিগায়, ভাত খাবি? সবাই তাকে হোটলে নিয়ে গেল। খুব আদর-যত্ন করে তাকে ভাত খাওয়াল! রিয়াজ-খাবার কেমন হলো। ইমন-ভাই এই হোটলের খাবার খুব ভালো। গেস্ট রুমে। ভাত খাওয়ার পর প্রচুর মারে। বুট জুতার আওয়াজ আরও কয়েকজন টহল দেয়। অনেকের হাতে লাঠি, বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে থাকে। ইমনের বড় বড় চোখ দুটো ভয়ে ক্লান্ত বুকের ভেতরটা ধড়মড় করে ওঠে। ইমন মা, বাবাকে চিৎকার করে ডাকে। কোনো সাড়া শব্দ নেই। কোথায় গেল সব? তবে কী এই নরকে ওকে রেখে সবাই চলে গেছে! অভিমান হলো ওর। অভিমানে চোখ দুটো ভিজে যেতে চাইছে। মা, বাবা তো দূর আকাশের তারা। ওই তো মা! হাত বাড়িয়ে ডাকছে। -মা আমি আসছি তোমার কাছে। ইমনের বুকে জমে থাকা সব অভিমান উবে গেল। ইমনের হাত বেঁধেছে সাইমন। তারপর মাথাটা চেপে ধরল দুহাত দিয়ে। আদিল চোখ বন্ধ করে মেরেছে তাকে, মার খেতে খেতে ইমন পড়ে গেছে। এরপর পানি এনে তাকে পানি খাওয়ানো হলে সে উঠে বসে। এসময় সবাই হাততালি দেয়। সবাই খুশি হয় কারণ তাকে আবার মারতে পারবে। এরপর আবার শুরু হয় পেটানো। এই দফায় সবচেয়ে বেশি মেরেছে আদিল। পরে সাইমন আসে। রবিন এসে আরও মারতে উৎসাহ দেয়; বলে। 'মার, ইচ্ছামতো মার; মাইরা ফেলিস না একবারে'। এসময় গ্যাস লাইট দিয়ে পায়ে আগুনও ধরিয়ে দেয়। পরে রবিন এসে ইমনের ভ্রু ও চুল কেটে দেয়। মারধরে ইমনের ডান পা এবং বাম পায়ের মাংস খুলে পড়ে গেছে তখন। অনেকে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। কাপড় এনে ওর পা বেঁধে দেয়। কারণ বিস্নডিং হইলে তো সেন্সলেস হয়ে যাবে। -গ্রাম থেকে আসা সহজ-সরল এক যুবক ইমন। সে মেধাবী ছাত্র। শহরে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল সে একজন সফল মানুষ হবে। তার স্বপ্ন সত্যি হলো না। ভালোবাসার কারণে স্বজনদের হারিয়ে হয়ে যায় ভারসাম্যহীন। পথের পথিক! ইমনের পরিবারের শেষ আশ্রয়স্থল ছিল তার একমাত্র ভাবী, যে কিনা ওর সঙ্গে কুকুর-বিড়ালের মতো আচরণ করত! তবুও মাইরের আগে তার ভাবীর কথা মনে হলো। আপন মনে করে নাম্বার দিল। ভেবেছিল ভাবীর মন তার জন্য একটু হলেও কাঁদবেই। ভাবী ফোন পেয়ে মোবাইল চোরের বিচার করতে বলে। এটাও বলেছিল যে, তাকে যেন আর ফোন দেওয়া না হয়। এ বলে রাতে ফোনটা বন্ধ করে দেয়। ইমন সুস্থ হোক সে সেটা কখনোই চায়নি। কারণ ইমন সুস্থ হলে সব সম্পত্তিতে ভাগ বসাবে! ইমনের বড়ভাই যখন পুলিশ হসপিটালে মৃতু্যশয্যায় তখন ভাইয়ের সেবা-যত্ন ইমন করত। ভাবী কখনো তাকে স্নেহ করত না। মানসিক টর্চার করত। ইমন কখনো যদি ক্ষুধার জ্বালায় ভাবীর কাছে একপেট ভাতের আশায় যেত, গ্রামের বাড়িগুলোয় যখন পাগলা কুকুর বাড়িতে ঢুকলে লাঠি দিয়ে তাড়া করত, ঠিক ওর ভাবীও সেইম কাজটা করত ওর সঙ্গে! ইমনের ভাই পুলিশের এসআই ছিল, সে জীবিত অবস্থায় মোটামুটি ভালো একটা সম্পত্তি রেখে গেছেন, তবুও তার ভাবী লোভ সামলাতে পারে না। ভাবী ইমন ভালো থাকুক সে সেটা কখনোই চায়নি। ইমন একপেট ভাত খেতে বসলে কত না কথা শোনাত ভাবী, এটা আমার স্বামীর উপার্জন, তুই উপার্জন করে খা। ইমনের একপেট ভাতের বড়ই অভাব ছিল!! পরে ইমনকে হলের মেইন বিল্ডিংয়ের গেস্টরুমে নিয়ে প্রচুর মারে। বুট জুতা পরে এসে ইমনের আঙুল মাড়িয়ে ছেঁচে ফেলে। সে বারবার হাতের আঙুল মাটিতে বিছিয়ে মাড়িয়েছে। তার গোপণাঙ্গে লাঠি দিয়া জোরে জোরে আঘাত করছে। শেষপর্যন্ত যখন ইমনকে হসপিটালের সামনে রেখে আসে। আজ সে পাগলটা ভাতের খোঁজেই মারা গেল! চারদিকে কেমন নীরব-নির্জন হয়ে আছে। গাছের ডালে বসে কা-কা করছে কয়েকটি কাক। ইমনরা ফিরে আসে বারবার।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে