শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪, ২৭ আশ্বিন ১৪৩১

স্মৃতিকথা

কাজী মোতাহার হোসেন এস ডি সুব্রত
  ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
স্মৃতিকথা

বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে কাজী মোতাহার হোসেন এক অনন্য প্রতিভাধর লেখক। তিনি ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, দাবাডু, সঙ্গীতজ্ঞ এবং বিজ্ঞানীও পরিসংখ্যানবিদ। কাজী মোতাহার হোসেন ১৮৯৭ সালের ৩০ জুলাই, তৎকালীন নদীয়া জেলার ভালুকা অর্থাৎ বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী থানার লক্ষ্ণীপুর গ্রামে, মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস রাজবাড়ী জেলার পাংশা থানার বাগমারা গ্রাম। পিতা কাজী গওহরউদ্দীন আহমদ ও মাতা তসিরুন্নেসার আট ছেলেমেয়ের মধ্যে সবার বড় ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। তার লেখা বইগুলোর মধ্যে 'সঞ্চায়ন', 'নজরুল কাব্য পরিচিতি', 'সেই পথ লক্ষ্য করে', 'সিম্পোজিয়াম', 'গণিত শাস্ত্রের ইতিহাস', 'আলোক বিজ্ঞান', 'নির্বাচিত প্রবন্ধ','পেস্নটোর সিম্পোজিয়াম' ও 'স্মৃতিকথা' অন্যতম। তার লেখা নিবন্ধগুলোর মধ্যে 'অসীমের সন্ধানে', 'কবি ও বৈজ্ঞানিক', 'আনন্দ ও মুসলমান গৃহ', 'সঙ্গীতচর্চা ও মুসলমান', 'নাস্তিকের ধর্ম', 'মানুষ মোহাম্মদ', 'ভুলের মূল্য', 'লেখক হওয়ার পথে', উলেস্নখযোগ্য। আজকের আলোচনা তার 'স্মৃতিকথা' বই নিয়ে।

জাতীয় অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের প্রবন্ধাকারে লেখা স্মৃতিচারণধর্মী বই 'স্মৃতিকথা'।

দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে নিজের বেড়ে ওঠা, কলকাতা ও ঢাকার ছাত্রজীবন, ঢাবির স্মৃতি এবং কাজী নজরুল আর ফজিলাতুন্নেছা সম্পর্কিত অধ্যায় বইটিকে সমৃদ্ধ করেছে। মুক্তবুদ্ধির আন্দোলনের আবুল হুসেন এবং ড. মুহাম্মদ শহীদুলস্নাহকে নিয়ে রচিত লেখা পাঠকের জন্য বাড়তি পাওনা। মোট আঠারোটি লেখা নিয়ে এই বই। নিজের জন্মকথা লিখতে অনেকেই অহেতুক আত্মগরিমায় ভোগেন। কাজী মোতাহার হোসেন তার লেখনীতে বিন্দুমাত্র ভণিতার আশ্রয় নেননি। এই সারল্য এবং সততার জন্য কাজী মোতাহার হোসেন অন্যদের থেকে আলাদা। কাজী মোতাহার হোসেনের সুগভীর পান্ডিত্য ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায় তার লেখায়। তিনি ছিলেন একদিকে সত্য ও সুন্দরের সাধক, অন্যদিকে সরল, নিরহংকার ও সজ্জন ব্যক্তি। 'স্মৃতিকথা' তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার এক সহজ-সরল বিবরণ।

এই প্রবন্ধ সংকলিত অধিকাংশই তার শেষ জীবনে লেখা। ছোটবেলা ও ছাত্রজীবন নিয়ে লেখা চারচটি প্রবন্ধে (আমার ছোটবেলা, কুষ্টিয়ার স্মৃতিকথা, আমার জীবন-দর্শনের অভু্যদয় ও ক্রমবিকাশ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ) লেখকের ব্যক্তিমানস ও চরিত্র কীভাবে গড়ে উঠেছিল তার অকপট পরচিয় পাওয়া যায়। দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে মেধা ও বৃত্তির ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে কেমন করে তিনি গড়ে উঠেছেন তারই কাহিনী। লেখাগুলোয় কাজী মোতাহার হোসেনের বহু সহপাঠী ও শিক্ষকের পরিচয় পাওয়া যায়। ব্যক্তিসত্তা ও মূল্যবোধ নির্মাণে তার স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের মূল্যবান অবদানের কথা তিনি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন। সাম্প্রদায়িকতাকে তিনি বাল্যকাল থেকেই ঘৃণা করতে শিখেছিলেন। মানবিক মূল্যবোধে যাদের হৃদয় আলোকিত নয় তাদের তিনি শ্রদ্ধার যোগ্য বলে মনে করেননি। কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে লেখা তিনটি প্রবন্ধ রয়েছে 'স্মৃতি কথায়'। কাজী মোতাহার হোসেন নিজেই বলেছেন 'নজরুলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার দিনগুলো আমার সাহিত্যিক জীবনে অমূল্য সঞ্চয়। এই গ্রন্থে তিনি বলেন, 'নজরুলের সংস্পর্শে এসে হয়তো মানুষকে আরও আপন বলে ভাবতে শিখেছি। এই দুর্লভ মানবীয় অনুভূতি যদি সত্যিই কিছুটা এসে থাকে, তবে তার ষোলোআনা না হলেও অন্তত বারোআনাই যে নজরুলের প্রভাবে হয়েছে একথা অকুণ্ঠভাবে স্বীকার করব।' (আমার সাহিত্যিক জীবনের অভিজ্ঞতা)। 'স্মৃতিকথায়' আরও কয়েকজন মনীষী সম্পর্কে কয়েকটি মূল্যবান লেখা সংকলন করা হয়েছে। এই প্রবন্ধগুলো রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ বোস, আবুল হুসেন, কাজী আবদুল ওদুদ ও ড. মুহম্মদ শহীদুলস্নাহ্‌কে নিয়ে। কৌতূহলী পাঠকরা নজরুল-ফজিলতুন্নেসা সম্পর্কের কিছু অজানা অথচ প্রামাণ্য তথ্য জানা যায় এই গ্রন্থের একটি রচনা থেকে। কুষ্টিয়ার গ্রামীণ পরিবেশে হিন্দু, মুসলিম সৌহার্দ্যের কথা রয়েছে বইটিতে। টাকা-পয়সার টান ছিল বলে কখনো আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে আবার কখনো লজিং থেকে চালাতে হয়েছে পড়াশোনা। খুব মেধাবী ছিলেন বলে পরীক্ষায় সবসময়ই ভালো করতেন। বৃত্তির টাকায় চলত পড়াশোনা। স্কুলে পড়নোর স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বারবার কৃতজ্ঞতা এবং শ্রদ্ধাবোধ প্রকাশ করেছেন। পনেরো টাকা বৃত্তির জোরে কাজী মোতাহার গেলেন কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে। বেকার হোস্টেলে থাকেন। সায়েন্স নিয়ে পড়ছেন। তৎকালীন কলকাতার বর্ণনা কেন জানি এড়িয়ে গেছেন।? তবে কলেজের পরিবেশ, পড়াশোনা নিয়ে বেশকিছু কথা আছে স্মৃতিকথা প্রবন্ধে। এই সময়ের একটি ঘটনা বেশ উলেস্নখযোগ্য। কলেজের এক ইংরেজ অধ্যাপক হিন্দুদের নিয়ে কটূক্তি করে। হিন্দু ছাত্ররা তাকে ধরে ধোলাই দেয়। কর্তৃপক্ষ কলেজের সব শিক্ষার্থীকে ঢালাওভাবে পনেরো টাকা জরিমানা করে। তবে কলেজের কোনো শিক্ষকের সুপারিশসহ আবেদনপত্র থাকলে জরিমানা মওকুফ করা হবে বলেও জানানো হয়। কাজী মোতাহারের সম্বলই পনেরো টাকা। জরিমানা দিলে মাসিক খরচের টাকা কোথায় পাবেন? তাই আবেদনপত্র নিয়ে গেলেন তার রসায়ন শিক্ষক প্রখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফুলস্নচন্দ্র রায়ের কাছে। তাকে দেখে পি.সি রায় বললেন, 'দেখ, তুমি মুসলমান, তুমি মৌলবী সাহেবের কাছ থেকে সুপারিশ নাও, অনেক হিন্দু ছেলেকে সার্টিফিকেট দিয়েছি; আমি আর দেব না।' 'এই কথা শুনে মর্মাহত হলেন কাজী মোতাহার। সিদ্ধান্ত নিলেন প্রেসিডেন্সিতে আর পড়বেন না। বদলি হয়ে চলে এলেন রাজশাহী কলেজে। তবে কাজী মোতাহার হোসেন সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। কারণ যেসব শিক্ষককে তিনি পুরো বইজুড়েই অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন, যেসব কৈশোরের সাথীদের কথা লিখেছেন তার স্মৃতিকথা বইতে তাদের বেশিরভাগ ছিল হিন্দু। ঢাবিতে পড়তে এসে প্রথমদিকের অনেক রথী, মহারথী শিক্ষকদের দেখা পেয়েছেন কাজী মোতাহার। অধ্যাপক জেনকিন্স, সত্যেন বসু, হরিদাস ভট্টাচার্য, রমেশচন্দ্র মজুমদারদের কথা এসেছে তার স্মৃতিতে। কাজীর সঙ্গে কাজী নজরুলের সাক্ষাৎ এবং বন্ধুত্বের পর্বটি অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ব্যক্তি নজরুল, সংগীতশিল্পী নজরুল, কবি নজরুল কিংবা প্রেমিক নজরুলকে খুব কাছ থেকে পেয়েছেন কাজী মোতাহার হোসেন। তাই 'আমার বন্ধু নজরুল', 'নজরুলকে যেমন দেখেছি', 'স্মৃতিপটে নজরুল' এবং ফজিলাতুন্নেছাকে নিয়ে ঘিরে লেখা স্মৃতিকথা শুধু কাজী মোতাহারেরই স্মৃতি অম্স্নান নয়; বাঙালি সাহিত্য সচেতন পাঠকের জন্যও এক অমূল্য সম্পদ স্মৃতিকথা প্রবন্ধের লেখাগুলো। ১৯২৮ সালের দিকে নজরুল দ্বিতীয়বার যখন ঢাকায় আসেন কাজী মোতাহারের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা তৈরি হয় নজরুলের। কাজী তখন ঢাবির ছাত্র। ফজিলাতুন্নেছা মোতাহারের সঙ্গেই পড়েন। তিনি মোতাহারের বন্ধুও। নজরুল হাত দেখতে পারতেন। এ কথা শুনে ফজিলাতুন্নেছা নজরুলকে অনুরোধ করেন তার ভাগ্য গণনার জন্য। কাজী মোতাহার হোসেনের ভাষ্যমতে, নজরুল রাতের আঁধারে ফজিলাতুন্নেছাকে প্রেম নিবেদন করতে যান তার বাসায়। কিন্তু চরমভাবে ব্যর্থ হন। এই ব্যর্থতা নজরুলকে যথেষ্ট পুড়িয়েছে, জ্বালিয়েছে।

কাজী মোতাহার হোসেনের এই স্মৃতিকথা তার ঘটনাবহুল জীবনের ক্ষুদ্র অংশমাত্র। তাই অনেক প্রাপ্তির পাশাপাশি পাঠকের অপ্রাপ্তিও রয়ে গেছে। তবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, স্মৃতিকথা বইটি বাংলা সাহিত্যের এক অন্যতম গ্রন্থ হিসেবে পাঠকদের মুগ্ধ করবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে