শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪, ২৭ আশ্বিন ১৪৩১

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভাষা বৈশিষ্ট্য

আহমদ মতিউর রহমান
  ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভাষা বৈশিষ্ট্য

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে একটি প্রধান ও বৈশিষ্ট্যমন্ডিত নাম। কি ভাষার বিকাশে, কি বাংলা গদ্য সৃজনে তার অবদান তুলনারহিত। তাকে বলা হয়ে থাকে বাংলা গদ্যের জনক। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসকাররা বলেন, 'বিদ্যাসাগর সর্বপ্রথম বাংলা সাধু গদ্যের একটি মান্য ধ্রম্নবক নির্দেশনা করেন। প্রয়োজনবোধে সেই গদ্যে চলিত ভাষার গতিশীলতাও যুক্ত করেন। কল্পনা ও স্বকীয় পান্ডিত্যের সংমিশ্রণে যে গদ্যভাষার জন্ম তিনি দেন, তা ছিল সরস, সুমধুর, সুশ্রাব্য, ছন্দোময় ও গতিশীল। এই অর্থে তিনি ছিলেন বাংলা গদ্যের নব জন্মদাতা। তিনি বাংলা আধুনিক গদ্যের জনক।' মান্য সাধু বাংলা গদ্যের শিল্পরূপটি ঠিক কী রকম হতে পারে, তার প্রথম আভাস পাওয়া গিয়েছিল, সংস্কৃত সাহিত্য থেকে অনূদিত বিদ্যাসাগরের বাংলা রচনাগুলোতে।

ঈশ্বরচন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধায় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন,'তাহার প্রধান কীর্তি বঙ্গভাষা। যদি এই ভাষা কখনো সাহিত্যসম্পদে ঐশ্বর্যশালিনী হইয়া উঠে, যদি এই ভাষা অক্ষর ভাবজননীরূপে মানবসভ্যতার ধাত্রীগণের ও মাতৃগণের মধ্যে গণ্য হয়, যদি এই ভাষা পৃথিবীর শোক-দুঃখের মধ্যে এক নতুন সান্ত্বনাস্থল, সংসারের তুচ্ছতা ও ক্ষুদ্র স্বার্থের মধ্যে এক মহত্ত্বের আদর্শলোক, দৈনন্দিন মানবজীবনের অবসাদ ও অস্বাস্থ্যের মধ্যে এক নিভৃত নিকুঞ্জবন রচনা করিতে পারে, তবেই তাহার এই কীর্তি তাহার উপযুক্ত গৌরব লাভ করিতে পারিবে। বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী। তৎপূর্বে বাংলায় গদ্যসাহিত্যের সূচনা হইয়াছিল, কিন্তু তিনিই সর্বপ্রথম বাংলা গদ্যে কলানৈপুণ্যের অবতারণা করেন।'

সাহিত্য সমালোচক ও গ্রন্থকার প্রমথনাথ বিশী বলেন, 'বাংলা গদ্য সংসারের নিত্য চলাচলের ওপর এসে পড়েছে। এতকাল যা মন্থরভাবে চলছিল, কয়েকজন বলবান মালস্নার গুণের টানে বা সরকারি সাহায্যের পালের বাতাসে এবারে তা হাজার বৈঠার ক্ষিপ্র তাড়নে চঞ্চল হয়ে উঠেছে। বৈঠাওয়ালাদের প্রধান ঈশ্বরগুপ্ত আর হালে অবশ্যই আছেন মনীষী রামমোহন।... বহুজন কর্তৃক বহুতর প্রয়োজনে ব্যবহৃত ভাষায় এসেছে নমনীয়তা; তাতে ঢুকেছে নতুন শব্দসম্ভার তাদের ইঙ্গিত ও স্মৃতির পরিমন্ডল দিয়ে। বেশ বুঝতে পারা যায় যে, অনেকগুলো কলমের প্রচেষ্টায়, তাদের মধ্যে আনাড়ির কলমের সংখ্যাও কম নয়, ভাষার কর্দম উত্তমরূপে মথিত হয়েছে, এবারে মূর্তি গড়ে তুললেই হয়, এলেই হয় শিল্পী। এলেন বাংলা গদ্যের প্রথম যথার্থ শিল্পী বিদ্যাসাগর।' প্রমথনাথ বিশীর মতো অনেকেই কথাটি শুধু মেনে নয়, মনেও নিয়েছেন। তিনিই প্রথম বাংলা লিপি সংস্কার করে তাকে যুক্তিবহ ও সহজপাঠ্য করে তোলেন।

উনিশ শতকের বাংলা গদ্যের সামাজিক ব্যাকরণে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকা প্রণিধানযোগ্য। মানসিক উদারতায়, সমাজ সংস্কারের তাৎপর্যে এবং পান্ডিত্যের গভীরতায় তার যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে তা এদেশের সমাজ-সংস্কৃতির ইতিহাসে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তার সফল কর্মবহুল জীবন যেমন ধর্ম ও সমাজ সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সাহিত্যের ক্ষেত্রেও ছিল বিশিষ্টতার অধিকারী। বিশেষ করে বাংলা গদ্যে ছন্দবোধ, প্রবাদ প্রবচনের সুষ্ঠু ব্যবহার এবং তিনিই প্রথম বিরাম চিহ্ন ব্যবহারের মাধ্যমে গদ্যে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনেন। নারীমুক্তির আন্দোলনেও তার অবদান উলেস্নখযোগ্য। বিদ্যাসাগর ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারকও। বিধবা বিবাহ ও স্ত্রী শিক্ষার প্রচলন, বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহের মতো সামাজিক অভিশাপ দূরীকরণে তার অক্লান্ত সংগ্রাম আজও স্মরিত হয় যথোচিত শ্রদ্ধার সঙ্গে।

২.

\হঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে সেপ্টেম্বর (১২২৭ সনের ১২ আশ্বিন) পশ্চিম মেদনীপুরের বীরসিংহ গ্রামে রক্ষণশীল এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। মাতা ভগবতী দেবী। 'তত্ত্ববোধিনী' পত্রিকার প্রথম সম্পাদক অক্ষয়কুমার অসুস্থ হলে বিদ্যাসাগর সম্পাদক হন এবং ১৮৪৭-১৮৬৫ পর্যন্ত এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। স্মৃতিশাস্ত্রে অভাবনীয় কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র 'বিদ্যাসাগর' উপাধি লাভ করেন। বিদ্যাসাগর ১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে ডিসেম্বর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রধান পন্ডিতের পদে নিযুক্ত হন। সেখানে পাঁচ বছর তিনি কর্মে নিযুক্ত ছিলেন। ১৮৫৬ সালে ২৬ জুলাই বিধবা বিবাহ আইন বিধিবদ্ধ করেন। ১৮৬৪ সালে ইংল্যান্ডের রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য পদে নির্বাচিত হন। ১৮৮০ সালে ভারত সরকার সি.আই.ই উপাধিতে ভূষিত করেন। সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে অগাধ পান্ডিত্যের জন্য সংস্কৃত কলেজ থেকে ১৮৩৯ সালে তিনি বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন।

৩.

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এক বিপুল সাহিত্যসম্ভার লিখে রেখে গেছেন। তিনি রচনা করেছেন যুগান্তকারী শিশুপাঠ্য বর্ণপরিচয়সহ একাধিক পাঠ্যপুস্তক, সংস্কৃত ব্যাকরণ গ্রন্থ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের রচনাবলি- ১. অনুবাদ : ক) 'বেতাল পঞ্চবিংশতি', খ) 'বাঙ্গালার ইতিহাস', গ) 'জীবন চরিত', ঘ) 'বোধোদয়', ঙ) 'শকুন্তলা' (কালিদাসের 'অভিজ্ঞান শকুন্তলম' নাটকের স্বচ্ছন্দ গদ্যানুবাদ), চ) 'কথামালা', ছ) 'সীতার বনবাস, জ) 'আখ্যান মঞ্জরি', ঝ) 'ভ্রান্তিবিলাস'। ২. মৌলিক রচনা : ক) 'সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য শাস্ত্রবিষয়ক প্রস্তাব', খ) 'বিদ্যাসাগর চরিত', গ) 'প্রভাবতী সম্ভাষণ'। ৩. লঘু রচনা : ক) 'অতি অল্প হইল', খ) 'আবার অতি অল্প হইল', গ) 'ব্রজবিলাস (১৮৮৪ খ্রি.), ঘ) 'রত্নপরীক্ষা' (১৮৮৬ খ্রি.)। ৪. সমাজ সংস্কারমূলক রচনা :ক) 'বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব' (১ম ও ২য় খন্ড), খ) 'বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার' (১ম খন্ড ১৮৭১ খ্রি., ২য় খন্ড-১৮৭৩ খ্রি.), ৫. শিক্ষামূলক রচনা : 'বর্ণপরিচয়' (১ম ও ২য় ভাগ ১৮৫৫) ও 'সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা' (১৮৫১)। দেখা যাচ্ছে সেই সময়ে তিনি অনেক শ্রমসাধ্য কাজ সম্পন্ন করে গেছেন।

বেতাল পঞ্চবিংশতি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত প্রথম গ্রন্থ ও উলেস্নখযোগ্য কীর্তি। এটি একটি গল্পগ্রন্থ। মূল গ্রন্থটি সংস্কৃত ভাষায় রচিত। ১৮০৫ সালে বৈতাল পচ্চিসী নামে এর একটি হিন্দি অনুবাদ ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ থেকে প্রকাশিত হয়, যা ওই কলেজের পাঠ্য ছিল। পরে কলেজের অধ্যক্ষ জি.টি মার্শালের অনুরোধে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৪৭ সালে এটি বাংলায় অনুবাদ করেন। অনুবাদের সময় তিনি মূল গল্পের অশ্লীল অংশ বর্জন এবং কোনো কোনো দীর্ঘ কাহিনী সংক্ষিপ্ত করেন। মৃত রাজা চন্দ্রভানুর প্রেতাত্মার নাম বেতাল। তৎকর্তৃক কথিত পঁচিশটি উপাখ্যানের সমাহার হচ্ছে বেতালপঞ্চবিংশতি। বেতাল ঘটনাচক্রে রাজা বিক্রমাদিত্যের স্কন্ধে ভর করে তাকে গল্পগুলো পরপর শোনায়। গল্পগুলোর অধিকাংশ প্রাচীন রাজকাহিনী; দু-তিনটিতে ব্রাহ্মণ চরিত্র আছে। বেতাল পঞ্চবিংশতি তার প্রথম গ্রন্থ হলেও এই গ্রন্থে শক্তিশালী গদ্যের লক্ষণ সুস্পষ্ট ছিল। বিদ্যাসাগর গ্রন্থের বিজ্ঞাপনে রচনার কারণ উলেস্নখ করে লেখেন,

'কালেজ অব ফোর্ট উইলিয়ম নামক বিদ্যালয়ে, তৎছাত্রগণের পাঠার্থে, বাঙ্গালা ভাষায় হিতোপদেশ নামে যে পুস্তক নির্দিষ্ট ছিল, তাহার রচনা অতি কদ্য। বিশেষত, কোনও কোনও অংশ এরূপ দুরূহ ও অসংলগ্ন যে কোনও ক্রমে অর্থবোধ ও তাৎপর্য হইয়া উঠে না। তৎপরিবর্তে পুস্তকান্তর প্রচলিত করা উচিত ও আবশ্যক বিবেচনা করিয়া, উক্ত বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মহামতি শ্রীযুত মেজর জি. টি. মার্শল মহোদয় কোনও নূতন পুস্তক প্রস্তুত করিতে আদেশ দেন। তদনুসারে আমি, বৈতালপচীসীনামক প্রসিদ্ধ হিন্দী পুস্তক অবলম্বন করিয়া এই গ্রন্থ লিখিয়াছিলাম।'

বেতাল পঞ্চবিংশতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ঞযব ঠবঃধষধ চধহপযধারসংযধঃর  ড়ৎ ইবঃধষ চধপযরংর ('ঞবিহঃু-ভরাব (ঃধষবং) ড়ভ ইবঃধষ'), রং ধ পড়ষষবপঃরড়হ ড়ভ :ধষবং ধহফ ষবমবহফং রিঃযরহ ধ ভৎধসব ংঃড়ৎু, ভৎড়স ওহফরধ. ওহঃবৎহধঃরড়হধষষু, রঃ রং ধষংড় শহড়হি ধং ঠরশৎধস-ঠবঃধষধ. ওঃ ধিং ড়ৎরমরহধষষু ৎিরঃঃবহ রহ ঝধহংশৎরঃ. ঙহব ড়ভ রঃং ড়ষফবংঃ ৎবপবহংরড়হং রং ভড়ঁহফ রহ :যব ১২:য নড়ড়শ ড়ভ :যব কধঃযধংধৎরঃংধমধৎধ ('ঙপবধহ ড়ভ :যব ঝঃৎবধসং ড়ভ ঝঃড়ৎু'), ধ ড়িৎশ রহ ঝধহংশৎরঃ পড়সঢ়রষবফ রহ :যব ১১:য পবহঃঁৎু নু ঝড়সধফবাধ, নঁঃ নধংবফ ড়হ ুবঃ ড়ষফবৎ সধঃবৎরধষং, হড়ি ষড়ংঃ. ঞযরং ৎবপবহংরড়হ পড়সঢ়ৎরংবং রহ ভধপঃ :বিহঃু-ভড়ঁৎ :ধষবং, :যব ভৎধসব হধৎৎধঃরাব রঃংবষভ নবরহম :যব :বিহঃু-ভরভঃয. ... ঞযব ঠবঃধষধ ংঃড়ৎরবং ধৎব ঢ়ড়ঢ়ঁষধৎ রহ ওহফরধ ধহফ যধাব নববহ :ৎধহংষধঃবফ রহঃড় সধহু ওহফরধহ াবৎহধপঁষধৎং. ঝবাবৎধষ ঊহমষরংয :ৎধহংষধঃরড়হং বীরংঃ, নধংবফ ড়হ ঝধহংশৎরঃ ৎবপবহংরড়হং ধহফ ড়হ ঐরহফর, ঞধসরষ, ইবহমধষর ধহফ গধৎধঃযর াবৎংরড়হং. চৎড়নধনষু :যব নবংঃ-শহড়হি ঊহমষরংয াবৎংরড়হ রং :যধঃ ড়ভ ঝরৎ জরপযধৎফ ঋৎধহপরং ইঁৎঃড়হ যিরপয রং, যড়বিাবৎ, হড়ঃ ধ :ৎধহংষধঃরড়হ নঁঃ ধ াবৎু ভৎবব ধফধঢ়ঃধঃরড়হ. (ডরশরঢ়বফরধ)

অর্থাৎ 'ভেতালা পঞ্চবিমশতি বা বেতাল পচিসি ('বেতালের পঁচিশটি (গল্প)'), ভারতের কাহিনি এবং কিংবদন্তির একটি সংগ্রহ। আন্তর্জাতিকভাবে এটি বিক্রম-ভেতালা নামেও পরিচিত। এটি মূলত সংস্কৃত ভাষায় লেখা। এর প্রাচীনতম রিসেনশন বা সংশোধিত পাঠের একটি পাওয়া যায় কথাসারিতসাগরের ১২তম বইতে। এটি সংস্কৃতে একটি রচনা, যা ১১ শতকে সোমদেব দ্বারা সংকলিত হয়েছিল। ...এই সংশোধিত পাঠ আসলে চব্বিশটি গল্প নিয়ে, ফ্রেমের আখ্যানটি নিজেই ২৫তম গল্প। ...ভেতালা গল্পগুলো ভারতে জনপ্রিয় এবং ভারতের অনেক স্থানীয় ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। সংস্কৃত পাঠ এবং হিন্দি, তামিল, বাংলা এবং মারাঠি সংস্করণের ওপর ভিত্তি করে বেশ কিছু ইংরেজি অনুবাদ বিদ্যমান। সম্ভবত সবচেয়ে সুপরিচিত ইংরেজি সংস্করণটি স্যার রিচার্ড ফ্রান্সিস বার্টনের, যা অনুবাদ নয় বরং ফ্রি এডাপটেশন বা মুক্ত অভিযোজন।'

বেতাল পঞ্চবিংশতি পঁচিশটি উপাখ্যান নিয়ে রচিত। উজ্জয়িনী নগরের রাজা বিক্রমাদিত্য সংসারবিবাগী হয়ে বনবাসে চলে গেলে দেবরাজ ইন্দ্রনগর রক্ষার্থে যক্ষকে নিয়োগ দেন নগর প্রহরার কাজে। অনেক বছর পর ফিরে এলে যক্ষ তাকে সাবধান করে দেন এক যোগী হতে। যে কিনা কৌশলে রাজা বিক্রমাদিত্যকে বলি দেবার ফন্দি আঁটছে। কালক্রমে একদিন দেখা হয় সেই যোগীর সঙ্গে। ইতিপূর্বে সেই যোগী হত্যা করে চন্দ্রসুর নামে এক রাজাকে। তারপর তার শবদেহ ঝুলিয়ে রাখে শ্মশানের এক গাছে। রাজা বিক্রমাদিত্যকে যোগী আদেশ করে সেই শবদেহকে তার কাছে সমর্পণ করতে। রাজা যোগীর কথামতো শ্মশানে গিয়ে সেই শবদেহ কাঁধে করে বয়ে নিয়ে আসে। সেই শবদেহই বেতাল। বেতাল রাজাকে ২৫টি উপাখ্যান শোনায়। প্রতিটি উপাখ্যান শেষে রাজাকে সে প্রশ্ন করে। সঠিক উত্তর দিলে বেতাল আবার পূর্বের জায়গায় ফিরে যায়। রাজা আবার তাকে নিয়ে আসে, আবার সে চলে যায়। শেষ উপাখ্যানের উত্তর দেবার পর বেতাল রাজাকে নিষ্ঠুর যোগীর হাত থেকে মুক্তি লাভের উপায় বলে দেয়। এই হচ্ছে এই বইয়ের উপজীব্য।

বাংলা সাহিত্যের গবেষক ডক্টর ওয়াকিল আহমদ বলেন, 'বাস্তব ও কল্পনা মিশ্রিত রোমান্টিক ধাঁচের এসব আখ্যানের মুখ্য আবেদন গল্পরস। তবে রাজবিধি, শাস্ত্রবিধি ও ন্যায়নীতির কথাও আছে। প্রতিটি গল্পের শেষে বেতাল ও বিক্রমাদিত্যের প্রশ্নোত্তরে এসব বিষয় আরও পরিস্ফুট হয়েছে। প্রাচীন ভারতের রাজ-পরিবারের ভোগ-বিলাস ও নৈতিকস্খলনের নানা চিত্র গল্পগুলোতে ফুটে উঠেছে। ... সেকালে গল্পের মাধ্যমে নীতিকথা প্রচার করার জন্য পঞ্চতন্ত্র, দ্বাত্রিংশৎপুত্তলিকা, কথাসরিৎসাগর, হিতোপদেশ প্রভৃতি সংস্কৃত, কালিলা ও দিমনা ফারসি এবং ঈশপস্‌ ফেবলস্‌ ইংরেজি ভাষা থেকে বাংলায় অনূদিত হয়েছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছাড়াও একজন অজ্ঞাতনামা লেখক ১৮৫২ সালে এবং জীবনানন্দ-বিদ্যাসাগর ১৮৭৩ সালে বেতালপঞ্চবিংশতি বাংলায় অনুবাদ করেন। তবে ঈশ্বরচন্দ্রের গ্রন্থখানি গদ্যরীতি ও রস-রুচির বিচারে উত্তম। দীর্ঘকাল এটি বিদ্যালয়ের পাঠ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিল।' (ওয়াকিল আহমদ, বাংলাপিডিয়া)

১৮৪৯ সালে মার্শম্যানের হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল অবলম্বনে রচনা করেন 'বাঙ্গালার ইতিহাস দ্বিতীয় ভাগ'। বন্ধু ও হিতৈষীদের সহযোগিতায় সমাজ সংস্কার আন্দোলনের লক্ষ্যে স্থাপন করেন সর্ব্বশুভকরী সভা। সে বছরই উইলিয়াম ও রবার্ট চেম্বার্স রচিত খ্যাতিমান ইংরেজ মনীষীদের জীবনী অবলম্বনে তার লেখা জীবনচরিত গ্রন্থখানি প্রকাশিত হয়।

৫.

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের গদ্যশৈলির বৈশিষ্ট্য নিয়ে অনেকে গবেষণা করেছেন। তাদের মতে, এই বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে ক) সাধু গদ্যভাষার মধ্যে ছন্দচেতনা এবং তার কুশলতায় গদ্যের মধ্যে প্রবহমানতা এনেছে। খ) বিদ্যাসাগর বিষয়ের প্রয়োজন অনুসারে ভাষাকে জটিল ও সরল করেছিলেন। গ) গদ্যকে উপবাক্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করে, বাক্যকে ভাবানুসারে ছন্দস্রোত এনে, বাক্যের গতির মধ্যে পূর্ণতা এনেছেন। ঘ) সংযুক্ত ক্রিয়াপদের ব্যবহার তার গদ্যে বিশেষভাবে চোখে পড়ে, যেমন, গমন করিলেন, শ্রবণ করিলেন ইত্যাদি। ঙ) বাংলা গদ্যকে সংহত করার জন্য সমাসবদ্ধ পদ ব্যবহার করলেও তিনি গদ্যকে প্রতিকূলতা থেকে মুক্ত করেছেন ও অনেক পরিমাণে সরল করে দিয়েছেন। কমা ও সেমিকোলনের ব্যবহার বিদ্যাসাগরই প্রথম যথার্থভাবে করতে পেরেছিলেন। আরও বলা হয়ে থাকে, তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের আগে বিষয়ের প্রয়োজন অনুসারে ভাষাকে সরল বা জটিল করেছেন। তবে বঙ্কিমচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভাষার অপরূপ মাধুর্যের প্রশংসা করেও বলেছেন যে তার সৃষ্টি অনুবাদমূলক, তিনি মৌলিক সাহিত্যস্রষ্টা নন।

\হএ বিষয়ে সমালোচকরা বলেন, অন্য ভাষার সাহিত্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে রচনা করলেও তার নিজস্ব শব্দচয়ন, ভাষাগত মাধুর্য, কাহিনির প্রেক্ষাপটে নতুনত্ব ও অভিনবত্ব সৃষ্টি ইত্যাদির জন্য বিদ্যাসাগরকে বঙ্কিমচন্দ্রের মতো করে শুধুই অনুবাদক বলতে দ্বিধা হয়। তাদের মতে, মূলত তিনি অনুবাদক নন, শিল্পী; আর তাই তার অনুবাদকর্মও এক একটি প্রাণময় শিল্পকর্ম হিসেবে ধরা দেয়।

বাংলা গদ্য ও কথা সাহিত্যের এই উৎকর্ষের যুগে ঈশ্বরচন্দ্রের কাজ তথা গদ্য ভাষা প্রাসঙ্গিক। আধুনিক গদ্য মানেই প্রবহমান, সেই প্রবহমানতার সূচনা করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। তার জন্মের দ্বিশত বছর পরও তিনি প্রাতস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। গত ২৬ সেপ্টেম্বর ছিল তার ২০৪তম জন্মবার্ষিকী। তিনি তার কাজের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকবেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে