বৃহস্পতিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১

শূন্যের পিছনে জীবন

ইমরান হোসেন
  ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
শূন্যের পিছনে জীবন

কাওরান বাজারের এক ছোট্ট অফিস রুম, সেখানে বসে আছে আনিস। পেশায় একজন সাংবাদিক। হঠাৎ দরজা ধাক্কা দিয়ে ঢুকল এক যুবক, চোখে-মুখে এক অদ্ভুত শূন্যতা। আনিস তাকাল তার দিকে।

'ভাই, আমি শেষ। আমাকে বাঁচান,' সেই যুবক বলতে লাগল, তার চোখে যেন হাজার বছরের ক্লান্তি।

'কে আপনি?' আনিস কিছুটা বিরক্ত হলো, এ ধরনের ঘটনা তার অফিসে নতুন কিছু নয়।

'আমি মাহিম, ফারিহাকে তো জানেন?' যুবকটির কণ্ঠে একরাশ হতাশা।

আনিস ভাবল, ফারিহা নামে একটি মেয়েকে সে জানে। ভার্সিটির তার সহপাঠী ছিল। দীর্ঘদিন ধরে যোগাযোগ নেই।

'একসময় চিনতাম। কেন, কী হয়েছে?' আনিসের কণ্ঠে কৌতূহল।

'ফারিহা বিয়ে করেছে।' মাহিমের গলা কাঁপছে। 'ও জিসানকে বিয়ে করেছে শনিবারে। ছেলের বাড়ি রংপুর।'

আনিস একটু অবাক হলো। জিসানকেও সে জানে, একই সেকশনে পড়ত। জিজ্ঞেস করল 'আপনি কি সেই লোক যার সঙ্গে ফারিহার বিয়ে ঠিক হয়েছিল?'

'বিয়ে ঠিক ছিল না,' মাহিম ধীরে ধীরে বলতে লাগল। 'ও আমার সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল।'

এবার আনিসের আগ্রহ বাড়ল। জীবন তাকে শিখিয়েছে কাহিনীগুলো সবসময় যেমন দেখায়, তেমন নয়। 'কীভাবে? সবটা খুলে বলুন।'

মাহিম কিছুক্ষণ নীরবে বসে রইল, তারপর গভীর শ্বাস নিল। 'ও যখন ইন্টারমিডিয়েটে পড়ত ময়মনসিংহে, হিমেল নামে একজনের সঙ্গে তার প্রেম ছিল। ওর বাসায় জানাজানি হওয়ার পর ওর বাবা-মা অন্য একটি ছেলের সঙ্গে ওর বিয়ে ঠিক করে। বাড়ি থেকে ঠিক করা ছেলেকে ফারিহা বিয়ে করবে না। হিমেলও বিয়ে করতে রাজি হয়নি। ও আমাকে চিনত, জানত আমি ওকে পছন্দ করি। ফেসবুকে মাঝেমধ্যে আমাদের কথা হতো। বাড়ি থেকে ঠিক করা ছেলেকে বিয়ে করবে না বলে একদিন হঠাৎ আমার হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়ে এল। আমার বাড়িতে ২০ দিনো মতো ছিল, তারপর ওর ফুফুর বাসায় চলে যায়।'

'আপনারা বিয়ে করেছিলেন?' আনিস জানতে চাইল।

'না, তবে আমরা একসঙ্গে থেকেছি,' মাহিম লজ্জায় মুখ নামিয়ে বলল। 'পাড়ার মানুষ জানত ও আমার মা-বোনের সঙ্গে থাকে, কিন্তু রাত হলে ও আমার সঙ্গে থাকত।'

আনিস হতবাক। এমন জটিল সম্পর্কের বাস্তবতায় সে কিছুটা দ্বিধায় পড়ে যায়। 'আপনি বিয়ে করেন নাই কেন?'

'আমি করতে চেয়েছিলাম,' মাহিম বলল। 'কিন্তু ওর মা-বাবা, ফুফু, সবাই বলল পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করতে। ওর জন্য আমি সবকিছু করতাম। ও যা চাইত, আমি তাই দিতাম। আমার বাপের জমি বিক্রি করে ওর পড়াশোনার খরচ চালিয়েছি।'

দুজনে এক মুহূর্ত চুপচাপ থাকার পর মাহিম আবার বলা শুরু করল 'ও আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। আমি আমার জীবনের সবকিছু ওর জন্য দিয়েছি। ফারিহা অন্তত তিনজন ছেলের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ধরাও পড়েছে, কিন্তু আমি সব মেনে নিয়েছি, ভেবেছিলাম সব ঠিক হয়ে যাবে।'

আনিস একজন কবি, তার কবিমন এখন জাগ্রত। সে মনোযোগ দিয়ে শুনছে, বোঝার চেষ্টা করছে মাহিমের মনের অবস্থা। মাহিমের জীবনে প্রেম, আত্মত্যাগ সব যেন একে একে ভেঙে চুরমার হয়েছে।

'আপনি ওর মিরপুরের বাসায় যান?' আনিস জানতে চায়।

'প্রায়ই যাই।'

আনিস আবার জিজ্ঞেস করল 'সহবাস করেন?'

এতক্ষণ মাহিম আনিসের মুখের দিকে ব্যাকুল হয়ে চেয়েছিল। এবার চোখ নামিয়ে বলল 'জি, ওরে আমার বাসায়ও নিয়ে আসতাম। ওর মিরপুরের মনির নামে এক ছেলের বাসায় প্রায়ই যায় শুনেছি। জানতাম, ওর সঙ্গে কিছু একটা চলছে,' মাহিম বিষণ্ন কণ্ঠে বলল। 'আমি জেনেও না জানার ভান করতাম, ভেবেছিলাম ওর বয়স কম, ঠিক হয়ে যাবে।'

আনিস এবার নিজের স্মৃতির দিকে একটু নজর দিল। ভার্সিটিতে ওদের সেকশন থেকেই অন্তত তিনজনের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছিল ফারিহা। তবে আনিস কিছুই প্রকাশ করল না।

'এখন আপনি কি চান? ফারিহার বিয়ে তো হয়ে গেল' আনিস সরাসরি জানতে চায়।

'আমি জানি না। আমি শুধু চাই, আমার এই ক্ষতি, আমার এই হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলোকে কিভাবে ফিরিয়ে আনব,' মাহিম হতাশ হয়ে বলল। 'ও আমাকে ব্যবহার করেছে, আমার মৃত বাপের সব সম্পত্তি শেষ করে দিয়েছে। ওর পড়াশোনার জন্য আমি সব বিক্রি করেছি।'

আনিস কিছুক্ষণ চুপচাপ রইল। সে ভাবছে, কীভাবে একজন মানুষ এমনভাবে ভেঙে পড়তে পারে। সম্পর্ক কখনো কখনো এতটা জটিল হয়ে যায় যে এর থেকে বের হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। আনিস ধীরে ধীরে বলল। 'আপনি কি আইনের আশ্রয় নিতে চান?'

'আইন! আইন কি করবে?' মাহিমের কণ্ঠ হাহাকার শোনাল। 'আইন কি আমার হারিয়ে যাওয়া সময়, আমার ভালোবাসা, আমার হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাস, স্বপ্ন ফিরিয়ে আনবে? আমি জোয়ান ছেলে, যে সম্পদ হারিয়েছি তা আবার উদ্ধার করতে পারব?' মাহিম অন্যমনস্ক হয়ে আবার বলল, 'হায় আমার স্বপ্ন, আমার স্বপ্ন।'

আনিস জানত, এমন কিছুই করা সম্ভব নয়। জীবন মাঝেমধ্যে এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়ায়, যেখানে কোনো সমাধান থাকে না। কেবল শূন্যতা আর অপরিপূর্ণতা।

মাহিম উঠে দাঁড়াল চাইল। 'ভাই, আমি জানি না কী করব। আমি লজ্জায় মনের কথা কাউকে বলতে পারতেছি না। ফারিহা বলেছিল আপনি এখানে কাজ করেন। ভেবেছিলাম আপনি কিছু হলেও জানেন। আমি কিছু চাই না, কিছুই না'

আনিস মাথা নেড়ে সায় দিল। 'আপনি একা নন। আমাদের জীবনে এমন সময় আসে যখন আমরা ভাবি, আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছি, অথচ তা হয় না। ভুল সময়ে ভুল জায়গায় ভুল সিদ্ধান্ত- এটাই হয়তো আমাদের জীবন।'

মাহিম ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল, যেন তার শরীর থেকে সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। আনিস জানে, এই মুহূর্তে তাকে কোনো সান্ত্বনার কথা বলে লাভ নেই। মানুষের জীবনের কিছু কষ্ট থাকে, যা কোনো সহজ সমাধানে মেটে না।

আনিসের চোখের সামনে দিয়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল মাহিম। দরজার কাছে এসে একবার পেছনে তাকাল, যেন কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু তার ঠোঁট আর নড়ল না। আনিসের মনে হলো, সে যেন পুরো পৃথিবীর ভার একা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।

আনিস জানালার দিকে তাকিয়ে রইল। বাইরে তখন বৃষ্টি নেমেছে, যেন এই পৃথিবীর সব দুঃখ মুছে ফেলার জন্য আকাশ কাঁদছে। বৃষ্টির ফোটা গড়িয়ে পড়ছে জানালার কাচ বেয়ে, ঠিক মানুষের চোখের জলের মতো।

মাহিমের এই গল্প হয়তো এখানেই শেষ হলো না। তার জীবন গেল শূন্যের পেছনে। এই শূন্যতা তার মনে থেকে যাবে চিরকাল। আর এই বৃষ্টি, এই আকাশের কান্না আমাদের সবাইকে মনে করিয়ে দেয় জীবনের কিছু দুঃখ আছে যা আমরা কখনোই কাটিয়ে উঠতে পারি না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে