ভাদ্র আর আশ্বিন দুই মাস শরৎকাল। বাংলাদেশের ঋতুচক্রের বিষয়গুলো অনেকেই জানে না। কারণ বাংলা জনপদের মানুষের মাঝে দিন দিন কৃষি আবাদ ও কৃষিকাজ কমে যাচ্ছে। কৃষি হয়ে উঠেছে বাণিজ্যভিত্তিক, যার ফলে প্রান্তিক কৃষকরা আর নিজ পেশায় থাকতে পারছেন না। ফলে কোন ঋতুতে প্রকৃতি কি রূপ ধারণ করে তা এখন আর অনুশীলন হয় না। প্রাচীনকালে উপমহাদেশের পঞ্জিকা পঞ্চঙ্গ বলে পরিচিত ছিল। কারণ পঞ্জিকাটির ছিল পাঁচটি অঙ্গ। এই পাঁচটি অঙ্গ হলো ১। কব ২। তিথি ৩। নক্ষত্র ৪। যোগ ৫। করন। এই পাঁচ অঙ্গের মাধ্যমে নির্ণয় করা হতো প্রকৃতির নানা বিষয়। যেমন চাষাবাদ, শিশু জন্মের জন্ম গ্রহণের পর তা বৈশিষ্ট্য সেই অনুসারে তার আগামী জীবনটা কেমন হবে, বাড়ি থেকে বের হয়ে মানুষ কোথাও যাবে, সেই যাত্রাকালটা কেমন হবে, যেমন কোন দিকে যাত্রাটা শুভ বা অশুভ এবং দিনটি কেমন যাবে এই পঞ্জিকা থেকে মানুষ বের করত। এটা যদিও কুসংস্কারের মধ্যে পরে তবে এই উপমহাদেশের বাংলা জনপদে বিষয়টি গুরুত্ব বহন করত। তাছাড়া বিবাহের দিনক্ষণ নির্ধারণ হতো পঞ্জিকা অনুসারে। এই পঞ্জিকার প্রচলন ছিল উপমহাদেশে খ্রিস্ট জন্মের ১৫০০ বছর আগে। তখন বছরকে ভাগ করা হয় বারো মাসে। মাসের নামগুলো ছিল এমন ১। তপঃ ২। তপস্যা ৩। মধু ৪। মাধব ৫। শুল্ক ৬। সুচি ৭। নভস ৮। নভস্য ৯। ঈব ১০। উর্জ ১১। সহস ১২। সহন্য। তবে পঞ্জিকার এই নামগুলোর পরিবর্তন করা হয়। ভারতীয় জ্যোতির বিজ্ঞানে আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর পূর্বে অনেক সমৃদ্ধ ছিল। উপমহাদেশের জ্যোতির বিজ্ঞানীরা রাতের বেলায় নক্ষত্রের অবস্থান দেখে আবহাওয়ার বার্তা প্রদান করতে পারত। তাছাড়া নক্ষত্রের অবস্থানের পরিবর্তনে প্রকৃতির পরিবর্তন হয় তাও ভারতীয় জ্যোতির বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে নির্ণয় করেন। যেমন বিশাখা নক্ষত্রের পূর্ণিমাস্ত যাওয়ার পর যে মাস শুরু হয় তার নাম রাখা হয়া বৈশাখ। তাই দেখা যায়, জ্যোতির মন্ডলের নক্ষত্রের নামানুসারে বাংলা মাসগুলোর নাম। বিশাখা নক্ষত্র থেকে বৈশাখ। এটি বাংলা বর্ষের প্রথম মাস। জ্যৈঠ মাসের নামকরণ করা হয়েছে জেষ্টা নক্ষত্র থেকে, বছরের দ্বিতীয় মাস হলো জ্যৈষ্ঠ। আষাঢ় মাসের নাম এসেছে অষধা নক্ষত্র থেকে। অষধা নক্ষত্রের প্রভাবে এবং তার ককশ পথের অবস্থানের কারণে প্রকৃতিতে প্রচুর বৃষ্টি হওয়ার যোগ থাকে। তাই দেখা যায়, আষাঢ় মাসে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। এই মাসের পর পূর্ণিমার চাঁদ শ্রাবণা নক্ষত্রের কক্ষ পথে অবস্থান করে। তাই আষাঢ়ের পরের মাসের নামকরণ করা হয় শ্রাবণ। এই নক্ষত্রের প্রভাবে বৃষ্টিপাত হয়। ভদ্রাপদ নক্ষত্র থেকে এসেছে ভাদ্র মাস। ভাদ্র মাসের পর চাঁদ কক্ষপথ পরিবর্তন করে অবস্থান করে অশ্বিনী, তাই ভাদ্রের পরের মাসের নামকরণ করা হয় আশ্বিন। কৃত্তিকা নক্ষত্রের নামানুসারে রাখা হয় কার্তিক মাসের নাম। কৃত্তিকা নক্ষত্রের পর চাঁদ মৃগশিরা নক্ষত্রের কক্ষপথে অবস্থান করে। মৃগশিরা নক্ষত্রের অপর নাম হলো অগ্রাহায়নী। এই অগ্রাহায়নী নক্ষত্রের নাম থেকে এসেছে অগ্রহায়ণ মাসের নাম। পুষ্যা নক্ষত্রানুসারে রাখা হয় পৌষ মাসের নাম। মঘা নক্ষত্রের নামানুসারে রাখা হয় মাঘ মাসের নাম। ফাল্গুনী নক্ষত্রের নামানুসারে রাখা হয় ফাল্গুন মাসের নাম, এই কক্ষপথে চাঁদের অবস্থানের কারণে প্রকৃতির পরির্বতন হয়। এভাবে কক্ষ আবর্তন করে একসময় চাঁদ এসে দাঁড়ায় চিত্রা নক্ষত্রে, এটা পৃথিবীর নিজ কক্ষপথ পরিবর্তনের শেষ। তাই এই সময়টাকে বছরের শেষ সময় ধরা হয়। সেই অনুসারে বছরের শেষ মাসের নাম রাখা হয় চৈত্র। ওই সময় বাংলা ১৬টি জনপদে গ্রহ, নক্ষত্র, তিথি ইত্যাদির অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে জ্যোতির্বিদগণ বাংলা বারো মাসের নামকরণ করেন। ভাদ্র ও অশ্বিন এই দুই মাস হলো শরৎকাল। এই সময় বাংলা জনপদের উপর দুইটি নক্ষত্র প্রভাব বিস্তার করে। এই দুইটি নক্ষত্র হলো ভদ্রাপদ নক্ষত্র ও অশ্বিনী নক্ষত্র। এই দুই নক্ষত্রের প্রভাবে প্রকৃতি কমে যায় বৃষ্টিপাত। তাই এই ঋতুর প্রথম ভাগের অংশে ভাদ্রপদ নক্ষত্রের প্রভাবে দেয় ভ্যাপসা গরম আর স্বল্প স্বল্প বৃষ্টিপাত হয়। আষাঢ় ও শ্রাবণের বারিধারায় ধৌত নীলাকাশে মাঝে সূর্যের তেজদিপ্ত তাপ, আর এই তাপের প্রভাবে গরম শুরু হয়। ভাদ্র মাসের জোছনা সবচেয়ে বেশি আলো ছড়ায়। কথায় আছে ভাদরের পূর্ণিমায় বিল-খালের তলা দেখা যায়। বৃষ্টি ও কালো মেঘের আস্তরণ না থাকায় আকাশ থাকে ঝকঝকে নীল। কৃষি হিসেবে এ সময় তেমন ফসল ফলানোর মৌসুম থাকে না। বাংলা জনপদের ভূমিগুলো সবুজ ধান গাছে ভরে থাকে। ঋতুর সঙ্গে বাংলা জনপদের সংস্কৃতির এক মেলবন্ধন রয়েছে। প্রতিটি ঋতুকে ঘিরে দেখা যায় একেক ধরনের সংস্কৃতির। এই অঞ্চলে বাস করা মানুষের জৈবিক চাহিদা গত বিষয়টি জড়িয়ে আছে ঋতুর সঙ্গে। বাংলা লোকগানে ভাদ্র ও আশ্বিন মাস দারুণভাবে প্রভাব ফেলেছে। এই অঞ্চলের একজন লোকগানে সঙ্গলিপ্সু প্রেমিক বলছে, 'ভাদর ও আশ্বিন মাসে ভ্রমর বসে কাচা বাঁশে/ আর কি থাকিবে বাপের ঘরে গো/ মন আমার কেমন কেমন করে/ ও বধূ হে/ আর না থাকিও বাপের ঘরেতে।' শরৎ ঋতু যখন আসে প্রতির পরিবর্তনটা হয় ধীরে ধীরে তাই চট করে বোঝা যায় না। বর্ষার শেষে ভ্যাপসা গরমে বৃষ্টির সঙ্গে শরতে। তাই শরত ঋতুকে বর্ষা থেকে আলাদা করাটা একটু সমস্যা হয়। তবে সবুজের সমারোহে বলে দেয় শরৎ এসেছে। শরতের অন্যতম ফল হচ্ছে তাল আর তাল পাকা গরমে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। শরতের গরম সম্পর্কে মধ্য যুগীয় কবি মুকুন্দ রাম চক্রবর্তী চন্ডি মঙ্গল কাব্যে বলেছে, 'অনলে পুড়ল অঙ্গ ভেতরে বাহিরে। শরৎকাল ষড় ঋতুর বাংলাদেশে একটি অভিজাত ঋতু। এই ঋতুতে সবুজের মহাসমারোহ ঘটে প্রকৃতিতে। সবুজ সবুজে ছেয়ে যায় বাংলার জনপদ। প্রকৃতির রৌদ্র রোষ এই ঋতুতে নেই বললেই চলে, অনেকটা শান্ত স্বভাবের ঋতু শরৎ। ভাদ্র আশ্বিন মাসে তেমন ঝড়ঝন্ডা ও মুসলধারে বৃষ্টিপাত তেমন একটা হয় না। শরৎ বাংলা মানুষকে নতুন নবান্নের বার্তা এনে দেয়। তার সবুজ শ্যামল যৌবনার পরশে কার্তিকের নবান্নের জন্ম হয়। শরৎ ঋতু দ্বিতীয় ভাগটি আশ্বিন মাস যেটি তা অনেকটা নাতিশীতোষ্ণ। তখন না গরম না শীত এই অবস্থায় থাকে প্রকৃতি। উদ্ভিদ প্রাণিকুলের প্রজননের সক্ষমতা বাড়ে এই সময়টায়। বর্তমানে বাংলাদেশের ঋতু জড়িত বৈশিষ্টের একটা পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে। তার মূল কারণ প্রকৃতির নানা ধরনের বিপর্যয় ঘটছে এই সময়টায়। তবে শত বিবর্তনের মাঝেও একটু হলে শরতের নাতিশীতোষ্ণতার টের পাওয়া যায় শরতের শেষ দিকটায়।
বাংলা সন সাধারণত গণনার মূল ভিত্তি ভারতীয় সৌর পঞ্জিকা। বাংলাদেশে যারা সনাতন ধর্ম পালন করেন, তাদের মূল উৎসব হলো দুর্গাপূজা। বাংলা হিন্দুধর্ম পালনকারীরা একে শরদীয় দুর্গোৎসব বলে থাকেন। এই উৎসবটির দিনক্ষণ নির্ধারিত হয় তিথি নক্ষত্র অবস্থান গণনা করে। তাই শরতের দুই নক্ষত্রের একটির বিবেচনা করে দুর্গা উৎসবের নির্ঘণ্ট নির্ধারণ করা হয়। তাছাড়া এই সময়ে নক্ষত্রের অবস্থান অনুসারে দুর্গাপূজার সময়, দিন ও তারিখ নির্ধারিত হয়।
ষড়ঋতুর বাংলাদেশে সবচেয়ে ভদ্র ঋতু হলো শরৎকাল। এই ঋতুতে প্রকৃতি যা দেখা যায়, তা অপূর্ব ও শালীনতাময় মনোমুগ্ধ কর। কবি গুরু রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর শরৎ নিয়ে লিখেছেন, 'হে মাত বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ/ ঝুলিছে অমল শোভাতে/ পারে না বহিতে নদী জলধার, মাঠে মাঠে ধান ধরে নাকো আর-/ ডাকিছে দোয়েল গাহিছে কোয়েল/ তোমার কানন সভাতে।/ মাঝ খানে তুমি দাঁড়ায়ে জননী/ শরৎকালের প্রভাতে।' শরতকাল শীতের আগমনী বার্তা বয়ে আনে। শিশিরের কনা ঝরে পড়ে মেঘবালা থেকে। সবুজ ঘাসের ডগায় শিশির বিন্দু সকালের বাঙা সূর্যের আলোয় অপূর্ব প্রকৃতির দৃশ্য পটের তৈরি করে। তাই রবিন্দ্রনাথ তার কবিতার শরৎ নিয়ে আরও লিখেছেন। 'তুলি মেঘবার আকাশ তোমার/ করেছ সুনীল বরনি, শিশির ছিটিরে করেছ শীতল। তোমর শ্যামল ধরনী।' শরৎকাল বাংলা ঋতুর খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঋতু। এই ঋতুর অবস্থান ছয় ঋতুর অনেকটা মাঝামাঝি একটা সময়ে। শরৎ বাংলা জনপদে বয়ে আনে মঙ্গল বার্তা। কারণ শরৎ শেষে হেমন্ত। আর হেমন্তে বাঙালির নবান্ন।