২০১৩ সালে কবিতায় বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত কবি হেলাল হাফিজের জন্ম ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোনার বড়তলী গ্রামে। কবি খোরশেদ আলী তালুকদার এবং কোকিলা খাতুন দম্পতির সন্তান হেলাল হাফিজ একাধারে কবি ও সাংবাদিক। ১৯৬৫ সালে তিনি নেত্রকোনা দত্ত হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৭ সালে নেত্রকোনা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ওই বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ১৯৭২ সালে তৎকালীন জাতীয় সংবাদপত্র দৈনিক পূর্বদেশে সাংবাদিকতায় যোগদান করেন এবং ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ছিলেন দৈনিক পূর্বদেশের সাহিত্য সম্পাদক। তিনি ১৯৭৬ সালের শেষ দিকে দৈনিক দেশ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক পদে যোগদান করেন এবং সর্বশেষ দৈনিক যুগান্তরে কর্মরত ছিলেন। তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলো হলো 'যে জলে আগুন জ্বলে, 'কবিতা একাত্তর' এবং 'বেদনাকে বলেছি কেঁদো না'। 'যে জলে আগুন জ্বলে' কাব্যগ্রন্থটির ৩৩টিরও বেশি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে যা বিশ্বসাহিত্যের এক বিরল কীর্তিও বটে।
মুক্তিযুদ্ধ, প্রেম, দ্রোহ, দেশপ্রেমসহ নানা অনুষঙ্গ তার কবিতায় পেয়েছে ভিন্ন এক মাত্রা। 'নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়', 'দুঃখের আরেক নাম', 'ফেরিওয়ালা', 'প্রস্থান', 'একটি পতাকা পেলে', 'যাতায়াত', 'ব্রহ্মপুত্রের মেয়ে', 'সুন্দরের গান', 'স্রোতস্বিনী ভালোবাসা'সহ আরও অনেক জনপ্রিয় বাংলা কবিতার জন্ম দিয়েছেন তিনি। তিনি বিভিন্ন উপমায় বাংলা কবিতাকে সমৃদ্ধ করেছেন। কবিতার নির্ভেজাল প্রেমিক হেলাল হাফিজের প্রিয় একটি শব্দ 'তুমুল'। দুঃখের আজন্ম সঙ্গী কবি হেলাল হাফিজের বিভিন্ন কবিতায় 'তুমুল' শব্দকে আমরা খোঁজে পাই নানাধরনের ব্যঞ্জনার ফুল হিসেবে।
\হ'যে জলে আগুন জ্বলে' কাব্যগ্রন্থের 'বেদনা বোনের মতো' কবিতায় 'তুমুল' শব্দটিকে পাই তুমুল বেদনায় উলস্নাস করছে।
\হ'কী দারুণ বেদনা আমাকে তড়িতাহতের মতো কাঁপালো তুমুল
ক্ষরণের লাল স্রোত আজন্ম পুরোটা ভেতর পাল্টে খেলো,' 'ইচ্ছে ছিল' কবিতার বদনে 'তুমুল' শব্দটি বাজিয়েছে তুমুল প্রেমের নিক্কন।
'ইচ্ছে ছিল সুনিপুণ মেকআপ-ম্যানের মতো
সূর্যালোকে কেবল সাজাব, তিমিরের সারাবেলা
পৌরুষের প্রেম দিয়ে তোমাকে বাজাব, আহা তুমুল বাজাব।'
'প্রতিমা' কবিতার প্রেমের প্রতিমাকে কবি আলাদা এক সৌন্দর্য দান করেছেন 'তুমুল' শব্দের অলংকারে।
'প্রেমের প্রতিমা তুমি, প্রণয়ের তীর্থ আমার।
বেদনার করুণ কৈশোর থেকে তোমাকে সাজাব বলে
ভেঙেছি নিজেকে কী যে তুমুল উলস্নাসে অবিরাম
তুমি তার কিছু কি দেখেছ?'
'দুঃখের আরেক নাম' কবিতাটিতে দুঃখকে পরতে পরতে সাজিয়ে 'তুমুল' শব্দের গাঁথুনিতে কবি তৈরি করেছেন দুঃখের রাজপ্রাসাদ।
'তুমুল ফাল্গুন যায়, ডাকে না কোকিল কোনো ডালে,
আকস্মিক দু'একটা কুহুকুহু আর্তনাদ
পৃথিবীকে উপহাস করে।
একদিন কোকিলেরও সুসময় ছিল, আজ তারা
আমার মতোই বেশ দুঃসময়ে আছে
পাখিদের নীলাকাশ বিষাক্ত হয়ে গেছে সভ্যতার অশ্লীল বাতাসে।'
'প্রত্যাবর্তন' কবিতায় মুক্তিসংগ্রামের পরবর্তী সময়ের অসাধারণ বর্ণনায় 'তুমুল' শব্দটি দান করেছে আলাদা এক শৈল্পিক সৌন্দর্য।
'প্রত্যাবর্তনের পথে
পিতার প্রস্থান থাকে,
থাকে প্রণয়ের প্রাথমিক স্কুল,
মাতার মলিন স্মৃতি ফোটায় ধ্রম্নপদী হুল,
যুদ্ধোত্তর মানুষের মূল্যবোধ পাল্টায় তুমুল,
নেতা ভুল,
বাগানে নষ্ট ফুল,
অকথিত কথার বকুল
বছর পাঁচেক বেশ এ্যানাটমিক ক্লাস করে বুকে।'
প্রেম ও দ্রোহের কবি হেলাল হাফিজের 'তীর্থ' কবিতাটি পাঠ করতে গিয়ে পাঠক খোঁজে পায় 'তুমুল' শব্দের নান্দনিক ব্যবহার।
'কেন ওভাবে নাড়ো?
যেটুকু নাড়ালে নড়ে না তুমুলভাবে ভেতরে বাহিরে
কেন তাকে সেটুকু নাড়ালে?'
'ইদানীং জীবনযাপন' কবিতার পঙ্ক্তিতে কষ্টের ভাঁজে 'তুমুল' শব্দের বাহারী রূপ পাঠককে দেয় কবিতার সুমিষ্টি নির্যাস।
'আজকাল আমার কষ্টেরা বেশ ভালোই থাকেন,
অঙ্কুরোদগম প্রিয় এলোমেলো যুবকের
অতৃপ্ত মানুষের শুশ্রূষা করেন। বিরোধী দলের ভুল
মিছিলের শোভা দেখে হাসেন তুমুল,
ক্লান্তিতে গভীর রাতে ঘরহীন ঘরেও ফেরেন,
নির্জন নগরে তারা কতিপয় নাগরিক যেন
কতো কথোপকথনে কাটান বাকিটা রাত,
অবশেষে কিশোরীর বুকের মতন সাদা ভোরবেলা
অধিক ক্লান্তিতে সব ঘুমিয়ে পড়েন।'
দুঃখকে ভালোবেসে যার সুখের বসতি সেই কবি হেলাল হাফিজের বিখ্যাত কবিতা 'ফেরিওয়াল'র কষ্টের সীমাহীন সমুদ্রেও 'তুমুল' শব্দটি তুলেছে আলাদা এক কষ্টের ঢেউ।
'প্রেমের কষ্ট ঘৃণার কষ্ট নদী এবং নারীর কষ্ট
অনাদর ও অবহেলার তুমুল কষ্ট
ভুল রমণী ভালোবাসার
ভুল নেতাদের জনসভার
হাইড্রোজেনে দু'টি জোকার নষ্ট হবার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে নষ্ট।'
'তোমাকেই চাই' কবিতার হৃদপিন্ডে 'তুমুল' শব্দটি ঢুকে গেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় অক্সিজেনের মতো।
'আমি এখন ভিন্ন মানুষ অন্যভাবে কথা বলি
কথার ভেতর অনেক কথা লুকিয়ে ফেলি,
কথার সাথে আমার এখন তুমুল খেলা
উপযুক্ত সংযোজনে জীর্ণ-শীর্ণ শব্দমালা
ব্যঞ্জনা পায় আমার হাতে অবলীলায়,
ঠিক জানি না পারস্পরিক খেলাধূলায়
কখন কে যে কাকে খেলায়।'
'ব্যবধান' কবিতায় 'তুমুল'কে আমরা খোঁজে পাই মানুষের অধঃপতনের তালে উলস্নাসরত এক ব্যঞ্জনাময় শব্দ হিসেবে।
'আজকাল অধঃপতনের দিকে সুপারসনিক গতি মানুষের
সঙ্গত সীমানা ছেড়ে অদ্ভুত নগরে যেন হিজরতের প্রতিযোগিতা।
তবু তুমি কাছে যেতে চাও? কার কাছে যাবে?
পশু-পাখিদের কিছু নিচে তুমুল উলস্নাসে যেন
বসবাস করে আজ কুলীন মানুষ।'
কবির 'কে' কবিতার পেটে 'তুমুল' শব্দকে পাওয়া যায় কারুকার্যময় উপস্থাপনশৈলীতে অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যোপাদান হিসেবেই।
'এমন অনমনীয় পৃথক ভ্রমণে সেই পরিব্রাজকের
অনেক অবর্ণনীয় অভিমান থাকে,
টসটসে রসাল ফলের মতো ক্ষত আর
ব্যক্তিগত ক্ষয়-ক্ষতি থাকে। তাকে তুমুল শাসায়
মূলচু্যত মানুষের ভুল ভালোবাসা, রাজনীতি,
পক্ষপাতদুষ্ট এক স্টাফ রিপোর্টার। আর তার সহগামী
সব পাখিদের ঈর্ষার আকাশে ভাসে ব্যর্থতার কিচির-মিচির।'
\হ'বেদনাকে বলেছি কেঁদো না' কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা 'ব্রহ্মপুত্রের মেয়ে'র দ্বিতীয় স্তবকে কবির আশৈশব বেদনার সঙ্গী হিসেবে আমরা 'তুমুল' শব্দটিকে পাই।
'বেদনা আমাকে নিয়ে আশৈশব খেলেছে তুমুল আর
তিলে তিলে শিখিয়েছে সহনশীলতা,
নিলাজ নখের মতো দুঃখ কেটে কেটে আমি
আজকাল অর্জন করেছি মৌন উদ্ভিদের মুখর স্তব্ধতা,
রলো উল্কাসিনী,
না জেনেশুনেই কেন দিতে গেলে টোকা!
তুমি আর কি বেদনা দেবে, কতোটা কাঁদাবে?
বালখিল্য এ খেলায় আমার চেয়েও বেশি তুমিই হারাবে।'
চার পঙ্ক্তিতে সাজানো 'বুকের দোকান' কবিতায় তুমুল বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে কবির প্রিয় এই 'তুমুল' শব্দটি।
'মাঝে মাঝে নিঃসঙ্গ দুপুর কাটে
অভিজাত বিপণী বিতানে,
তৃষিত নয়ন ভরে তুমুল বিস্ময়ে দেখি
কতো বুক বুকে নিয়ে বস্নাউজগুলো ঝুলছে দোকানে!'
বর্তমান বাংলাসাহিত্যের তুমুল জনপ্রিয় কবি হেলাল হাফিজ আরও অনেক বছর তুমুল ঝড় তুলুক বাংলা কবিতার ভুবনে - কবির ৭৬তম জন্মবার্ষিকীতে এই প্রত্যাশা রইল।