শুক্রবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১

সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক

১৯৫১ সালে মাত্র ষোল বছর বয়সে 'অগত্যা' নামের ম্যাগাজিনে তার লেখা গল্প প্রথমবার প্রকাশিত হয়। ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম গল্পের বই 'তাস'। যদিও গদ্যকার হিসেবেই সাহিত্যে তিনি আত্মপ্রকাশ করেছিলেন, পরবর্তী সময়ে সাহিত্যের অন্যতম প্রধান শাখা কবিতায়ও তিনি সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি একাধারে ছিলেন কবি, গীতিকার, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও শিশুসাহিত্যিক
এস ডি সুব্রত
  ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক

সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক তার লেখায় বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের আবেগ অনুভূতি আর গ্রামীন পটভূমি অত্যন্ত সহজ ও সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি তার মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক ও গানসহ বিভিন্ন মাধ্যমে। সৈয়দ শামসুল হকের জন্ম ১৯৩৫ সালের ২৭শে ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে। আট ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিলেন। সব্যসাচী কথাটার অর্থ হচ্ছে যার দুই হাতই সমানভাবে কাজ করে। আর সব্যসাচী লেখক মানে যিনি সাহিত্যের সব শাখায় সফলভাবে বিচরণ করেন। এমন প্রতিভা খুব কমই পাওয়া যায়। সৈয়দ শামসুল হক সেই ভাগ্যবান লেখকদের মাঝে অন্যতম। মাত্র এগারো বছর বয়সেই তিনি ছড়া লেখার চেষ্টা করেছিলেন। গদ্যকার হিসেবেই তিনি বাংলাসাহিত্যে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৫১ সালে মাত্র ষোল বছর বয়সে 'অগত্যা' নামের ম্যাগাজিনে তার লেখা গল্প প্রথমবার প্রকাশিত হয়। ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম গল্পের বই 'তাস'। যদিও গদ্যকার হিসেবেই সাহিত্যে তিনি আত্মপ্রকাশ করেছিলেন, পরবর্তীতে সাহিত্যের অন্যতম প্রধান শাখা কবিতায়ও তিনি সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি একাধারে ছিলেন কবি, গীতিকার, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও শিশুসাহিত্যিক।

সৈয়দ শামসুল হকের কবিতার বৈশিষ্ট্যে আমরা কখনো পেয়েছি অন্তর্মুখীস্বভাব আবার কখনো পেয়েছি বহির্মুখীস্বভাব। তিনি সব রকম ছন্দেই কাব্যচর্চা করেছেন। কবিতায় তিনি বারবার নিজেকে ভেঙে নতুন করে গড়তে চেয়েছেন। এজন্যই হয়তো তার প্রথম জীবনের কবিতায় আমরা তাকে তেমন আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে পারি না। এক সময় তিনি সেই সময়কার। কবিদের রচনাশৈলীকেই অনুসরণ করেছিলেন। পরে তিনি বারবার নিজের রচনাশৈলীর পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। কবিতায় তিনি কখনো গদ্যরীতি ব্যবহার করেছেন, আবার কখনো পয়ার, কখনো অক্ষরবৃত্তে অন্ত্যমিলের চর্চা করেছেন। তার প্রথম কবিতার বই 'একদা এক রাজ্যে' প্রকাশিত হয় ১৯৬১ সালে। তবে এতে তিনি নিজেকে তেমন উজ্জ্বলভাবে প্রকাশ করতে পারেননি। দীর্ঘ কবিতা, কাব্যনাট্যে এবং আঞ্চলিক ভাষার সফল প্রয়োগের ক্ষেত্রে সৈয়দ শামসুল হক নিজের প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তার প্রথম দীর্ঘ কবিতার বই 'বৈশাখে রচিত পঙ্‌ক্তিমালা'। এই রচনাটিতে আমরা তার অন্তর্মুখীস্বভাবকে বারবার পাই। এখানে কয়েকটা পঙ্‌ক্তি থেকে পাঠ করলে আমরা অন্তর্মুখীস্বভাব বা আত্মকেন্দ্রিকতার ব্যাপারটা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাব।

'এমন বিশ্বাস ছিল শুধু কবিতায়,/প্রথমে করব জয় সুরূপা, বিরূপা;/তারপর পরিবার, যারা রোজ বলে,/ 'কবিতার সরোবরে ফোটে অনাহার,/ছেঁড়া চটি, সস্তা মদ, আসক্তি বেশ্যায়';/ তারপর বাংলাদেশ এশিয়া আফ্রিকা।' এক স্বপ্নগ্রস্তের মতো তিনি নিজের স্বপ্নের কথা বলে গেছেন কবিতার মাধ্যমে। সৈয়দ শামসুল হক স্কুলজীবন শেষ করেন কুড়িগ্রামে। এরপর ১৯৫১ সালে মুম্বাইতে গিয়ে কিছুদিন একটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থায় কাজ করেন। পরবর্তীতে জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। সেখানে পড়ালেখা শেষ না করেই পুরোদমে লেখালেখি শুরু করেন। প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস 'দেয়ালের দেশ'।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, 'সৈয়দ শামসুল হকের রচনায় সমসাময়িক বাংলাদেশকে তুলে ধরা হয়েছে। আগের বড় লেখকেরা সকলেই গ্রামকেন্দ্রিক উপন্যাস বা গল্প লিখেছেন। সৈয়দ শামসুল হক নতুন উদীয়মান মধ্যবিত্তের কথা ভালো করে বললেন এবং মধ্যবিত্ত জীবনের বিকারকেও তিনি ধরলেন।'

তার আরেক বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ 'পরানের গহীন ভিতর' দিয়ে তিনি তার কবিতায় আঞ্চলিক ভাষাকে উপস্থাপন করেছেন।

কবি অধ্যাপক মোহাম্মদ সামাদ বলেন, সৈয়দ হক তার কবিতা দিয়ে বারবার সাড়া ফেলেছেন।

'কবিতায় তার ধারাবাহিকভাবে যে অবদান তা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। তার 'খেলারাম খেলে যা' অনুকরণ করে আমাদের কথাসাহিত্যিকেরা লিখেছেন। বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ হকের অবদানকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।' সৈয়দ শামসুল হক তার কর্মজীবনের প্রায় সাত বছর কাটিয়েছেন লন্ডনে বিবিসি বাংলা বিভাগের সঙ্গে। বিবিসি বাংলা থেকে সংবাদ পরিবেশন করেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে।

তিনি বলেন, বিবিসি বাংলায় তার সহকর্মী তালেয়া রেহমান 'উনি নাটক এবং অভিনয়ে আগ্রহী ছিলেন, নির্দেশনাও দিয়েছেন। বিশেষ করে ক্লাসিকাল নাটকের অনুবাদে তার আগ্রহ ছিল। এছাড়া বিবিসির যেসব কাজ সেটা তিনি করে গেছেন সেগুলো নিশ্চয়ই তার ভালো লাগেনি।'

নাট্যকার হিসেবেও সৈয়দ শামসুল হক ছিলেন সফল। তার রচিত দু'টি কাব্যনাট্য 'নূরলদিনের সারাজীবন' এবং 'পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়' বাংলা নাটকে একটি বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছে।

আসাদুজ্জামান নূর বলেন, 'তার যে শব্দের ব্যবহার, রূপকল্প, কাব্যময়তা এবং নাটকের যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত সমস্ত কিছু তিনি যেভাবে ধারণ করেছেন বাংলা নাটকে এই ঘটনা আর কেউ ঘটাতে পেরেছে বলে আমি মনে করি না।'

তিনি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেছেন, এমনকি চলচ্চিত্রের জন্য গানও রচনা করেছেন। পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। তার রচিত 'হায়রে মানুষ, রঙ্গিন ফানুস' গানটি এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে। তিনি একইসঙ্গে একজন সৃষ্টিশীল লেখক এবং ভাষার ব্যবহারে ছিলেন অত্যন্ত সচেতন।' অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলছেন, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সৈয়দ শামসুল হক তার অবদানের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মতে 'সৈয়দ শামসুল হকের রচনায় সমসাময়িক বাংলাদেশকে তুলে ধরা হয়েছে।'

জনপ্রিয় লেখক আনিসুল হক বলেন, 'তিনি যদি অন্য সব বাদ দিয়ে দুটো বই লিখতেন 'পরানের গহীন ভিতর' এবং 'বৈশাখে রচিত পঙ্‌ক্তিমাল্ত তাহলে এ দুটো বই তাকে অমর করে রাখত। তিনি যদি শুধু তার কাব্যনাট্যগুলো লিখতেন 'নূরলদিনের সারাজীবন' এবং 'পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়' তাহলেও আমরা চিরদিনের জন্য তাকে বাংলা সাহিত্যে স্মরণ করতে বাধ্য থাকতাম। তার কবিতা-নাটক-কলাম সবটা মিলিয়ে যে ব্যক্তিত্বটি দাঁড়ায় তা তুলনারহিত।'

'পরানের গহীন ভিতর' সৈয়দ শামসুল হকের জনপ্রিয় বইগুলোর একটি। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮০ সালে। এই বইটি ৩৩টি সনেটগুচ্ছ নিয়ে সাজানো। মানভাষা এবং আঞ্চলিক ভাষার সংমিশ্রণে লেখা কবিতাগুলো ভাষা-শৈলীতে অনন্য। যদিও কবিতার বিষয়বস্তু গ্রাম্য-সংসারী জীবনের প্রেম, হিংসা, মান-অভিমান এবং বাস্তবতার বিষয়ে- বলা যায় প্রায় এক রকম আত্মমগ্নতারই কথা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে