বিদ্রোহী কবিতার অন্তর্নিবিষ্ট দুই শক্তি

প্রকাশ | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

সুমন সরদার
'বিদ্রোহী' কবিতা কাজী নজরুল ইসলামের শ্রেষ্ঠ কবিতা- একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। কেননা, এই কবিতায় তিনি বহুমাত্রিক কবিত্বশক্তির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। মানুষের অন্তর্নিবিষ্ট বিভিন্ন মাত্রার আত্মশক্তি, ছন্দের শক্তি, নন্দনতাত্ত্বিক শক্তি, মিথের শক্তি, ভাষার শক্তি- সবমিলিয়ে এক অভূতপূর্ব সৃষ্টি- যা শতবর্ষ পরেও বাঙালির মন ও চিত্তকে উদ্বেলিত করে, প্রতিবাদী করে, হৃদয়কে উজ্জীবিত করে, অনুপ্রাণিত করে, সাহস জোগায়। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে বাংলা আধুনিক কাব্যের মুক্তি ঘটলেও তার পরবর্তী সময়ের তিন কবি- যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, মোহিতলাল মজুমদার ও কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা কবিতাকে স্বাতন্ত্র্যে চিহ্নিত করেছেন। নজরুলের স্বাতন্ত্র্যের মূল বিষয় সমাজের অসংলগ্নতার বিরুদ্ধে মানুষের আকাঙ্ক্ষার পক্ষে তীব্র অবস্থান। এর চূড়ান্ত প্রতিচ্ছবি 'বিদ্রোহী' কবিতা। স্বতঃস্ফূর্ততা ও ছন্দ- এ দু'টি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই এই কবিতার মূলপ্রাণ। 'বিদ্রোহী' কবিতায় অদম্য স্বতঃস্ফূর্ত শক্তি অদম্য স্বতঃস্ফূর্ততা নজরুলের সব সৃষ্টির মূল শক্তি। তিনি যে কোনো বিষয়ে তাৎক্ষণিক লিখে দিতে পারতেন। মনোজগতের স্বতঃস্ফূর্ততা না থাকলে এমনটি হওয়ার কথা নয়। বিভিন্ন সাময়িক পত্র বা পত্রিকার সম্পাদকরা তার কাছে লেখা চেয়ে পেতেন না। এ মনোবেদনা থাকলেও তারা লেখা আদায়ের কৌশল জানতেন। কাগজ-কলম, চা-পান দিয়ে কোনো ঘরে আটকে রেখে লেখা আদায় করতেন। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে একটি লেখা প্রস্তুত করে তিনি বদ্ধঘর থেকে মুক্তিও পেতেন। এ এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল কাজী নজরুলের। রবীন্দ্র পরবর্তী সময়ে নজরুল ছিলেন সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য রচনায় বিশ্বাসী। রোমান্টিক রচনার বিপক্ষে একটি কঠিন স্রোত, মূলত বিশের দশকেই শুরু হয়েছিল। আর সেই স্রোত সৃষ্টিতে কাজী নজরুল ইসলাম উদ্দাম গতি নিয়ে আসেন। নজরুল তার 'আমার কৈফিয়ত' কবিতায় ঘোষণা করেন- 'বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই 'নবী' কবি ও অকবি যাহা বলো মোরে মুখ বুজে সই সবি! কেহ বলে, 'তুমি ভবিষ্যতে যে ঠাঁই পাবে কবি ভবীর সাথে হে! যেমন বেরোয় রবির হাতে সে চিরকেলে- বাণী কই কবি? দুষিছে সবাই, আমি তবু গাই শুধু প্রভাতের ভৈরবী!' কী এক মহৎ উদ্দেশে কবি বেপরোয়া, তাই কাব্যানুগত্য মেনে চলা যেন তার কাছে ছিল অসম্ভব বিষয়। তাই ভিন্ন বচনভঙ্গি তিনি তার কবিতায় গ্রহণ করেন। দীপ্তি ত্রিপাঠীর মতে, নজরুলের অসম্ভব লোকপ্রিয়তার মূল কারণ হিসেবে পশ্চাতে ছিল ভারতবর্ষের অসহযোগ আন্দোলনের জোয়ার। অসহযোগ আন্দোলন ভাটা পড়লে তার কাব্যেরও ভাটার ছোঁয়া লাগে। নজরুল স্বভাবকবি হওয়ায় তার কাব্য রচনার ক্ষেত্রে যে সচেতনতা ও কঠোর সাধনার প্রয়োজন ছিল নজরুলের সেটা ছিল না। এজন্য তার কাব্যের স্বতঃস্ফূর্ততা যেমন একদিন গুণ হিসেবে ধরা দিয়েছিল তেমনি ধীরে ধীরে তা দোষ হয়ে দাঁড়ালো। দীপ্তি ত্রিপাঠীর এরকম অভিমতের অনুকূলে নজরুলের সমসাময়িক কবি মোহিতলাল মজুমদারকে বাংলা সাহিত্যের চারিত্র্য, মননশীলতা ও বিশেষ জীবনদর্শন ফুটিয়ে তোলার কৃতিত্ব দিয়েছেন। অপরদিকে ড. বাসন্তীকুমার মুখোপাধ্যায় তার 'আধুনিক বাংলা কবিতার রূপরেখা'র আধুনিক কবিতার প্রস্তুতিপর্ব অংশে লিখেছেন- 'মোহিতলাল বাংলা ভাষায় যে একজন বিশিষ্ট কবি, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। জীবন সম্বন্ধে তার বিশিষ্ট মনোভঙ্গি তরুণদের আকৃষ্ট করেছিল। সত্যেন্দ্রনাথ-নজরুলের মতো আরবি ফারসি শব্দের কৃতিত্বপূর্ণ ব্যবহার অনেকক্ষেত্রে তার কাব্যে নতুনত্বের স্বাদ এনেছে। তার কাব্যে সংস্কৃত শব্দের মন্দ্রমুখরতা, ছন্দে ঢেউয়ের মতো দীর্ঘবিলম্বিত লয় আমাদের মুগ্ধ করে। বিষয়বস্তুর ঐশ্বর্য ও বিরাটত্ব তার কবিতাকে গভীর করেছে। তবু মোহিতলাল অনাদৃত। কাব্যগত ত্রম্নটি ছাড়া এ অনাদরের পেছনে আর যে কারণ আছে তার জন্য মোহিতলাল হয়ত নিজেও কিছুটা দায়ী। মোহিতলাল কারণে অকারণে অনেক সময় রবীন্দ্রনাথকে আঘাত করেছেন- মাইকেল ও বঙ্কিম চন্দ্রকে বড়ো করে তুলে রবীন্দ্রনাথকে লোকচক্ষে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছেন। কাজেই রবীন্দ্রভক্ত পাঠকরা যে তার প্রতি বিরূপ হবেন, এ তো জানা কথা। নজরুল-বিরোধিতাও মোহিতলালের জনপ্রিয়তার পথে বাধার সৃষ্টি করেছিল। তাছাড়া 'ভারতী'তে 'শ্রীসত্যসুন্দর দাস' ছদ্মনামে সমালোচনায় উনিশ শতকের সত্য-শিবসুন্দরের আদর্শ গ্রহণ করে রক্ষণশীলতার পরিচয় দিলেন- তার কাব্যাদর্শ ও সমালোচনার আদর্শের মধ্যে বৈপরীত্ব দেখা দিল। শেষ পর্যন্ত আধুনিক কবিদের ওপর মোহিতলালের নিদারুণ বিদ্বেষ নিজেকে অনাধুনিক বলে চিহ্নিত করতে সাহায্য করল।' দীপ্তি ত্রিপাঠীর বক্তব্যকে পক্ষান্তরে ড. বাসন্তীকুমার মুখোপাধ্যায় পুরোপুরি সমর্থন করেন না। তার মতে, শিক্ষিত পাঠক রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের নাম জানেন। বাংলায় সাধারণত রবীন্দ্রনাথের পরই নজরুলের নাম উচ্চারিত হয়। নজরুলের কবিতার স্থায়িত্ব না থাকলে শতবর্ষ পরেও কি তার সৃষ্টি উজ্জ্বল হয়ে থাকতো? 'বিদ্রোহী' কবিতাটি ভারতবর্ষের শতবর্ষ আগের প্রেক্ষাপট আর কাব্যভাষার এক শক্তদ্রোহ। কিন্তু আধিপত্যবাদী মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে 'বিদ্রোহী' কবিতা কখনই সেকেলে হওয়ার নয়। একথা উচ্চৈঃস্বরে বলাটা ভুল হবে না। বুদ্ধদেব বসু 'নজরুল ইসলাম' শীর্ষক এক প্রবন্ধে লিখেছেন, 'তিনি যখন সাহিত্যক্ষেত্রে এলেন তখন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত খ্যাতির চূড়ায় অধিষ্ঠিত, মোহিতলাল তখনো ঠিক সমাগত হননি, রবীন্দ্রনাথের পরে সত্যেন্দ্রনাথই প্রধান কবি। নজরুলের রচনায় সত্যেন্দ্রীয় আমেজ ছিল না তা নয়- কেনই বা থাকবে না- কিন্তু প্রথম থেকেই তিনি সুস্পষ্ট এবং প্রবলভাবে তার স্বকীয়তা ঘোষণা করেছিলেন। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই বাংলাদেশ তাকে গ্রহণ করল, স্বীকার করল- তার বই রাজরোষ এবং প্রজানুরাগ লাভ করে এডিশনের পর এডিশন কাটতে লাগল- অতি অল্প সময়ের মধ্যে অসামান্য লোকপ্রিয়তা অর্জন করলেন তিনি। এটা কবির পক্ষে বিরল ভাগ্যের কথা; কিন্তু যে লেখা বেরোবার সঙ্গে সঙ্গেই লোকপ্রিয় হয় তাকে আমরা ঈষৎ সন্দেহের চোখে দেখি, কারণ ইতিহাসে দেখা যায় সেসব লেখা প্রায়ই টেকসই হয় না। নজরুল সম্বন্ধে বিশেষভাবে বলবার কথা এইটেই যে তিনি একইসঙ্গে লোকপ্রিয় কবি এবং ভালো কবি- তার পরে একমাত্র সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মধ্যেই পলকের জন্য এই সমন্বয়ের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল।' বুদ্ধদেব বসুর যে গ্রন্থে নজরুলকে নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন তা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৬ সালের এপ্রিলে। অর্থাৎ ৫৮ বছরের বেশি সময় আগে নজরুলকে নিয়ে লিখিত প্রবন্ধের বিষয়বস্তু আজও অমলিন। তার প্রবন্ধের সঙ্গে সুরমিলিয়ে বলা যায় 'বিদ্রোহী' কবিতাও তাই শতবর্ষ পরেও লোকপ্রিয়তার শীর্ষে। একথা বলাও সমীচীন হবে যে- এই কবিতায় বিদ্রোহ, আমি অর্থাৎ আত্মশক্তি, প্রেমশক্তি যুগপৎ হাতধরাধরি করে এগিয়ে চলেছে। এর সঙ্গে ছন্দের গতিময়তায় মিশে আছে মিথ, নিগূঢ় কৌশল-দোলা, রূপক-উপমা-উৎপ্রেক্ষার মতো অনুষঙ্গ। কাজী নজরুল ইসলামের 'বিদ্রোহী' কবিতা এমন এক শক্ত স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদী রূপ, যে রূপ তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন ততদিন, যতদিন তিনি লিখতে পেরেছেন। শতবর্ষ পরও তা সেকেলে হওয়ার নয়। তার এমন ক্ষুরধার কাব্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন শুরুর দিকে যেমন, তেমনই চলিস্নশ বছর বয়সেও। তার তারুণ্য, তার দৃঢ়তা, ক্ষণিকের চিন্তা বায়রণের মতোই উচ্ছ্বলতা ও স্বতঃস্ফূর্ততায় পূর্ণ। এটি তার শক্তি। আর এই শক্তির আইকনিক দৃপ্ত প্রকাশ 'বিদ্রোহী' কবিতা। মোজফ্‌ফর আহমদের 'কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা'য় জানা যায়, 'বিদ্রোহী' কবিতাটি তিনি ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে লিখেছেন। নজরুলের জন্ম ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মে (১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬ বঙ্গাব্দ), সে হিসেবে তখন তার বয়স ছিল ২২ বছর ৭ মাস। এ ভূখন্ডে ডিসেম্বর-জানুয়ারি শীতকাল। হিমশীতল রাতের সৃষ্টি 'বিদ্রোহী' কবিতায় তেজদীপ্ত কাব্যভাষার অনর্গলতার উপস্থিতি কী ভিন্নরূপ ভাবতে বাধ্য করে! করে বটে! এর মূল কারণ হিসেবে ভারতীয় ও বিশ্ব রাজনীতির উত্তাল দিনগুলোর কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) বাঙালিপল্টন ফেরত চুরুলিয়ার সন্তান হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলামের মনোজগত যুগপৎ দ্বিমুখী প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়। তখন ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষের তরুণদের মধ্যে সাম্যবাদী চিন্তার ব্যাপক প্রসার ঘটে। বিশেষ করে ১৯১৭ সালে ভস্নাদিমির ইলিচ লেনিনের নেতৃত্বে রুশ বিপস্নব সফল হওয়ার পর ভারতবর্ষেও বিপস্নব সংঘটিত করার মনোবাঞ্ছা ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে, খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হতে থাকে এক রাজনৈতিক শক্তি। এই শক্তি হিন্দু-মুসলমানকে একসুতোয় গেঁথে অসামান্য সম্প্রীতি গড়ে তোলে। তরুণ সাবেক সৈনিক কাজী নজরুল ইসলামের চেতনা জগতে এই দুইয়ের অভূতপূর্ব সম্মিলন ঘটে এবং তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশিত হয় তার নিজস্ব ও আকর্ষণীয় বাক-ভঙ্গিমায় রচিত কাব্য ও অন্যান্য লেখা-বক্তৃতায়। সাম্যবাদী দর্শনের বিপস্নবী চেতনা ও ধর্মীয় সম্প্রীতিকে বিশ্বাস করে তিনি অদম্য স্বতঃস্ফূর্ততায় কাব্যশক্তির চূড়ান্তে অবস্থান করেছেন। 'বিদ্রোহী' কবিতার সমকালীন স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদী স্বর আর সমকালীন থাকেনি। যুগ যুগ ধরে ক্রমশ তা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, মানুষ আরও বেশি করে গ্রহণ করছে। রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি এখানে প্রণিধানযোগ্য- 'সৌন্দর্য আমাদের উপকার করে বলিয়া সুন্দর নহে, সুন্দর বলিয়াই উপকার করে।' এ হিসেবে মানুষের ভেতরের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদী স্বরূপকেই প্রতিনিধিত্ব করে 'বিদ্রোহী' কবিতা। এ যেন স্বতঃস্ফূর্ততায় জাগ্রত মানুষের ভেতরের প্রতিবাদী সত্ত্বার অনুসরণীয় প্রতিনিধি। বিদ্রোহী কবিতায় ছন্দের শক্তি 'বিদ্রোহী' কবিতার ছন্দ নিয়ে নির্ভরযোগ্য গবেষণার সংখ্যা খুব একটা নেই বললেই চলে। এর অভাবে এই কবিতার ছন্দের আলোচনায় মাঝেমধ্যেই দেখা যায় ভুল তত্ত্ব উপস্থাপন করা হচ্ছে। বিশেষ করে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকে 'বিদ্রোহী' কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত থাকায় এর সঠিক আলোচনার দাবি রাখে। 'বিদ্রোহী' কবিতার ছন্দ ভুল ধরিয়ে দিয়ে কিছু শিক্ষালয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্তিতে ফেলছে। 'বিদ্রোহী' কবিতাটি অসমপার্বিক বা মুক্তক মাত্রাবৃত্তের ছয় মাত্রার চালে রচিত। যার পূর্ণপর্ব ছয়মাত্রা। মাত্রাবৃত্তে প্রতি পঙ্‌ক্তির পর্বসংখ্যা ও মাত্রাসংখ্যা সমান হয়, কিন্তু মুক্তক মাত্রাবৃত্তে প্রতি পঙ্‌ক্তির পর্বসংখ্যা ও মাত্রাসংখ্যা সমান হয় না। মাত্রাবৃত্ত মধ্যলয়ে পঠিত হয় গীতল ভঙ্গিতে। গীতল ভঙ্গির মাত্রাবৃত্ত ছন্দ ব্যবহার করে কাজী নজরুল ইসলাম সৌন্দর্যসাগরে বীররস যুক্ত করে ভিন্নমাত্রা দিয়েছেন। শব্দ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে দ্রোহ ফুটিয়ে তুলেছেন কবিতায়। যা গীতল ভঙ্গিমা সামান্য পরিবর্তিত হয়ে নির্দিষ্ট লয়ে তেজি ঘোড়ার মতো পাঠককে ছুটিয়ে নেয়। আবৃত্তি শিল্পের কথা মাথায় না এনেও বলা যায় যে কোনো পাঠক যখন কবিতাটি পড়েন তার মধ্যে তেজদীপ্ত পাঠশৈলীতে অবগাহন করা অবধারিত হয়ে পড়ে। এ কথা বলা হলো এ জন্য যে, পাঠশৈলীর কারণে কবিতার বেশ কিছু জায়গায় পঙ্‌ক্তির অংশবিশেষ উচ্চারণে যতি চিহ্ন ছন্দের মাত্রাকেও কিছুটা গলিয়ে নিতে পারে। এ যেন ছন্দেরই অংশ। এ ছাড়াও ছয় মাত্রার মুক্তক মাত্রাবৃত্তের এই কবিতার অপূর্ণ পর্বের বৈচিত্র্য, অতিপর্বের আধিক্য কিংবা অতিপর্ব পাঠসূত্রে পূর্ব চরণে সংযুক্ত করার মধ্য দিয়ে ছন্দের শক্তি প্রকাশ পেয়েছে। এক্ষেত্রে 'বিদ্রোহী' কবিতার তৃতীয় স্তবকের প্রথম ক'টি চরণের উলেস্নখ করা যায়- আমি/ চির-দুরন্ত/ দুর্মদ, আমি/ দুর্দম, মম/ প্রাণের পেয়ালা/ হর্দম হ্যায়/ হর্দম ভর/পুর মদ আমি/ হোম-শিখা, আমি/ সাগ্নিক জম/দগ্নি, আমি/ যজ্ঞ, আমি/ পুরোহিত, আমি/ অগ্নি। আমি/ সৃষ্টি, আমি/ ধ্বংস, আমি/ লোকালয়, আমি/ শ্মশান, আমি/ অবসান, নিশা/বসান! আমি/ ইন্দ্রাণী-সুত/ হাতে চাঁদ ভালে/ সূর্য, মম/ এক হাতে বাঁকা/ বাঁশের বাঁশরি,/ আর হাতে রণ-/তূর্য! এই স্তবকাংশের প্রথম ও দ্বিতীয় চরণের অন্ত্যমিলে চারমাত্রার অপূর্ণ পর্ব আবার তৃতীয়-চতুর্থ, পঞ্চম-ষষ্ঠ ও সপ্তম-অষ্টম চরণের অন্ত্যমিলে তিন মাত্রার অপূর্ণ পর্ব। ছয় মাত্রার মাত্রাবৃত্তে ছয়ের কম অর্থাৎ সর্বোচ্চ পাঁচ মাত্রা পর্যন্ত অপূর্ণ পর্ব রাখা যায় যা 'বিদ্রোহী' কবিতায় বিদ্যমান, অনুরূপ অতিপর্বের ক্ষেত্রেও। এই কবিতাংশে প্রতি চরণের শুরুতে 'আমি' ও 'মম' উভয়েই দুই মাত্রার অতিপর্ব বিদ্যমান। এরপর অবশিষ্ট থাকে মধ্যবর্তী ছয় মাত্রার পূর্ণ পর্ব, পর্বসমূহ। কিন্তু এর চতুর্থ ও পঞ্চম চরণ- 'আমি/যজ্ঞ, আমি/ পুরোহিত, আমি/ অগ্নি। আমি/ সৃষ্টি, আমি/ ধ্বংস, আমি/ লোকালয়, আমি/ শ্মশান,'। এর প্রথম চরণে 'যজ্ঞ, আমি' ও দ্বিতীয় চরণে 'সৃষ্টি, আমি' ও 'ধ্বংস, আমি' পূর্ণ ছয় মাত্রা পায় কি? সাদা চোখে তো পায় না। তবে? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার 'কাব্য ও ছন্দ' প্রবন্ধে লিখেছেন- '... ... ... সন্ন্যাস ধর্মের মুখ্য তত্ত্বটা তার গেরুয়া কাপড়ে নয়, সেটা আছে তার সাধনার সত্যতায়। এই কথাটা যে বোঝে, গেরুয়া কাপড়ের অভাবেই তাই মন আরো বেশি করে আকৃষ্ট হয়। সে বলে, আমার বোধশক্তির দ্বারাই সত্যকে চিনব সেই গেরুয়া কাপড়ের দ্বারা নয়- সে কাপড়ে বহু অসত্যকে চাপা দিয়া রাখে। ছন্দটাই ঐকান্তিকভাবে কাব্য তা নয়। কাব্যের মূল কথাটা আছে রসে; ছন্দটা এই রসের পরিচয় দেয় আনুষঙ্গিক হয়ে।' রবীন্দ্রনাথের এই উদ্ধৃতির শেষাংশ অনুযায়ী 'বিদ্রোহী' কবিতার ছন্দটাই মূল কাব্য নয়, মূল কাব্য তার রসে। অর্থাৎ কবিতাংশের 'যজ্ঞ, আমি', 'সৃষ্টি, আমি' ও 'ধ্বংস, আমি' পর্বসমূহ ছয় মাত্রা না হলেও তাতে রস (বীররস) বিদ্যমান। সন্দেহ নেই, 'বিদ্রোহী' কবিতাটি বহুমাত্রিক রসে পূর্ণ। আবার উদ্ধৃতির সর্ব শেষাংশে রবীন্দ্রনাথই বলেছেন, কবিতার ছন্দ আনুষঙ্গিক হয়ে রসের পরিচয় দেয়। তবে 'যজ্ঞ, আমি', 'সৃষ্টি, আমি' ও 'ধ্বংস, আমি' পর্বসমূহে ছন্দের ঘাটতিতে কি রস ব্যাহত হলো না? কিন্তু 'যজ্ঞ, আমি', 'সৃষ্টি, আমি' ও 'ধ্বংস, আমি' পর্বসমূহের মধ্যস্থলের যতির কি কোনো মূল্য নেই? ছন্দের কবিতার অভ্যন্তরে অর্ধ যতি ও পূর্ণ যতি লুকায়িত। তা প্রকাশিত হয় পাঠের মধ্য দিয়ে। যেমন- নিপাতনে কিছু সিদ্ধ এ পুরুষ ?? আয়নায় মুখ রেখে স্বীয় প্রতিভার জ্যোতিশ্চক্রে ?? নিজেরাই চমকায় আত্মপ্রেমের ঘোর লাগা চোখে জাদু বাস্তবে ? দেখে বামনের দেশে রয়েছে দাঁড়িয়ে ?? একাকী দীর্ঘকায় \হ(রাজহীন রাজধানী, আবিদ আনোয়ার) নিখুঁত ছন্দ পঠনে যে দোলা দেয়, সেই দোলার ফাঁকে যতি চিহ্ন অদৃশ্য থাকলেও তা প্রকাশ হতে বাধ্য। আবার যদি ঘনিষ্ঠ মনোযোগ দেয়া হয়, তবে এও লক্ষণীয় হবে যে, প্রতি পর্বের অভ্যন্তরেও অতি অল্প যতি বিদ্যমান। প্রবোধচন্দ্র সেন তার 'নূতন ছন্দ পরিক্রমা'য় লিখেছেন- "কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর 'অ-পরাজিতা' কাব্যের (১৯১৩) 'অ-পরাজিতা' নামক প্রথম কবিতার আরম্ভেই আছে- পরাজিত তুই সকল ফুলের কাছে তবু কেন তোর অ-পরাজিতা নাম? গন্ধ কি তোর বিন্দুমাত্র আছে? বর্ণ সেও তো নয় নয়নাভিরাম। আর ওই কাব্যেরই 'শেষ' কবিতার আরম্ভে বলা হয়েছে- শেষ অঞ্জলি ? নিঃশেষ আজি, শেষ সাজি যাহা ভরিবার, পরাজিত এই 'অ-পরাজিতার' সময় হয়েছে ঝরিবার। একটু তুলনা করলেই বোঝা যাবে, 'আমাদের উচ্চারণে প্রথম 'অ-পরাজিতা' শব্দে 'অ' দল ও তার পরবর্তী 'প' দল গায়ে গায়ে লাগা থাকে না। তাই 'অ' হয় দীর্ঘ। কিন্তু দ্বিতীয় 'অ-পরাজিতা' 'অ' ও 'প' গায়ে গায়ে লাগা রূপেই উচ্চারিত হয়। তাই এই 'অ' হ্রস্বই থাকে।' অর্থাৎ 'অ-পরাজিতা' শব্দে 'অ-' একমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে দুইমাত্রা হয়েছে এবং 'অ-পরাজিতা' শব্দটি তাই ছয় মাত্রার পর্বগুণ ধারণ করেছে। এই আলোচনায় স্পষ্ট যে, 'বিদ্রোহী' কবিতার আলোচ্য অংশে 'যজ্ঞ, আমি', 'সৃষ্টি, আমি', 'ধ্বংস, আমি' ও আরো কিছু পর্বসমূহের মধ্যে, 'যতি চিহ্নের কারণে পঠন-পাঠনে এক মাত্রার সমপরিমাণ সময় ব্যয়িত হয়। এমনটি হলে তা কেন একমাত্রা বেড়ে গিয়ে ছয় মাত্রা ধারণ করবে না! তবে প্রশ্ন থেকে যায় অন্য স্থানে, তা হলো এই যে, 'পুরোহিত, আমি', 'লোকালয়, আমি' ও 'অবসান, নিশা'-এর ক্ষেত্রেও তো একমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কথা! এক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য, যতি কখন পড়বে তা পঠনেই ঠিক হয়ে যায়। যেহেতু কবিতাটি রাগীস্বরে পঠিত হয় এবং যেহেতু, যতিচিহ্নের পূর্বে শব্দের শেষ অক্ষরটি বদ্ধাক্ষর হওয়ায়, যতিচিহ্নে এক মাত্রার সমপরিমাণ সময় ব্যয়িত হওয়ার সুযোগ থাকে না। সেহেতু উলিস্নখিত পর্বগুলো ছয় মাত্রার পর্ব হিসেবেই বজায় থাকে। আবার 'বিদ্রোহী' কবিতার প্রথম দুই চরণ উলেস্নখ করা যেতে পারে- 'বল বীর- বল উন্নত মম শির!' -এর প্রথম চরণটি চার মাত্রার। কিন্তু শেষে '-' চিহ্নটির গভীরতায় এর উত্তর পাওয়া যেতে পারে। পূর্বেও এই বিষয়ে বলা হয়েছে, এক্ষেত্রে পাঠশৈলীতে 'বীর-' শব্দে '-' চিহ্নের কারণে 'বীর' শব্দটি পাঠে বিলম্বিত হয়, এতে দুইমাত্রার সময় ব্যয়িত হওয়া সম্ভব। আবার যদি পরের চরণের অতি পর্ব 'বল' শব্দকে উপরের চরণের সাথে গণ্য করা হয় তবে সমস্যা দেখা দেয় না, 'বল বীর- বল/ উন্নত মম/ শির!' অর্থাৎ পাঠশৈলীই নির্ধারণ করে দেবে এর ছন্দ। মূলত এখানেই কাজী নজরুলের 'বিদ্রোহী' কবিতার ছন্দের শক্তি। প্রশ্ন থেকে যেতে পারে, এভাবে কি অসমর্থিত যুক্তি দাঁড় করানো হলো? এ শুধু গবেষকদের দৃষ্টিই এখানে সমর্থিত হতে পারে। তবে প্রবোধচন্দ্র সেনের ছন্দ ব্যাখ্যায় 'বিদ্রোহী' কবিতার ছন্দের এমন কৌশলকে পূর্ণ সমর্থন করে।