স্বপ্নের বোবা কান্না
প্রকাশ | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শাহানাজ শিউলী
কই গো কোথায় গেলে? প্যাকেটটি দাও। বাজারে যেয়ে দেখি কিছু কেনা যায় কিনা বললেন রায়হান সাহেব। রায়হান সাহেব একজন নন-এমপিও স্কুল শিক্ষক। আজ ২৬ বছর ধরে পড়ে আছেন ওই প্রতিষ্ঠানে। কতজন এলো গেল, কিন্তু রায়হান সাহেবকে নড়ানো গেল না। বলতে পারেন স্কুলের সঙ্গে তার নাড়ির টান। বিনা পয়সায় কত ছাত্রছাত্রীদের মানুষ করেছেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। এটাই তার আত্মতৃপ্তি। কিন্তু আর কতদিন? শরীর বলেও তো একটা কথা আছে। ছয় সদস্য নিয়ে রায়হান সাহেবের পরিবার। তার বাবা স্ট্রোক করে বিছানায় এবং মা বেঁচে আছেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। ছেলে রাজন দশম শ্রেণিতে পড়ে। মেয়ে শিলা পড়ে সপ্তম শ্রেণিতে। তিনি দিনরাত পরিশ্রম করেন। ছেলেমেয়ে দুটোকে নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন তার। তিনি টিউশনি করেন আবার মাঠে খাটেন এভাবে চলে তার সংসার। স্ত্রী সেলিনা বেগম টুকিটাকি দর্জির কাজ করে কোনোরকম নিজের হাত- খরচটুকু চালিয়ে যায়। কিন্তু আজ বেশ কিছুদিন হলো রায়হান সাহেবের শরীরটা মোটেই ভালো যাচ্ছে না। পাশের ঘরে সেলিনা বেগম তার মেয়েকে নিয়ে শুয়ে ছিল। মেয়ে তার মায়ের গলা ধরে বলছিল মা, আমরা কতদিন মাংস খাইনি। একটু মাংস কিনবে? আমার উপবৃত্তির টাকা এসেছে। সেলিনা বেগম মনে মনে ভাবছিল এই টাকা দিয়ে সে রায়হান সাহেবকে ডাক্তার দেখাবে। মেয়ের এই কথা শুনে সে চোখের পানি নিবৃত্ত করতে পারল না। চুপ করে শুয়ে নীরবে কাঁদছিল। কি বলবে মেয়েকে কোনো সান্ত্বনা খুঁজে পাচ্ছিল না।
আজ কেন জানি, রায়হান সাহেবের খুব ইচ্ছে করছে একটু মাছ মাংস কিনতে। ছেলেমেয়ের, পরিবারের মুখে কতদিন একটু ভালো খাবার মুখে তুলে দেয়নি।
সংসারের খরচ থেকে একটু একটু করে কিছু টাকা জমিয়েছিল মাটির ব্যাংকে। বিছানা থেকে উঠে এসে রায়হান সাহেব ব্যাংকটি ভেঙে ফেলল। স্ত্রীর সেলিনা বেগম দৌড়ায় এসে বলল, আরে আরে কর কি! রায়হান সাহেব ফ্যালফ্যাল করে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর কোনো কথা না বলে প্যাকেটটি নিয়ে বাজারে চলে গেলেন।
বাজারে যেয়ে রায়হান সাহেব কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কি রেখে কি কিনবে কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। যে জিনিসেই হাত দেন তার আকাশছোঁয়া দাম। কিন্তু নিজের ইনকাম তো আর আকাশ ছোঁয়া হয়নি। বড়লোকদের কোনো সমস্যা নেই। প্যাকেট ভর্তি টাকা নিয়ে প্যাকেট ভর্তি বাজার করে। জিনিসের দাম বাড়লো কি না বাড়ল তাদের কিচ্ছু আসে যায় না। যতসব সমস্যা মধ্যবিত্ত শ্রেণির। এরা না পারে ভিক্ষা করে খাইতে, না পারে মানুষের কাছে হাত পাততে, না পারে দুর্নীতি করতে। এদের স্বপ্নগুলো চোখের নোনা পানিতে ঝরে যায়। রায়হান সাহেব মাংসের দোকান থেকে ফিরে এলেন। ভাবলেন, আসার সময় মা বলে দিয়েছিল ওষুধ কিনতে। তাহলে আগে ওষুধের দোকানে যাই। ওষুধ কেনার পর যতটুক টাকা থাকবে তাই দিয়ে বাজার করব। তাই দুই দিনের ওষুধ কিনেই আবার ফিরলেন মাছের বাজারে। আজ না হয় একটু মাছ কিনবো মনে মনে বললেন রায়হান সাহেব। দেশের পরিবর্তন দেখে রায়হান সাহেব খুব খুশি হয়েছিলেন। হয়ত এবার একটু ইলিশ মাছ চোখে দেখা যাবে। আহারে কতদিন ইলিশ মাছ খাইনি। মাছের বাজারে যেয়ে তার মাথা ঘুরে গেল। এক কেজি ওজনের ইলিশের দাম ২২০০ টাকা। আর পুঁটিইলিশগুলো ৬০০/৭০০ টাকা। তাই ইলিশ আর কেনা হলো না। কিছু তরিতরকারি কিনে বাড়ি ফিরলেন তিনি। স্বপ্নগুলো শরতের শিউলির মতো নরীবেই ঝরে পড়ল।
এদিকে রাজনের স্কুলের বেতনও দিনে দিনে বাকি হতে লাগল। রায়হান সাহেবের স্বপ্ন ছিল রাজনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবে। কারণ সর্বশ্রেষ্ঠ মেধার স্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। রাজন খুব মেধাবী ছেলে। ছেলেকে বিসিএস ক্যাডার বানাবে। মস্ত বড় চাকরি করবে। একদিন তাদের সব কষ্ট ঘুচে যাবে। সেভাবেই তাকে মানুষ করে তুলছিল কষ্টের পাশাপাশি।
কষ্টের কাছে হার মানেন না রাহেন সাহেব। কিন্তু মেধাবীদের নাজেহাল অবস্থা দেখে রায়হান সাহেব খুবই মর্মাহত হলেন। না, এটা কোনো বিদ্যাপীঠ হতে পারে না। কোথায় সব হারিয়ে গেল নৈতিকতা, মূল্যবোধ, মনুষ্যত্ব, বিবেকবোধ। জাতি যেন মুখ থুবড়ে পড়েছে।
এটা কখনো মানুষ গঠনের কারখানা হতে পারে না। এটা মেরুদন্ড ভাঙার কারখানা। আহারে বিদ্যা, আহারে বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি ভাবলেন ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়ার আগে মানুষ তৈরি করতে হবে। বড় বড় সার্টিফিকেট ডিগ্রি দিয়ে দেশের উন্নতি হবে না যদি নিজের ভেতর কোনো নৈতিকতা, মূল্যবোধ, বিবেকবোধকে জাগ্রত না করা যায়। তার চেয়ে আমার লোকাল এলাকাই ভালো। এখানেই ছেলেকে পড়িয়ে ভালো মানুষ তৈরি করব।
দিনে দিনে রায়হান সাহেবের শরীরের অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকল। সেলিনা বেগম বলল, কি হয়েছে তোমার? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? রায়হান সাহেব কোনো উত্তর দিলেন না। রাতের সামান্য খাবার খেয়েই শুয়ে পড়লেন। শুয়ে শুয়ে আলস্নাহর কাছে মনে মনে প্রার্থনা করলেন, হে আলস্নাহ, আমাকে আর কয়টি বছর সুস্থ রাখো যেন আমি আমার সন্তান দুটো মানুষ করে তুলতে পারি। কিন্তু স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল। পরদিন ভোর বেলায় রায়হান সাহেব বিছানা থেকে উঠতে গেলে দেখেন তিনি আর উঠতে পারছেন না। একপাশ অবস হয়ে আছে। মনে হচ্ছে- হাত-পা পাথর হয়ে গেছে। কিছুতেই তিনি নড়াচড়া করতে পারছেন না। তিনি চিৎকার করে কেঁদে উঠে বললেন, সেলিনা আমি উঠতে পারছি না কেন? সেলিনা দৌড়ায় এসে দেখে তার স্বামী অবশ পড়ে আছে।। তাকে উঠানোর অনেক চেষ্টা করল কিন্তু কিছুতেই পারল না। সেলিনা চারিপাশটা অন্ধকারে ঘিরে ধরল। রায়হান সাহেবের চোখ থেকে নিভে গেল স্বপ্নের আলো। বেড়ার ফাঁকে বিন্দু বিন্দু আলোর দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন রায়হান সাহেব। স্বপ্নের বোবা কান্নায় চোখের গোল গোল অশ্রম্নবিন্দুতে নিভে গেল প্রভাতী আলো।